প্রতি বছর এপ্রিল মাসে রহমত আলীর বাজে অনুভূতি হতে শুরু করে। এইত এপ্রিলে বাংলা নববর্ষের আয়োজনে বউকে নতুন শাড়ি জড়িয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসলেন। কি সুন্দর লাগছিল বউটাকে। আহা! এমন সুন্দর বউ ক’জনের ভাগ্যে জোটে! তবুও অনুভূতির খচখচানি যায় না। যাবেই বা কেমন করে? এপ্রিল মে থেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ অফিসার রহমত আলীর শুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা। অফিসের আয়ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হয়। বাৎসরিক আয় ব্যয়ের হিসাব। জুনেই সাবমিট করতে হবে। এরপর সংশোধনীর পর সংশোধনী। তারপর ফাইনাল। হিসেব মেলাতে মেলাতে কখনও সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় অফিস থেকে বের হতে। বড়কর্তা তাকে ভীষণ পছন্দ করেন। হিসাব নিকাশে সে বড় পাকা। কখনও টাকাপয়সা এদিক সেদিক হয় না। বাৎসরিক ব্যয়ের হিসাবটাও মেলায় খুব সুন্দর। কিন্তু প্রতিষ্ঠান ছোট বলে বেতন সীমিত।
কিন্তু এই এপ্রিল মাসে এসে সীমিত বেতনে নিজের ঘরের হিসেব মেলাতে গিয়ে তিনি আর মেলাতে পারেন না। দেখেন আয়ের সাথে ব্যয়ের খুবই বেহিসেবি সম্পর্ক। তো বউয়ের সাথে তার সম্পর্ক কিভাবে হিসেবি থাকবে! প্রতিদিন বেহিসেবি অসংলগ্ন কথাবার্তায় ঘরে ফিরে সময় কাটে তার। অফিসের পাক্কা হিসেবধারী লোকটি ঘরে যে এত আনাড়ি নিজেই অবাক হন। তিরস্কার শুনতে হয় বউয়ের। বাজে বাজে অনুভূতির দল আরও আরও ভিড়তে থাকে। সকালে বাজারে গিয়ে দেখেন আজ তেলের দাম বাড়তি তো কাল পেঁয়াজের দাম। সবজি বলতে একদিন পুঁইশাক তো আরেকদিন লাউশাক কেনার সামর্থ্য হচ্ছে। সাথে একটা লাউ নয়ত পটল। ভাজি করার যোগ্য কোনো সবজি তিনি কেনেন না। হিসেব কষে তিনি দেখেছেন ভাজিতে তেল পেঁয়াজ মরিচ সবই বেশি খরচ হয়। বড় মাছও কেনেন না তিনি। তার হিসেবে ছোট মাছ কিনলে লাভ বেশি। সবজির সাথে একটু ছড়িয়ে টরিয়ে দিয়েও মাছ দিয়ে ভাত খাওয়া বলা চলে। শুধু বাজার খরচই তো সংসারের খরচ না। আরও অনেক কিছুতেই তার বাজে অনুভূতি চেপে বসল।
ঘর থেকে বেড়িয়ে রিকশায় উঠলেই দেখে রিকশাঅলার মেজাজ গরম, দরদাম করলেই দোকানি উল্টো খ্যাচখ্যাচানি দেয়, ঘরে ফেরার সময় চাহিদার চেয়ে কম জিনিস নিয়ে আসায় সর্বোপরি তারও মাথা গরম। মে মাসের পনের দিন যেতেই পকেটে টান পড়ে গেল। পাক্কা হিসেবি রহমত সাহেব সামনের দিনগুলোতে চোখ বুলালেন। কোনো রকমে মাসটা টেনে যেতে হবে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে দেশের টাকাপয়সার আয়ব্যয়ের বাজেথট করা হবে। তো তারও তো কিছু করা দরকার। কিন্তু কিভাবে? তিনি তার আয় কি আছে তার সাথে মিলিয়ে ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করবেন আর দেশ তো করবে ঠিক উল্টোটা। আগে ব্যয়ের খাত চিহ্নিত করবে তারপর কোথা থেকে টাকা আসবে সেটা চিন্তা করবে। তো তার আয়ব্যয়ের হিসাব মিলল না কিছুতেই। আয়ের সাথে ব্যয় মেলাতে গিয়ে প্রথমেই রিকশা ভাড়াটা কমানোর চিন্তা করলেন। তারপর শখের চা খাওয়াটা। বাজার তো আগেই চাপিয়েছেন। সিগারেটটা বাদের তালিকায় রাখতে পারলেন না। ওটা ছাড়া তিনি অচল। ভাবলেন আর কি বাদ দেয়া যায়! আরেকটু ভেবেই বাদ দিয়ে ফেললেন বছরে একবার বউটাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার বিষয়টা। পরের বছর বেতন বাড়লে তখন না হয় বেড়ানো নিয়ে ভাবা যাবে। তারপর অপেক্ষায় থাকলেন দেশের বাজেটের।
তার বাজে অনুভূতিটা বিস্ফোরিত হলো জুন-জুলাইতে বাজেট প্রকাশ পাওয়ার পর। দৈনন্দিন ভোজ্য জিনিসের দাম এত বেড়ে গেল যে তিনি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। আর কি কি বাদ দিবেন তিনি! কাজের লোককে বাদ দেওয়ার চিন্তাটা আসতে বাধ্য হলো। দু মাস আগে ঘরের কাজের জন্য একটা ছুটা কাজের লোক রেখেছিল বউ। দুইটা কাজ করে। শুধু এই দুইটা কাজ থেকে রেহাই পাওয়ায় কি আয়েশি লাগে বউটাকে! সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকেই মন ভালো হয়ে যায়। ছাঁটাইন করতে হবে তাকে ভেবে মনটা খচখচ করতে লাগল। বাদ দিতে হলো রোজকার দুধ খাওয়াটা, সকালের ডিমটাও। নাহ, তাতেও হচ্ছে না। সিগারেট খেতে খেতে রাত দুপুরে পায়চারি করে আরও একটা খরচ কমানোর জায়গা বের করলেন। এ যেন তার ভীষণ তৃপ্তি। আরও একটা খরচ কমানো গেল। সপ্তাহে চারদিনের বদলে দু’দিন মাছ খাবেন। সেও অবশ্যই ছোট মাছ। এতে তার আমিষটা টেনেটুনে ঠিক থাকবে। রহমত আলীর মতো সব নিু-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তের ঘরেই আগস্ট মাস জুড়ে আয়-ব্যয়ের সম্পর্ক বের করতে হৈচৈ চলে। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে গা সওয়া হতে হতে হজমের পর্যায়ে চলে আসে। রহমত সাহেবেরও ধারদেনা করে আয়ব্যয়ের হিসাব মোটামুটি হজমের পর্যায়ে এসেছে।
কিন্তু হজমের পর্যায়ে আসতে আসতেই রহমত আলী টের পেলেন দীর্ঘ পথটা হেঁটে অফিসে এসে কাজ করতে গিয়ে তার প্রচুর ভুল হচ্ছে। খাবারের তালিকা থেকে দুধ, ডিম, মাছ বাদ হয়ে যাওয়ায় তার শরীরের ক্লান্তি যায় না। শরীরটা শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। খালি পেটে সিগারেটের ধকলটা নিতে পারছে না শরীর। প্রায়ই পেটে ব্যথা হয়। ভাবছেন ডাক্তার দেখানো দরকার। ঘরে ফিরে প্রতিদিন ঝগড়া হচ্ছে বউয়ের সাথে। রাতে ঘুম হয় না ঠিকমতো। কিভাবে ধারদেনা শোধ করবে? দেশের ধার দেনা তো বছরের পর বছর টেনে নেয়া যায়। কিন্তু তারটা! মাস শেষ হওয়ার আগেই চাপ আসতে শুরু করে। ভাবতে ভাবতে প্রায়ই ভোর হয়ে যায় তার। এপাশ ওপাশ করে নির্ঘুম রাত কাটাতে কাটাতে দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে গেল তার আচরণ। একদিন বড়কর্তার সাথে বেয়াদবি করে ফেললেন। আর সেই সঙ্গে চাকরিটাও খোয়া গেল।
অতীতের রেকর্ডের কারণে টাকাপয়সা তেমন কাটল না। পাঁচ বছর কাজ করেছেন তিনি এখানে। খুব বেশি না সঞ্চয়। তবু অফিসের ফান্ড থেকে যে ক’টা টাকা পেলেন তা দিয়ে মোটামুটি একটা ভারসাম্য করলেন। হিসেবে কিন্তু রহমত সাহেব খুব পাকা। অধিকাংশই দিয়ে দিলেন দেনা পরিশোধ করতে। বাকিটা রেখে দিলেন সংসার খরচের জন্য।
আবার এপ্রিল মাস এসে গেছে। কোনো রকমে বাসা ভাড়াটা মিটিয়ে দিলেন। জিনিসপত্র যা ছিল তা বিক্রি করে গ্রামের পথে রওয়ানা দিলেন বউকে রেখে আসতে। নিজের বলে তেমন কেউ নেই, কিছু নেই সেখানে। আছে ক’জনা দূরের আত্মীয়। গ্রামখানি তার খুব সুন্দর। প্রতি বছর বৈশাখে মেলা হয়। বৈশাখী মেলা চলছে গ্রামে। বউয়ের বায়না ‘চলো না একটু ঘুরে যাই। কিনব না কিছু।’
তার নিজেরও প্রাণটা খুব চাইছিল। পথে বউকে অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝাতে বোঝাতে এসেছেন। আগ বাড়িয়ে মেলায় যাওয়ার কথা বললে যদি ঝগড়া বেধে যায় সেজন্য চুপ ছিলেন। বউ বায়না করার সাথে সাথেই মেলায় ঢুকলেন। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে পকেটে হাত দিলেন বউটার জন্য কিছু কিনবেন মনে করে। শাড়ির দোকানের সামনে এসে মুখটা ম্লান হয়ে গেল তার। গত বছরের কথা মনে পড়তে থাকল। কি অপূর্ব মুখখানা তার বউয়ের। কি মানিয়েছিল শাড়িটায়! আড় চোখে দেখে নিলেন বউকে। এ ক’টা মাসে দূর্বল খাওয়া দাওয়া আর সাংসারিক কাজের চাপে কেমন মলিন হয়ে গেছে মুখখানা। কিন্তু পকেট থেকে আস্তে বের করে নিলেন হাতটা। বাজেটে হবে না। এ টাকা ক’টা দিয়েই শহরে ফিরবেন তিনি। দূর সম্পর্কের এক চাচার বাড়িতে রেখে আসলেন বউটাকে। বললেন একটা কাজের ব্যবস্থা করেই নিয়ে যাবেন। মাত্র তো দুটো পেট। ব্যবস্থা একটা নিশ্চয়ই করে ফেলবেন। এবার আরেকটু বেশি বেতনের চাকরি খুঁজবেন তিনি। তাহলে এত সমস্যায় পড়তে হবে না। কিন্তু জুন-জুলাই তে গিয়ে…।
হিসাব মেলে না রহমত আলীর। ভাবেন বাজেথট শব্দটা বাজে দিয়ে শুরু হওয়ার জন্যই বোধকরি তার এই বাজে অবস্থা।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা।