গত কয়েক দশক ধরে ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান অন্যতম। এই সেক্টর শুধু যে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে তা নয়, ভারতের অনগ্রসর ও গ্রামীণ এলাকার শিল্পায়নে এদের বিরাট একটি ভূমিকা দেখা যায়।
বলা হয়ে থাকে, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প একটি দেশের অর্থনীতির মেরুদ- তৈরি করে এবং সে কারণেই দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে দেশের ক্ষুদ্র শিল্পের উন্নতিতে জোর দেওয়া অত্যন্ত আবশ্যিক। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি হয় তাতে এই খাতকে উপেক্ষা করলে বিরাট জনগোষ্ঠী এবং উদ্যোগপতিরা পিছিয়ে পড়বে এবং সেটা দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে মোটেই কাম্য নয়।
যে পরিমিতিতে এই ক্ষুদ্র ছোট ও মাঝারি উদ্যোগগুলো তৈরি হয় তা সর্বদাই উন্নয়নের পক্ষে কাজ করে এবং দারিদ্রতা রোধের মূল মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরণের শিল্পগুলো মূলত বড় পরিসরে কাজ করলেও একই সঙ্গে সমাজের সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের আয়ের সুযোগ করে দেয়। এক কথায় বলা যায় এই শিল্পগুলো নারী, যুব এবং দরিদ্র মানুষ যাদের রোজগার খুবই কম— তাদের একটি আয়ের উৎস ও জীবনের দিশা খুলে দেয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রামীণ ও শহর থেকে দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী মানুষদের জীবনে এসব শিল্পই আয়ের একমাত্র উৎস।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও, সেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ও ঋণ পেতে যে পদ্ধতি এবং শর্তাবলীর মধ্য দিয়ে আগ্রহীদের যেতে হয় তা যথেষ্টই জটিল। এছাড়া কিছু প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং দুর্নীতির সঙ্গেও এই ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোগপতিরা পেরে উঠতে পারেন না। যার ফলে তারা এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়েন।
এ ধরনের সমস্যাগুলোর বাইরেও বিজনেস রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমতি সংক্রান্ত বিষয় ও ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতার কঠিন মানদণ্ড এবং দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ পদ্ধতি এই নতুন স্বপ্ন নিয়ে ব্যবসা করতে আসা মানুষগুলোকে প্রতিনিয়তই অনুৎসাহিত করে তুলছে।
যারা ‘স্টার্ট আপ’ তারা ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী জামানত বা প্রশংসাপত্র দিতে অপারগ হওয়ায় ব্যাংকগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছেন না। একই কারণে ব্যাংকগুলোও ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিতে চাইছে না। কিংবা যদি দিয়েও থাকে তবে এসব ক্ষেত্রে সুদের হার থাকছে স্বাভাবিক থেকে অনেক অনেক বেশি। সরকারি ঋণ নীতিমালা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বহুক্ষেত্রেই মেনে চলছে না, অথচ সরকার আর্থিক বাজেট ও বাৎসরিক নীতি ঘোষণা করার সময় ছোট উদ্যোগীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার কথা জোর দিয়ে বলেছে বলছে বটে কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাংকের গরিমসিকেই বহুলাংশে দায়ী করা যায়।
এতক্ষণ যে সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা বলা হলো- এগুলো পশ্চিমবঙ্গের এক মাঝারি শিল্পের (ফ্রোজেন ডেসার্ট) উদ্যোগপতির খুব কাছ থেকে দেখা নিজস্ব অভিজ্ঞতা। এ তো গেল শুরুর দিকের গল্প, এরপর একে একে ডিমনিটাইজেশন বা মুদ্রারহিত করণের হঠকারী বাস্তবায়ন অতিমারী এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, এসব তো বর্তমানে উদ্যোক্তাদের ভয়ংকর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে যারা এতদিন ব্যবসার বিস্তার নিয়ে ভাবছিলেন তারা এখন ব্যবসা কিভাবে টিকিয়ে রাখবেন সেটিই তাঁদের প্রধান দুশ্চিন্তা হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে এই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে ঐক্যবদ্ধতার অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কাঁচামাল ও পেট্রোল ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যখন উৎপাদিত পণ্যেরও মূল্যবৃদ্ধি করা জরুরি। কিন্তু অন্য ও বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই একই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ঐক্যমত নন। এর ফলে বর্ধিত মূল্যে কাঁচামাল কিনে উৎপাদিত পণ্যের বাজার দর না বাড়িয়ে ব্যবসা বাঁচিয়ে রাখতে ছোট ও মাঝারি স্তরের উদ্যোগীরা পণ্যের গুণগত মানের সঙ্গে আপোস করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই সরকারি স্থবির রীতির ফলে ক্রেতা সাধারণ সাময়িক লাভবান হচ্ছেন ঠিকই তবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাঁদের বিক্রিও কমে গেছে। আর বিক্রি কম মানে শেষ অবধি সরকারই জিএসটি হারাচ্ছে। অন্যদিকে কিন্তু এই ক্রম লোকসান দিতে বাধ্য হয়ে কত কত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী যে ঝরে গেছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এই প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।
এসব কারণে বহু মানুষ এখন ঝুঁকি নিয়ে উদ্যোগপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেই ভয় পাচ্ছেন। করোনা ভাইরাস মহামারী পরবর্তী এই সময়ে সরকারের উচিত উদ্যোক্তাদের নমনীয় শর্ত সাপেক্ষে আরো সহজ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে এই ‘স্টার্ট আপদের’ পাশে দাঁড়ানো। তাহলেই হয়ত আগামীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এই সংকটকাল থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এবং আমরাও এর সম্প্রসারণে আরো একটু আশাবাদী হতে পারব।
সাম্প্রতিক সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গোটা দেশে একাধিক শিল্পক্ষেত্র যখন মন্দার কবলে এবং অনুৎপাদক সম্পদের কারণে ব্যাংকগুলো যখন ঋণ দিতে পারছে না তখন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ঋণ পাওয়ার নিরিখে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অনেকটা এগিয়ে রয়েছে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদ্র ও বস্ত্র শিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে এবং একই সঙ্গে এসব পণ্য বিপণনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে চালু করা হয়েছে বিশ্ব বাংলা ব্র্যান্ড। বাইশ একর জমি নিয়ে করা হয়েছে বিশ্ব বাংলা মেলা প্রাঙ্গণ। এই আন্তর্জাতিক মানের প্রাঙ্গণে বিভিন্ন ধরণের বাণিজ্যিক প্রর্দশনীর আয়োজন যাতে করা যায় সেটাই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য। নিঃসন্দেহে এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এ ভাবে কর্মসংস্থানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে হাতিয়ার করতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। রাজ্য সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।
লেখক: কবি ও কলামিস্ট, ম্যানেজিং পার্টনার, রেইনবো ফুড প্রোডাক্টস, পশ্চিমবাংলা, ভারত।