প্লেনে করে নাজিবুল্লাহকে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে সাতজন মানুষ রানওয়েতে অপেক্ষা করছিল, কেউ জানে না ওরা কারা। জাতিসংঘের ভূমিকা কী ছিল, বা কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল তাদের, কেউ জানে না। কেনই বা বিজয় নাম্বিয়ার মতো তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন একজন মানুষ সেই মুহুর্তে একদম শান্ত নীরব ভূমিকা পালন করলেন, সেটাও জানে না কেউই। ১৯৯২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর, ভোর রাত তিনটা, ভয়ংকর সেই সময়ে নাজিবুল্লাহ যখন পাগলের মতো সাহায্য চাইছিলেন জাতিসংঘের কাছে, কেন যে কেউই সাড়া দেয় নি তার ডাকে, কে জানে? একইভাবে কেউই জানে না, রাশিয়াই বা কেন নীরব দর্শক হয়ে তাদের শেষ কমরেডকে এরকম নৃশংসভাবে খুন হয়ে যেতে দিল।
ইতিহাস মুছে ফেললে সভ্যতা ভেঙে পড়ে। আফগানিস্তানে গান্ধার যাত্রা ঠিক সেরকমই সভ্যতার একটা ক্ষত। যেটাকে ভুলে যাওয়া মানে অতীতের গৌরব অস্বীকার করা।
গ্রিক, হুন, মঙ্গলীয়, আরব, শিখ, বৃটিশ আর রুশদের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আফগানিস্তান। এখানকার প্রত্যেকটা আক্রমণই ছিল নৃশংস, রক্তক্ষয়ী আর বিশ্বাসের মূলে নাড়া দেওয়ার মতো তীব্র। হিন্দু, বৌদ্ধ, জোরাস্ট্রিয়ান, শিখ, এদের ধর্মের যে নির্যাস, মূল গান্ধাররা তাদের ধর্ম সেই আলোকেই পালন করে। দুশ’ বছর ধরে চলা ভয়ানক এক যুদ্ধের পর ইসলামের আবির্ভাব, সেটাও প্রায় মধ্যযুগীয় ঘটনা।
১৯৭৩ সালে রাজা জহির শাহের পতনের পর ১৯৭৯ সালের দিকে সহিংসতা, হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞে ভরা কমিউনিস্টদের যে আন্দোলন, তার সাক্ষ্য দেয় আফগানিস্তানের নৃশংস ইতিহাস।
পরিহাসের ব্যাপারই বটে যে কমিউনিস্টরা সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যবাহী একটা সমাজকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, তারাই আবার গরীব এবং সর্বহারাদের জন্য নিজেদেরকে একটা যোগ্য শাসন ব্যবস্থা বলে মনে করে। এবং এই কারণে কমিউনিস্টরা ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আফগানিস্তানে স্থানীয় প্রশাসনের কাজে ঝামেলার পর ঝামেলা তৈরি করে যাচ্ছিল। পাকিস্তান সমর্থিত তালেবান, আর রুশ সমর্থিত কমিউনিস্টদের মধ্যে পড়ে আফগানিস্তান বারবার ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। এইখানেই ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর ভয়ংকরতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলোর একটির। রাশিয়ানরা আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয় ১৯৮৯ সালে। তারপরেও ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা কমিউনিস্ট নাজিবুল্লাহকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এবং বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখে।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ এর মধ্যেই নাজিবুল্লাহ কমিউনিস্টদের মুখপাত্র হয়ে ওঠেন এবং একজন নির্মম, নির্দয় আর নিষ্ঠুর কমান্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯১ সালের বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তিনি তালেবানদেরকে পরাজিত করেন। তার নিজের অবস্থানকে সমুন্নত রাখতে কাউকেই কখনই বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নি তিনি। পরবর্তী সময়ে তার খুনপিপাসু কর্মকাণ্ডের কারণে তারই বিশ্বস্ত মন্ত্রীসভার এক সহকর্মী ওয়াকিল তাকে ‘কাবুলের কসাই’ নামে অভিহিত করেন।
দোস্তাম ছিলেন একজন তাজিক কমান্ডার। তালেবানদের বিরুদ্ধে তিনি আহম্মেদ শাহ মাসুদের ডান হাত ছিলেন বলা যায়। এই দোস্তামকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন নাজিবুল্লাহ। তালেবানদের বেশিরভাগ নেতৃত্বে ছিল পশতুন। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রুশদের সম্মুখ অভিযানও তালেবান যোদ্ধাদের দমন করতে পারে নি। অবশেষে ১৯৮৯ এর ডিসেম্বরে নাজিবুল্লাহকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়ে রাশিয়ানরা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়। দোস্তাম আর আহমেদ শাহ মাসুদ কাবুলে বিশেষ ব্যবস্থায় কমিউনিস্টদের থাকা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। তাদের মধ্যে আদর্শ বা নৃগোষ্ঠীয় ভ্রাতৃত্ববোধ- কিছুই আর বাকি ছিল না। পর্যাপ্ত অর্থ পেলে যে কেউ তার আনুগত্য যে কারও দিকেই পরিচালিত করতে পারত।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ হয়েছিল। তাতে প্রায় এক লাখেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে বেসরকারি এবং উঁচু উঁচু অনেক বাসভবন। কাবুলের সব জায়গায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় এবং সব ধরনের ত্রাণ আর সহযোগিতা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কাজেই সম্পদবিহীন একটি রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারটা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। দেশ রক্ষার জন্য নাজিবুল্লাহ মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলো থেকে কিছু সহযোগিতার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারতেন। কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পর, ১৯৯২ সালের এপ্রিলে তিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
নাজিবুল্লাহ তার অবিশ্বস্ত সহযোগী এবং মিত্রদের ভেতরের ভয় এবং শংকা টের পাচ্ছিলেন। প্রচ- চাপ এবং অনিয়শ্চতার বোধ নিয়ে তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বিজয় নাম্বিয়ার মাধ্যমে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। নরসীমা রাও, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন্তু দুদিন পরেই তিনি রাষ্ট্রীয় সম্মতি নিয়ে জানান, নাজিবুল্লাহর উচিত জাতিসংঘের মাধ্যমে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করা। জাতিসংঘের মাধ্যম হয়ে এই লুকোচুরির উদ্দেশ্য ছিল দুটো। আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের অবস্থান যে নিরপেক্ষ, সেটার প্রকাশ নিশ্চিত করা এবং তালিবানদের সরাসরি ক্রোধ থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখা।
অবশেষে ১৯৯২ সালের মে মাসে নাজিবুল্লাহ আফগানিস্তান ছেড়ে ভারতে যেতে মনস্থির করেন। সেখানে তখন ছিলেন বিজয় নাম্বিয়ার, যিনি কাবুল থেকে নাজিবুল্লাহকে উদ্ধার করে রাজনৈতিক আশ্রয়ে নিয়ে আসার সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। জাতিসংঘের সম্মতিতেই পুরো পরিকল্পনা খুব গোপনে করা হচ্ছিল। নাজিবুল্লাহ নিজেকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিতে তখনও কেন দেরি করছিলেন সেটা নিয়ে ইতিমধ্যেই অনেকের মধ্যেই কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আহমেদ শাহ মাসুদের নির্দেশে দোস্তাম তার মিলিশিয়া বাহিনী নিয়ে কাবুলের স¤পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কমান্ডার দোস্তাম আর জাতিসংঘের ওপর নাজিবুল্লাহর যথেষ্ট আস্থা ছিল। সরকারি স্থাপনা, কৌশলগত অবস্থান, এয়ারপোর্ট, সবকিছুই দোস্তাম মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। নাজিবুল্লাহর দেশত্যাগের সময় কোনও ঝামেলা হবে না বলে তাকে আশ্বাসও দেওয়া হয়েছিল।
অবশেষে ভারতীয় গুপ্ত সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১৯৯২ সালের মে মাসে নির্জন এক ক্যারিয়ারে একটি বিমানের ব্যবস্থা করা হয়। সাতজন ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব ছিল কাবুল এয়ারপোর্টে নাজিবুল্লাহকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার। প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর বহর নিরাপত্তার সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। দোস্তাম মিলিশিয়া দ্বারা পরিচালিত প্রতিটি চেক পয়েন্টই তারা বিভিন্ন সাংকেতিক চিহ্ন আদান প্রদানের মাধ্যমে নিরাপদে পার হয়ে যেতে সমর্থ হয়। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণেই আছে বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিধিবাম। কেউ তখনও পর্যন্ত জানতে পারে নি ঠিক কী কারণে একদম শেষ মুহুর্তে কমান্ডার দোস্তাম কমিউনিস্ট নাজিবুল্লাহকে সরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাথে বিজয় নাম্বিয়ারের কুটনৈতিক সম্পর্ক ও কর্মজীবনের একটি বিশাল গৌরবগাঁথা থাকলেও তিনি কখনই মুখ ফুটে উচ্চারণ করেন নি সেদিন আসলে কী ঘটেছিল। বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হতে দোস্তামের বিন্দুমাত্র সময় লাগে নি। হতাশ হয়ে অসহায় নাজিবুল্লাহ ব্যক্তিগতভাবে দোস্তামকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। তাকে সরিয়ে নেয়ার জন্য যে বিমানটি প্রস্তুত ছিল, সেটি তিনি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছিলেন। অসাড় স্নায়ু, অবদমিত রাগ, নিয়ন্ত্রিত ক্ষোভ, এইসব লুকোচুরি, সবকিছু মিলিয়ে তার ভেতরটা যেন ফেটে পড়ছিল।
এরপর যা হলো, সেটা রীতিমতো অপ্রত্যাশিত। এয়ারপোর্টে তাকে হত্যা করা হয় নি। এবং ব্যাপারটা এমনভাবে উপস্থাপিত হলো, যেন এটা দোস্তাম এবং তার সহযোগীদের উদারতা যে তাকে সেখানেই শেষ করে দেওয়া হয় নি, যেটা করার ক্ষমতা তাদের ছিল। নাজিবুল্লাহকে ফেরত পাঠানো হলো। তার ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতার বলয়ে হাতে গোনা অল্প কিছু সমর্থকই বাকি ছিল। বিপদের গন্ধ পেয়ে নাজিবুল্লাহ তার প্রাসাদে ফিরে না গিয়ে জাতিসংঘ চত্ত্বরে আশ্রয় নেন।
জাতিসংঘ প্রাঙ্গণে নাজিবুল্লাহ প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে নির্বাসনে ছিলেন। সেই সময়টাতে আফগানিস্তান জাতিসংঘেরই অধীনে একটি সর্বদলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে ছিল।
তালেবানরা তখনও শহরে ঢুকতে পারে নি। কাবুলের উপকন্ঠে যুদ্ধ তখন চলমান। ১৯৯৬ এর সেপ্টেম্বরে সরকারি দুর্বল একটি বাহিনীকে পরাস্ত করে তালেবানরা শহরে ঢুকে পড়তে সমর্থ হয়। নাজিবুল্লাহর ক্ষমতা তখন শেষ। ভোর রাত, ঘড়িতে সময় তখন তিনটা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা প্রহরীরাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মৃত্যু যেন ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অসাড় নাজিবুল্লাহ মরিয়া হয়ে তার নিরাপত্তা রক্ষার জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। নুর হাকমল, একজন তালিবান কমান্ডার কাবুল শহরে ঢুকে পড়েন জাতিসংঘ চত্বরে। লোকটা ছিল ভয়ানক রকম নির্মম। নাজিবুল্লাহর কলার ধরে সে বাইরে নিয়ে আসে, এবং তার মাথায় গুলি করে। তার রক্তাক্ত শরীর টেনে নিয়ে যাওয়া হয় কাবুলের রাস্তায়। একদিন যে প্রাসাদে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন, সেই প্রাসাদের সামনেই একটা ট্রাফিক পোলের সাথে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। একই সাথে ঝোলানো হয় তার ভাই শাহপুর আহমাদজাইকেও। দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর।
নাজিবুল্লাহর ঝুলন্ত লাশ নিয়ে তালিবানরা উল্লাস করছিল। কেউ জানে না তখনও সেই আনন্দের ফাঁকেই আফগান সমাজে উঁকি দিচ্ছিল নতুন কিছু দুঃখ, কষ্ট, সহিংসতা, ধ্বংস, এবং মৃত্যুর হাতছানি।
হ্যাঁ, সর্বশেষ যে কমিউনিস্ট, তাকে ফাঁসিতেই ঝোলানো হয়েছিল। এবং ততক্ষনে তিনি সমস্ত যন্ত্রণা আর কষ্ট পেছনে ফেলে পরপারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।
তথ্য সূত্র: সনত ভরদ্বাজের ‘নাজিবুল্লাহ: হ্যাংগিং অব দ্য লাস্ট কমিউনিস্ট’ অবলম্বনে।
লেখক: লেখক ও শিক্ষাবিদ।
1 Comment
Sabbir
অসাধারণ লেখনী!!