ঝড়ে বড় গাছেরা ঝরে পড়ে। যত বড় ঝড় তত বড় বৃক্ষের বিপত্তি ঘটায়, এমনকি ঘটে যায় সমূলে উৎপাটন। অথচ তার নিচেই ছোটখাটো গাছগাছালি কিংবা লতাগুল্মের নাগাল পায় না সেই ঝড়-ঝঞ্ঝা। কথাটা পুরোপুরি না খাটলেও সত্যি এই যে বিশ্ব জুড়ে কোভিড মহামারির তা-বে যে মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সকল আকার আকৃতির ব্যবসা ও দেশ, বাংলাদেশকে যেন সেভাবে ছুঁতে পারে নি কোভিড। লাগাতার শাটডাউন আর বিরামহীন চাকরি হারানোর ঘটনায় গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত ও অসহায় হয়েছে নিম্নমধ্যবিত্ত, আর তার চেয়ে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত। নিম্নমধ্যবিত্ত তবু হয়ত জানান দিতে পেরেছে তার অভাব-অপারগতা ও দৈন্যের কথা। মধ্যবিত্তকে পেটে পাথর বেঁধে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হয়েছে।
এত বৈরিতায়ও আমাদের বাংলাদেশ ঠিক ঠিক ধরে রেখেছে তার প্রবৃদ্ধির হার। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে গতিশীল রয়ে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। রপ্তানিতে যে ধস নেমেছিল সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াবার পর্ব শুরু হয়েছে মহামারির দিন না পেরুতেই। উন্নয়নের চাকা যেন অটো পাইলটের মতো চালিয়ে নিয়ে গেছে দেশের অর্থনীতিকে। তার পেছনের কৃতিত্ব এদেশের আপামর মানুষের। বেসরকারি খাত এবং ব্যক্তি আয়ের ও করের নিরবচ্ছিন্ন অবদানের আড়ালে কৃষিখাতে সাম্প্রতিক দশকে উন্নয়ন এদেশের অর্থনীতিকে দিয়েছে বাড়তি শক্তির জোগান।
এইসব ইতিবাচকতার বাইরেও কথা কিন্তু আছে। মুদ্রার অন্য পিঠটি সমান উজ্জ্বল ও রঙিন নয়। বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার মানসিকতাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা ও বেড়ে উঠতে দেয়া সত্য তাই অনুচ্চারিত না থাকাই শ্রেয়। অর্জনের উল্টোপিঠে সংকটগুলোও তাই চিহ্নিত ও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক শ্রীলংকা সংকট নিয়ে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে আমাদেরও অমন হবে এই ভাবনায় অহেতুক বিচলিত না হলেও আমাদের সংকটগুলো জেনে তাকে ঘিরে ভীতি না ছড়িয়ে সচেতনতাভিত্তিক তথ্য ও করণীয়গুলো ছড়ানো খুব আবশ্যক।
চলমান বাংলাদেশ-শ্রীলংকা টেস্টের স্কোরকার্ডের মতোই যখন আজ গোটা বিশ্বের গণতান্ত্রিক অর্থনীতির চেহারা তখন যে কোনো সংকটকে ঘিরেই সমাজ ও রাষ্ট্র সেই উল্টোরথের কিছুটা হলেও রাশ টানতে চেষ্টা নিতে পারে। অন্তত অমন একটা সুযোগ তৈরি হয়। যে স্কোরকার্ডের কথা বলছি, তাতে শূন্য রান ছয় জনের, দু’জন বাদে বাকিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯, তৃতীয় ৮ রান। মূলত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (১৭) এসেছে এক্সট্রা রানের খাতা থেকে। বাংলাদেশের স্কোর তবু প্রথম ইনিংসে ৩৬৫। কারণ যে দু’জনকে বাদ দিয়ে তথ্য দিচ্ছিলাম তাদের একজন ১৪১ ও অন্যজম ১৭৫ রান করেছে। বিদ্যমান সমাজে আয়ের বৈষম্যের একটা প্রতীকী চিত্র যেন এই স্কোরবোর্ড।
এই রকম বৈষম্য যদি থাকে একটা দেশের আয়ের উৎস খাত সমূহে, তাহলে সেটাও স¤পদের অ-সুষম বন্টনের মতো বিপজ্জনক একটা প্রেক্ষিত তৈরি করে সেই দেশের জন্য। অতিনির্ভরশীল যে কোনো একটা খাত ধসে পড়লে ধসে যায় গোটা অর্থনীতি। বাংলাদেশের প্রধান দুইটি বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের খাত হলো তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি এবং প্রবাসী কর্মজীবী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্স। এই দু’টি খাতই জোর ধাক্কা খেয়েছে কোভিড মহামারীর সময়ে। তার বিপরীতে চলমান অবকাঠামোগত ও অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা- ঘিরে আমদানির চাকা পূর্ণদ্যোমে সচলই থেকেছে বলা যায়। তাই ডলার না আসলেও যাওয়াটা অব্যাহত থেকেছে পুরোদমে।
একটা কথা আছে, বসে খেলে সাত রাজার ধনও একদিন ফুরিয়ে যায়। অর্থাৎ আয়ের গতি অব্যাহত রাখতে হবে, নয়ত দু’দিন আগে বা পরে বিপদ অনিবার্য। ফলত আমাদের সাম্প্রতিক বৈদেশিক মূদ্রার তহবিল, যা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিদেশি বিনিয়োগের বিবেচনায় যাওয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল, তাও বিপন্ন হয়ে যাচ্ছিল। তার ওপর সরকারি ঋণ ও অর্থনৈতিক তারল্য সংকট এখন যারপরনাই গুরুত্বের দাবিদার হয়ে উঠেছে।
কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ সালে যেখানে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিল ১১,৯৯০ কোটি টাকা ও ৭,০৮০ কোটি টাকা পরিশোধের পর অপরিশোধিত বৈদেশিক ঋণ ছিল ৪,৯১০ কোটি টাকা। সেখানে ২০২১-২২ সালে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১,১২,১৯০ কোটি টাকা ও ১৪,৪৫০ কোটি টাকা পরিশোধের পর অপরিশোধিত বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৭,৭৪০ কোটি টাকা। এটুকু শুনে সবাই চট করে শ্রীলংকার কথা ভাবতে শুরু করবেন জানি। কিন্তু আমাদের সার্বিক প্রেক্ষিত শ্রীলংকার মতো অতখানি বিপদে নিমজ্জিত নয়।
তবে কথা হলো এই যে, বন্যা-ক্ষরা-ফসলের ক্ষতি, মূদ্রা বিনিময় দরের অস্থিতিশীলতা; বিশ্ববাণিজ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন ভিত্তিক যুদ্ধ জনিত বৈরী প্রভাব, বৈশ্বিক খাদ্য ঘাটতির আগাম পূর্বাভাস— এসবকে আমলে নিলে শঙ্কিত হওয়াটাই যৌক্তিক। কিন্তু সেই শঙ্কাকে ভীতির সন্ত্রাস আকারে নয়, আগাম সতর্কতা হিসেবে বিবেচনায় এনে প্রয়োজনীয় কৃচ্ছতা ও পূর্বপ্রস্তুতির জন্য বিবেচনায় নিলে আমরা হয়ত সম্ভাব্য সংকটকালটির পরিপূর্ণ মুখোমুখি হবার আগেই তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারব।
পুরনো একটা প্রবাদ আছে, কিনতে যদি লাভ না করা যায় তো বেচে আর লাভ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অন্য অর্থে বলা যায়, ব্যয় নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে আয় বাড়িয়েও অস্বচ্ছলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব অর্থনীতির সামনের সারির দেশ হবার পথে এগুচ্ছে ঠিক, তবে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে সত্যিকারের স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার মতোই কঠিন হলো সামনের সারিতে পৌঁছার সেই গন্তব্যের নাগাল পাওয়া এবং প্রাপ্তির পর সেই অর্জন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। উন্নয়নের অগ্রযাত্রার পালে হাওয়া লাগলে গতি বাড়বে ঠিক, তবে সেই পালে যদি নিয়ন্ত্রণ ভালো না থাকে তো উলটো বিপদও হতে পারে। অগ্রযাত্রার প্রথম ধাপ আমরা পাড়ি দেয়ার প্রান্তে পৌঁছেছি বলা যায়। এবার কৌশল আর কুশল আয়ত্বাধীন মাত্রায় মকশো করাটা অত্যাবশ্যক। সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ যাত্রা বা অমন খাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেয়ে শতগুণ কার্যকরি ও অত্যাবশ্যক হলো পুকুরচুরির পথ রুদ্ধ করা। সেই শর্তে প্রয়োজন সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের পৃষ্ঠপোষকতা। অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্বকে অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে যত্নে হৃষ্টপুষ্ট করা।
বাজেট প্রাক্কালে কর আরোপই তাই লক্ষ্যের সীমাবদ্ধতা না হোক। সুষম করারোপ প্রসঙ্গে দেশীয় বিনিয়োগকে যথাযথ প্রেরণা দেয়া এবং করের অর্থ যথাযথভাবে বিনিয়োগ ও ব্যয় করার বিষয়টি উচ্চকিত ও দৃশ্যমান করার মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও কর প্রদানে অনুপ্রাণিত করার কাজটি নিশ্চিত করার দায়িত্বটিও পালন করতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
লেখক: কবি ও কথাকার