কৃষি কাজের ওপর নির্ভর করে যে দেশগুলো, তাদের জন্য সময়টা খারাপ যাচ্ছে। বসন্তের আচমকা বৃষ্টি, সেটাও প্রায় ৬০০ শতাংশ বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাড়িঘর ডুবিয়ে দিচ্ছে। মার্কিন কৃষিবিভাগ বলেছে, চাষের কাজ ঠিক সময়মতো শুরু করতে না পারায় গত চার বছরের মধ্যে এবার ভুট্টা আর সয়াবিন উৎপাদন হবে সবচেয়ে কম।
এমনকি বন্যার আগেও খামার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৮ সালে যে কৃষকরা তাদের নিজস্ব খামার থেকে কিছুটা হলেও আয় করতে সক্ষম হয়েছিল, তাদের সংখ্যা মার্কিন মোট কৃষক সমাজের অর্ধেকেরও কম। আর মাঝারি খামারগুলো তো পড়েছিল পুরোই ক্ষতির খাতায়, ওদের আয় নেমে এসেছিল ১৫৫৩ ইউএস ডলারে।
এই একই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের যে আন্তঃসরকারি প্যানেল রয়েছে, তারা বলেছে, গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের যে পরিমাণ, আরো প্রায় এক যুগ লেগে যাবে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে এনে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনতে। আর সেই সাথে রয়েছে বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যৎ বাণী, খরা, বন্যা আর তাপমাত্রা সামনের বছরগুলোতে অতি মাত্রায় বেড়ে যাবে।
গেল বছরের মে মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়, প্রায় দশ লাখের মতো প্রজাতি এখন বিলুপ্তির মুখে। আর এদের মধ্যে রয়েছে পরাগায়নে সাহায্য করা সেসব জীব এবং কীটপতঙ্গ, যারা বার্ষিক বৈশ্বিক ফসলমূল্যে অন্তত ২৩৫ বিলিয়ন থেকে ৫৭৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার যোগ করায় ভূমিকা রেখেছে।
আমেরিকান কৃষিবিদরা মনে করছেন কৃষিকাজের ধরণ ধারনে একটা পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা জরুরি যেটা কার্বন নির্গমন অনেকাংশে কমিয়ে জলবায়ুতে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এবং এই পরিবর্তন শ্রমিকদের কয়লা খনির মতো ক্ষয়িষ্ণু শিল্প থেকে অন্য আরো বড় শিল্প কারখানায় কাজ করার সুযোগ এনে দেবে।
গ্রামীণ আমেরিকাকে ঢেলে সাজানো আর জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া- দু’টোই এই পদ্ধতির অংশ। এজন্য অবশ্য দু’টো জিনিস দরকার, পরিবেশগত ক্ষতি হয় না এমন কৃষিকাজ, আর অর্থনীতিতে এমন এক নীতি যেটা সস্তা খাদ্যদ্রব্যের বাড়তি উৎপাদন বন্ধ করে কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পুনঃনির্ধারণ করে।
খামারগুলোতে জলবায়ু সমস্যার সমাধান
আমেরিকায় যতখানি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হয়, তার শতকরা নয় ভাগ আসে কৃষিক্ষেত্র থেকে। তার কারণটা হলো জমিতে কৃত্রিম সার ব্যবহার আর গবাদি পশুপালন কার্যক্রম। অ্যাগ্রোকোলজি হলো এমন একটা বিজ্ঞান, যেটা বাস্তুবিদ্যার নীতিনিয়ম মেনে একটা টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা পদ্ধতি তৈরির জন্য কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধুমাত্র এই পদ্ধতিতেই গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা অনেকটাই কমানো যেতে পারে।
এ লক্ষ্যে অ্যাগ্রোকোলজি জীবাশ্ম জ্বালানিকে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করছে বিভিন্ন গাছপালা, প্রাণী, ছত্রাক এবং মাটিতে থাকা আরো অনেক কীটপতঙ্গ দিয়ে। পরিবেশের যে পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া, সেটার মতো করেই জীববৈচিত্র্য একই সাথে খাদ্য উৎপাদন এবং নবায়নযোগ্য ইকোসিস্টেম যেমন, মাটির পুষ্টিচক্র এবং কার্বন শোষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মাটির ক্ষয় রোধে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে এবং মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে কৃষকরা শিম, রাই অথবা আলফালফার মতো কিছু ফসল চাষ করে। যখন এই ফসলগুলো মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যায় তখন এগুলো থেকে প্রতিবছর একর প্রতি এক থেকে দেড় টন কার্বন সঞ্চয় করা হয়। ২০১২ সালেও এ ধরনের ফসলের পরিমাণ ছিল ১০.৩ মিলিয়ন একর, যেটা পরবর্তীতে ২০১৭ সালে এসে ১৫.৪ মিলিয়ন একরে দাঁড়িয়েছিল। এর মানে হলো, এইরকম ফসলচাষের পরিমাণ বাড়ছে। তবে এটি পুরো আমেরিকার সমগ্র জমি অর্থাৎ ৯০০ মিলিয়ন একরের একটা ছোট্ট খণ্ডাংশ মাত্র।
এখনকার কৃষিবিভাগ শুধুমাত্র জমির ফসলে আবদ্ধ না থেকে কৃষি বনায়নের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে একই জায়গায় গাছপালা, ফসল আর গবাদি পশুপালন সম্ভব হয়ে উঠেছে। এই পদ্ধতিটি মাটিতে কার্বন সঞ্চয়ের পরিমাণ ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম। আর পশুগুলোকে তাদের নিজস্ব খামার থেকে কৃষি খামারে সরিয়ে নেয়ার ফলে এদের বর্জ্য মাটির সাথে মিশে মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে দিতে পারে আরো অনেকখানি।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ২০১৬ সালের এক গবেষণায় আটটা মেকানিজম চিহ্নিত করেছেন যেটা পুরো মডেলটাকে আরো শক্তিশালী করবে। এর মধ্যে রয়েছে ভোক্তাদের সস্তা খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা, রপ্তানিমুখী বাণিজ্য আর সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হলো বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ। আমেরিকার গ্রামীণ সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করা আর কৃষিক্ষেত্রকে ডিকার্বনাইজ করার জন্য রাজনীতি ও ক্ষমতার সমন্বয় প্রয়োজন। আমাদের বিশ্বাস, পরিবেশ ঠিক রাখে, এমন একটা অর্থনৈতিক নীতি শুরু করতে পারলে, কৃষকদের যে উৎপাদন খরচ, সেই অনুযায়ী তাদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা যাবে।
খামারে অর্থনৈতিক সমতা
সমতার ব্যাপারটা অনেকের কাছেই একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে। এরকম মনে হওয়ার পেছনেও কারণ আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আগে, ১৯১০-১৯১৪ সালে, আমেরিকান কৃষকরা প্রথমবারের মতো এই সমতার সুবিধাটুকু পেয়েছিল। যুদ্ধের সময়টাতে ওদের কৃষিখাতে বেশ উন্নতি হয়েছিল, জমি জল্পনার প্রসার ঘটেছিল এবং অর্থনীতিও বেশ মসৃণ গতিতে চলছিল। কিন্তু যুদ্ধের শেষে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। ফসলের মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ায় কৃষকরা হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও তারা ঋণের দায় থেকে বেরিয়ে আসতে আরো বেশি ফসল উৎপাদনে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল।
প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্টের নতুন চুক্তি অনুযায়ী জনগণ গ্রামীণ সম্প্রদায়গুলোতে বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। আর এর মাধ্যমেই কৃষিক্ষেত্রে আবার সমতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ফেডারেল সরকার পণ্যের নিম্নমূল্য নির্ধারণ করে, এবং উদ্বৃত্ত পণ্য ক্রয় করে সেগুলো রিজার্ভে সংরক্ষণ করে। শুধু তাই নয়, প্রধান শস্যগুলোর উৎপাদন কমানোর জন্য কৃষকদেরকে অর্থও প্রদান করা হয়। এবং সেই সাথে ডাস্ট বাউলের কারণ হিসেবে যেসব ধ্বংসত্মাক চাষাবাদকে দাইয়ি করা হয়, সেগুলো প্রতিরোধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়।
এই নীতিগুলো ঋণগ্রস্ত কৃষকদের স্বস্তি এনে দেয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩, এই সময়টাকে চিহ্নিত করা হয় ‘সমতা বছর’ নামে। এই সময়ে পণ্যের নিুমূল্য ধার্য্য করা হয়েছিল ৯০ শতাংশ। এবং কৃষকরা সেবার শতভাগ দাম পেয়েছিল। অর্থাৎ ক্রেতারা আসল উৎপাদন খরচেই পণ্য ক্রয় করেছিল।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কিছু ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থে খুব সাবধানে কৃষি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনার কাঠামোটি ভেঙে দেয়। এদের মধ্যে আছে বৈশ্বিক শস্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর্চার ড্যানিয়েলস মিডল্যান্ড এবং আমেরিকান ফার্ম ব্যুরো ফেডারেশন, এরা মূলত বড় বড় কৃষিখামারগুলোকে সেবা প্রদান করে থাকে।
আর্ল বাটজ, ১৯৭১ – ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত যিনি কৃষি সচিব ছিলেন, এবং তার মতো আরো কিছু ফেডারেল কর্মকর্তাদের সমর্থন পেয়েছিল এই সংস্থাগুলো। বাটজ মুক্তবাজারে বিশ্বাস করতেন। এবং ফেডারেল নীতিকে তিনি সংকুচিত করার পরিবর্তে আউটপুট বাড়ানোর একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখতেন। তার তত্ত্বাবধানে পণ্যের দাম কমতে দেয়া হয়েছিল, যেটা লুফে নিয়েছিল কর্পোরেট ক্রেতারা। কিন্তু সেইসাথে আবার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেয়ার জন্য ফেডারেল পেমেন্টের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
এই অর্থনৈতিক মডেল পরবর্তী কয়েক দশকে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এমন এক বৈশ্বিক খাদ্যব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, যেটা কৃষক, ভক্ষক এবং পৃথিবী, কোনোটার জন্যই টেকসই বলে প্রমাণিত হয় নি।
কৃষিতে নতুন দিগন্ত
কৃষিক্ষেত্রে সমতা বজায় রাখা এবং কর্পোরেট ক্ষমতা কমিয়ে আনার ব্যাপারটা আমেরিকা আবারো নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ২০২০ সালের বেশ কিছু ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা এটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে আইনের আওতাভুক্ত করেছেন। চিন্তাবিদরা পারিবারিক খামারগুলোকে আরো শক্তিশালী করার কথা ভাবছেন। উইকিনসন ফার্ম ব্যুরো ফাউন্ডেশনের ডেইরি ডেলিগেটরা পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনার জন্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভোট দিয়েছেন।
এই ব্যাপারে কংগ্রেসের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে, কৃষিক্ষেত্রে ন্যায্য রূপান্তরের জন্য প্রস্তাবিত গ্রিন নিউ ডিল-টাই গ্রহণ করা হোক। বর্ণবৈষম্যের কারণে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় সুবিধাবঞ্চিত অন্যান্য কৃষকদের জন্য এটাকে সম্পদ পুনরুদ্ধারের একটা সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মধ্যপশ্চিমে হয়ে যাওয়া এই বছরের বন্যাগুলো কৃষিকাজকে খুব চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। তবে সবকিছুর পরেও আমরা আশাবাদী, নতুন চুক্তির যে ধারণাগুলো, সেগুলোকে যদি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তার বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে অচিরেই আমরা প্রকৃতিবান্ধব এবং সামাজিকভাবে সমতাপূর্ণ একটা মার্কিন কৃষিক্ষেত্র পেতে যাচ্ছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ