মূল: এডগার অ্যালান পো
অনুবাদ:
সুলতানা পারভীন শিমুল
সত্যি! আমি নার্ভাস ছিলাম। বেশ ভালো রকম নার্ভাস ছিলাম। এখনো ঠিক তাই আছি। তাই বলে কি তোমরা আমাকে পাগল বলতে পারো? ঘটনাটা আমার ইন্দ্রিয়কে সূক্ষ্ম করেছে, ভয়াবহ রকম তীক্ষè করেছে। বিশেষ করে কর্ণকুহর। আমি এখন সব শুনতে পাই। এই পৃথিবীর সমস্ত শব্দ, স্বর্গে কী ঘটছে, তার শব্দ, এমন কি নরকের কিছু তীব্র আর্তনাদও আমি শুনতে পাই। তাহলে, আমি পাগল কোন দিক থেকে? এখন শোন, আর দেখ আমি কি শান্তভাবেই না পুরো গল্পটা তোমাদেরকে বলি…
ঠিক কখন আইডিয়াটা আমার মাথায় ঢুকেছিল এখন আর মনে নেই। এটুকু বলতে পারি, মাথায় ঢোকার পর থেকে চিন্তাটা আমাকে দিন রাত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। বুড়ো লোকটাকে আমি ভালোই বাসতাম। লোকটা আমার সাথে কখনো খারাপ আচরণ করে নি। অপমান করে নি। তার টাকাপয়সা, সোনাদানার প্রতিও আমার লোভ ছিল না। তাহলে কেন? আমার ধারণা, লোকটার চোখ। হ্যাঁ। ফ্যাকাশে নীল এক জোড়া চোখ, ঠিক যেন শকুনের চোখ। যখনই তার দৃষ্টি আমার ওপর পড়ত, আমার রক্ত হিম হয়ে যেত। ভয়ংকর অনুভূতি। তখন থেকেই খুব সম্ভব ভাবনাটা ঢুকেছে। মুক্তি পেতে হবে। আমাকে এই দৃষ্টি থেকে মুক্তি পেতেই হবে। আর তার জন্য মরতে হবে বুড়োটাকে।
এখনো কি আমাকে পাগল মনে হচ্ছে? আরেহ্, পাগল তো তারা, যারা উল্টাপাল্টা কাজ করে। আর আমার কাজগুলো দেখ, কি সুক্ষ্মভাবেই না এগিয়েছি আমি, ধীরে ধীরে, অনেক সময় নিয়ে, সতর্ক পায়ে…
লোকটাকে মেরে ফেলার আগের সপ্তাহটাতে আমি তার সাথে সবচেয়ে বেশি সদয় আচরণ করেছি। প্রতি রাতেই, মানে ঠিক মাঝরাতে, আস্তে করে বুড়োর ঘরের দরজার নব ধরে টানতাম, তারচেয়েও নিঃশব্দে দরজাটা খুলতাম, হাতের লন্ঠন প্রায় আলোবিহীন, বিন্দু পরিমাণ আলোও যেন বিচ্ছুরিত না হয়। তারপর দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিতাম। খুব আস্তে কাজটা সারতাম, যেন বুড়োর ঘুম না ভাঙ্গে। ধীরে ধীরে চুপিসারে তার ঘুমন্ত মুখটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম। এত সতর্ক ভাবে কাজটা করতাম যে পাক্কা এক ঘন্টা লেগে যেত এইটুকু করতেই। তারপর লন্ঠনটা জ্বালাতাম। এত সাবধানে, যেন শুধুমাত্র ক্ষীণ একটা আলোকরশ্মি লোক্টার চোখ দুটোর ওপর পড়ে। কোনো পাগল কি এত সতর্কভাবে কাজ করতে পারে, বলো?
এই কাজটা আমি করেছি পরপর সাত রাত ধরে। একই সময়ে, ঠিক মাঝরাতে। কিন্তু প্রতি রাতেই একই কাহিনী। চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে লোকটা। ভয়ংকর সেই চোখই যদি দেখতে না পাই তাহলে কাজটা করি কিভাবে? বুড়োটার ওপর তো কোনো রাগ নেই আমার। যত রাগ, ওই শকুনি চোখের ওপর। তারপর প্রতি সকালে তার ঘরে গিয়ে খুব আন্তরিকতায় বিভিন্ন বিষয়ে গল্পগুজব করতাম। রাতে ঘুম কেমন হয়েছে, ভালো না মন্দ, জিজ্ঞেস করতাম। উত্তর শুনেই বুঝতাম, লোকটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না যে মাঝরাতে কেউ ঘুমন্ত তার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকে।
অষ্টম রাতে তার ঘরে ঢোকার সময় আমি অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি সতর্ক ছিলাম। আরো ধীরে। ঘড়ির মিনিটের কাঁটাও যেন আমার চেয়ে দ্রুত ঘুরছিল। পুরো বিষয়টা এত নিঃশব্দে করতে পারায় বেশ তৃপ্ত বোধ করলাম। নিজে নিজেই হাসলাম। অমনি নড়ে উঠলো বুড়োটা। শুনতে পেল নাকি! ঘরের ভেতর নিকষ কালো গভীর অন্ধকার। খুব, খুব ধীরে দরজাটা চাপিয়ে দিলাম আবার। আলতো করে লন্ঠনের আলোটা একটু বাড়াতে গিয়ে হালকা একটু শব্দ হয়েছে কি হয় নি, বুড়োটা লাফ দিয়ে উঠে বসল বিছানায়। চিৎকার করে উঠল, ‘কে? কে ওখানে?’
আমি নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকলাম। কেটে গেল এভাবেই ঘন্টাখানেক। এই পুরো সময়টার মধ্যে বুড়োটার শুয়ে পড়ারও কোনো শব্দ পেলাম না। মিনিটের পর মিনিট কেটে গেল। হঠাৎ হালকা একটা শব্দ পেলাম। শব্দটা যেন হলো আমার মাথার ভেতরে। ভীত চাপা আর্তনাদের মত। প্রচ- ভয় পেলে মানুষ এরকম করে। লোকটার জন্য মায়া লাগল। করুণা হলো। আবার অন্যদিকে খুশিও লাগছিল। প্রথম খুট্ শব্দটা শোনার পর থেকেই লোকটা ভয় পাচ্ছে, জানি আমি।
সেই ভয় উত্তোরত্তর বেড়েই চলেছে। আর সেটা আমি টের পাচ্ছি নিজের মাথার ভেতর। লোকটা নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করছে যেন, ‘কিছু না, চিমনির ভেতরে বাতাসের শব্দ হয়ত। অথবা ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে উঠেছিল। নয়ত কোনো ইঁদুরের কাজ।‘ কিন্তু কোনোটাই তার নিজেরই মনে ধরছে না। ভীত, ভীষণ ভীত সে।
লম্বা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম। অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। ঠিক তখনই সিদ্ধান্তটা নিলাম। লন্ঠনের আলো ধীরে, খুব ধীরে অতি সামান্য একটু বাড়ালাম। মাকড়সার জালের সুতার মত চিকন এক ফালি আলো বুড়োটার আতংকিত চোখে পড়ল। এই তো! খোলা চোখ! ঠিক যেন শকুনের! ভেতরে রাগ ফুঁসে উঠলো যেন আমার! সবকিছু অন্ধকারে। নাক, মুখ, কপাল, কিচ্ছু আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। সহজাত প্রবৃত্তিবশেই কি না কে জানে, আলো ফেলেছি শুধু মাত্র চোখে। জ্বলজ্বল করছে ভীষণভাবে। রক্তের ভেতর তুমুল উম্মাদনা অনুভব করছি।
আমার ব্যাপারটা পাগলামি তো কোনোভাবেই না, বরং বোধের তীব্রতা বলা যায় এটাকে। কেন? বলছি, শোনো… আমি সেই মুহুর্তে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। টিক টিক করা ঘড়িকে যদি তুলো বা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়, তাহলে যেরকম হয়, ঠিক সেরকম চাপা একটা শব্দ। আন্দাজ করতে পারো, কিসের শব্দটা? ওই বুড়োটার হার্টবিট। আস্তে আস্তে ওটা বাড়ছে। আর সেই তালে তালে বাড়ছে আমার অস্থিরতা।
তবু আমি শান্ত থাকলাম। নিঃশ্বাস প্রায় আটকে। হাতে ধরে থাকা লন্ঠন যেন মুর্তির মতো স্থির। টের পাচ্ছি, মাথার ভেতরে হার্টবিট ক্রমশ দ্রুততর হচ্ছে। বাড়ছে শব্দের মাত্রা। বলেছিলাম না, আমি নার্ভাস? তখনো তাই ছিলাম। নাহ্, বুড়োটা ভীষণ ভয় পেয়েছে। শব্দের মাত্রা বাড়তে বাড়তে এমন হলো, মনে হচ্ছে কখন যেন বুড়োটার হার্ট বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। নতুন একটা ভয় পেয়ে বসল হুট করে। যত জোরে শব্দটা হচ্ছে, মনে হচ্ছে দেয়াল ভেদ করে প্রতিবেশীর কানে পড়া অসম্ভব কিছুই না। নাহ! আর দেরি করা ঠিক হবে না।
লন্ঠনের আলো পুরোটা বাড়িয়ে দিলাম। হুংকার দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম বসে থাকা লোকটার ওপর। টেনে নামিয়ে আনলাম বিছানা থেকে মেঝের ওপর। একটা মাত্র তীক্ষè চিৎকার করতে পারল লোকটা। দ্রুত হাতে বালিশ টেনে চেপে ধরলাম আতংকিত মুখটার ওপর। বুড়ো শরীরটা কাটা গরুর মতো মোচড়াতে থাকল আমার হাতের নিচে। সবটুকু শক্তি দিয়ে চেপে ধরেই থাকলাম। অনেকক্ষণ। কাজটা প্রায় শেষ হলো। হাসি ফুটল আমার মুখে। হার্টবিট এখনো শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অনেকটাই স্তিমিত। কিছুক্ষন পর থেমে গেল ওটাও। বালিশ সরালাম। অবশেষে! মরে গেছে!! আরো কিছুক্ষণ পর পরীক্ষা করে দেখলাম। বুকের ওপর মাথা রাখলাম। কোনো ধুকপুকানি নেই। চোখ স্থির। বন্ধ করে দিলাম ও দু’টো। যাক, এগুলো আর কখনো বিরক্ত করবে না আমাকে। শান্তিহ্!
এখনো পাগল মনে হচ্ছে আমাকে? তাহলে বাকিটা শোন। মৃত শরীরটা লুকিয়ে ফেলতে আমি কী কী করেছি, সেটা শুনলেই তোমার আর এরকম মনে হবে না।
রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। নিঃশব্দে দ্রুত হাত চালালাম। প্রথমেই মাথাটা আলাদা করে ফেললাম কুড়ালের এক কোপে। তারপর হাত দুটো। তারপর পা। তারপর বস্তায় পুরে ফেললাম। মেঝের তিনটে টাইলস তুলে, একটু খুঁড়ে বস্তাটা দিলাম ঠেসে। তারপর টাইলসগুলো সুন্দর করে বসিয়ে দিয়ে তার ওপর আগের মতই কার্পেট বিছিয়ে দিলাম। তার আগে রক্তের যা ছিঁটেফোঁটা, সব পরিষ্কার করে মুছে নিয়েছি। বিছানা ঠিকঠাক করে দিলাম। ব্যস। কোথাও কোনো অসামঞ্জস্যতা নেই। এত সুন্দর করে সবটা করেছি যে, কারো সাধ্য নেই কোনো সন্দেহ জাগে মনে। কলার ঝাঁকালাম নিজের।
সব কাজ শেষ হলো যখন, তখন প্রায় চারটা বেজে গেছে। তখনো রাত যথেষ্ট গভীর। বেল বাজাল কেউ দরজায়। এত রাতে! কে হতে পারে? নিচে নেমে গেলাম লঘু পায়ে। যে-ই হোক। আমার ভয়ের তো কিছু নেই। হাসিমুখে দরজা খুলে দিলাম। তিনজন। পরিচয় দিল। পুলিশ। প্রতিবেশীদের কেউ একটা চিৎকার শুনেছে। এবং সন্দেহবশত পুলিশে ইনফর্ম করে দিয়েছে।
হাত নেড়ে আত্মবিশ্বাসী হাসি হাসলাম আমি। দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠেছিলাম। জানালাম ওদেরকে। আর বাড়ির মালিক, উনি আপাতত দেশের বাইরে আছেন। সন্দেহ দূর করতে তাদেরকে নিয়ে পুরো বাড়ির আনাচে কানাচে দেখিয়ে দিলাম। সার্চ করতে দিলাম নির্ভয়ে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমি ওদেরকে বসতে দিলাম সেই ঘরেই, যেখানে লাশটা লুকিয়েছি আমি। আমার চেয়ারটা রাখলাম ঠিক ওই তিনটে টাইলসের ওপরে।
অফিসার কয়েকজনকেই সন্তুষ্ট মনে হলো। আমার আচরণে সন্দেহের কিছুই পায় নি তারা। আমার সাথে কিছুক্ষন গল্প করতে করতে নিজেদের মধ্যেই মেতে উঠল ওরা। একটু পর মাথাব্যথা শুরু হলো আমার। প্রাণপণে চাইছি ওরা চলে যাক। মাথার ভেতর কিছু যেন বাজতে শুরু করল। অনুভূতিটা ঝেড়ে ফেলতে বেশ জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করলাম। এবং দ্রুতলয়ে। টের পাচ্ছি আমাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। মাথার ভেতরে সেই শব্দ। টিকটিক ঘড়িকে কাপড়ে মুড়িয়ে রাখলে যেমন চাপা শব্দ হয়। অক্সিজেনের অভাব বোধ করলাম।
এরা উঠছে না কেন এখনো? মাথার ভেতরে শব্দটা বাড়ছে। উঠে দাঁড়ালাম। ওদের ছোটখাট কথাতেই মেজাজ খারাপ হচ্ছে এখন। উঁচু গলায় কথা বলছি এখন ওদের সাথে। মাথার ভেতরে শব্দ বাড়ছে। ধুকপুক। ধুকপুক। ধুকপুক। বাড়ছে বাড়ছে। ধুর! লোকগুলো এখনো গল্প করেই যাচ্ছে কেন? হাসছেও।
আচ্ছা, ওরা কি শব্দটা শুনতে পাচ্ছে না? গড! না না! তা কি করে হয়? এত জোরে! ওরা নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছে! সন্দেহও করছে নিশ্চয়ই! ওরা জেনে গেছে! আমি নিশ্চিত। আমার ভয় দেখে ওরা মজা পাচ্ছে! কি যে সব ভাবছি! উফ! ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর। সহ্য করতে পারছি না। ধুকপুক। ধুকপুক। ধুকপুক। লোকগুলোর হাসি অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে চিৎকার করতে না পারলে মরেই যাব। উফ! ড্যাম! বাড়ছে! বাড়ছেই শব্দটা। নাহ!
আর পারছি না! ওদের একজন আমার দিকে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এখান থেকে। এখান থেকেই আসছে শব্দটা!’ চেয়ার লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম। কার্পেট এক টানে সরিয়ে দিলাম। টাইলস সরাচ্ছি। আর চিৎকার করছি, ‘এখানে, এখানেই আছে সে, দেখো, এখানেই!’
টাইলস সরিয়ে পাগলের মত মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম আমি…