এক দেশের বুলি আরেক দেশের গালি। কারো থামি, কারো লুঙ্গি, কারো কাবুলি, কারো ধুতি, কারো টারটান-কিল্ট, কারো ট্রাউজার-স্কার্ট, কারো শাড়ি, কারো ঘাগড়া কি লেহেঙ্গা। কোনো দেশ বুঝতে মরুভ‚মি, কোনো দেশে পাহাড়, কোনো দেশে পিরামিড, কোনো দেশে দুর্ভেদ্য জঙ্গল, কোথাও শিরা-উপশিরার মতো অগণিত নদী। কারো খাবার দোসা ইডলি, কারো রুটি, কারো নুডুলস-স্পেগেটি, কারো পাস্তা, কারো ভাত-মাছ। পৃথিবী জুড়ে মানুষে মানুষে ভাষা, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, অতীত-ইতিহাস-ঐতিহ্য হরেক রকম। এইসব নানাবিধ জীবন বৈচিত্রের পেছনে প্রধান কারণ সম্ভবত ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, ফসলের ধরন, জনপদের অতীত ইতিহাস। এসব ঘিরে নানা দেশে নানা জাতিতে রকম-ধরনের যে নানান হেরফের এটাই তার নিজ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গড়ে দেয়। এইসব সকল দেশে মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলেও, কমবেশি সকল ধর্মের মানুষ বসবাস করলেও; কৃষ্টি-সংস্কৃতির যে পার্থক্য তা মূলত ভৌগলিক ও জলবায়ু বৈচিত্র ঘিরেই আবর্তিত।
পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে মায়ের ভাষায় কথা বলবার তৃপ্তিটুকুর মতোই স্বস্তি পায় মানুষ তার আপন ঐতিহ্যের পোশাকে, খাবারে, জীবনাচারে। অদৃশ্য যে সুতায় এই পরিচয় বৈচিত্রের নিজস্বতা আপন ভিন্নতায় কোনো জাতি-গোষ্ঠীকে অনন্য স্বকীয়তায় পৃথক অস্তিত্বে পৃথক বৈশিষ্ট্যে সুনির্দিষ্ট করে সেটাই তার কৃষ্টি-সংস্কৃতির পরিচয় চিহ্ন বা স্বাতর্ন্ত্য বাহক। এই শিকড়ে এসে ধর্ম-বর্ণ সকলই গৌণ হয়ে ওঠে। প্রখর হয় শুধু প্রজন্মান্তরের ঐতিহ্যময় অতীত, আপন কৃষ্টি।
বাংলার সেই অতীত-ঐতিহ্য আপন কৃষ্টি গড়ে উঠেছে শস্য-শ্যামলা নদীবিধৌত জনপদে বাস করা করা মানুষদের মাছে ভাতে তৃপ্তির আহারে, উদাস-আলস্যের বিভায়, আবেগ-ভালোবাসার কোমলপ্রাণ চরিতে এবং প্রয়োজনে রুখে দাঁড়াবার দুর্নিবার সাহস ও অকুতোভয় সৌকর্যে। বৈশ্বিকতার যুগেও তাই কোথাও বিভিন্ন দেশের মানুষ একসাথে হলে সহজেই সকলে পৃথক ও স্বকীয় পরিচয়ে চিহ্নিত হবে জীবনিযাত্রার দৈনন্দিনতা ঘিরে তার নানা আচার-ব্যবহার বৈচিত্র্যেও প্রকাশ ভিন্নতায়।
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের একটা তেষ্টা বোধকরি রক্তের গভীরে জাগরুক থাকবে পৃথিবীরে যে প্রান্তেই একজন বাঙালিকে থাকতে হোক। এই অন্তর্গত টানটিই মাটির টান টান, শিকড়ের টান। জনে জনে এই অনুভূতি প্রকাশের ধরণে ভিন্নতা থাকতে পারে মাত্রাভেদ থাকতে পারে কিন্তু মধ্যাকর্ষণের মতোই অমোঘ নিশ্চিত তার অবস্থান।
সেই কৃষ্টি-সংস্কৃতি কি আপনা-আপনিই গড়ে ওঠে আর টিকে থাকে? গড়বার পেছনেও মানুষের অনবধান সক্রিয়তা যেমন থাকে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এর চেয়েও সু¯পষ্ট একটা প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকতে হয়। নির্বোধ উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা অনুকরণপ্রিয়তা ততক্ষণই প্রখর হয় যতক্ষণ জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় একটি মানুষ পশ্চাৎপদ হয়। এদেশে সব মানুষ সেই মাত্রায় শিক্ষা ও প্রজ্ঞা ধারণ করে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই হয়ত না। আবার অশিক্ষিত একজন মানুষের দেশপ্রেমও প্রশ্নাতীতভাবে ঊর্ধ্বে থাকতে পারে একজন শিক্ষিতের চেয়ে। এখানেই বিচার্য প্রকৃত শিক্ষার প্রসঙ্গটি। হ্যাঁ, তাই। কেননা পুঁথিগত শিক্ষাই সকল শিক্ষা নয়। জন্মের পর থেকে আমাদের বেড়ে ওঠায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে জীবনাচারে চর্চিত শিক্ষাটুকু অধিকতর ক্রিয়াশীল ও প্রভাব বিস্তারকারী। সেজন্যই প্রশ্নাতীত নজির গড়ে আপামর মানুষ জেগে উঠেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে, আপন অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষায় অকুতোভয় দুর্দমনীয় হয়েছে বায়ান্নে, একাত্তরে, নব্বুইয়ে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন গোটা জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম অর্জন। সেই অর্জনে জনযুদ্ধের অংশীদার সিংহভাগ বাঙালি, মুষ্টিমেয় কিছু অবিবেচক, সুযোগসন্ধানী, বিশ্বাসঘাতক ছাড়া সকলেই মুক্তিযুদ্ধের অংশ হয়েছিল প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে। এই অমোঘ আপামর অংশগ্রহণের যে ইতিহাস আমরা নির্মাণ করেছি, তা আমাদের গৌরবের ও স্পর্ধার অর্জন। গোটা পৃথিবীর কাছে স্বকীয় ঔজ্জ্বল্যে পরিচিত হবার মন্ত্র বা চাবিকাঠি। যা কোনো অলৌকিক মন্ত্রে বা জাদুর চাবিতে ঘটে যায় নি। অমন জাতীয় গৌরবময় পরিচয়ের পেছনের সূত্রটি আমাদের জাতীয়তাবোধ। আর সেটারই অবিচ্ছেদ্য এক অংশ আমাদের পহেলা বৈশাখ।
ফসলের উপর কর আদায়ের সুবিধায় বাংলা সনের প্রবর্তন আমাদের শিকড়ের প্রয়োজনের তাগিদ থেকে সৃষ্ট। সেই রীতিতে ফসলী উৎসব, বছর শেষে লেনাদেনা চুকাবার রীতি, হালখাতা খুলবার উৎসব এসবের পাশাপাশি অনুচ্চারিত সত্যটি হলো আমাদের কৃষ্টির অতীত ও ইতিহাস নির্মিত হবার দীর্ঘ পথপরিক্রমণের গাঁথা। সেখানে দিনে দিনে যুক্ত হয়েছে আরো আরো ঘটনা ও ইতিহাসের সোপান।
মায়ের ভাষায় কথা বলবার দাবি নিয়ে বায়ান্নের রক্ত দেয়া বাঙালিকে রুখে দিতে নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বারে বারে নেমে এসেছে নানান চক্রান্তের কালো হাত, স্বৈরাচারের থাবা। সেখানে আমাদের রুখে দাঁড়াবার প্রেরণা হয়েছে আমাদের কৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও অনুচ্চারিত অঙ্গীকার।
বাংলা গানকে রুখে দিতে পারলে ঐতিহ্যের শিকড় কাটা যায়। এজন্যেই আইয়ুব শাহী বা ইয়াহিয়ার কালো হাত নখর বসাতে চেয়েছে আমাদের কৃষ্টি বিনাশের ইচ্ছায়। বাঙালি শান্ত সৌম্য প্রতিবাদে মুখর হয়েছে রমনা বটমূলে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সংগীতের মূর্ছনায় বর্ষবরণ সেই থেকে শুধু নতুন বছর উদযাপনের রীতি ছাড়িয়ে মিশে গেছে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে বলীয়ান হবার প্রক্রিয়ায়। ফের নব্বুইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় স্বৈরশাসকের থাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পথে নেমেছিল মঙ্গল শোভাযাত্রার উৎসবমুখর জনস্রোত।
পাতার বাঁশি, শিশুদের অ্যারোপ্লেন ঢোল-ডুগডুগি, পুতুলনাচ আর সাপ-বানর-লাঠিখেলার বৈশাখী মেলা আর পিঠাপুলির সাথে দিনে দিনে যেমন মিশেছে ইলিশ-পান্তার সংস্কৃতি তেমনি এর অন্য পিঠে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সাথে মিশে গেছে আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রামী ইতিহাস। সকল মিলেমিশে দিনে দিনে অস্তিত্বের বন্ধনে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে আমাদের বৈশাখ উদযাপনের সংস্কৃতি। আজ তাই এটা সুদূর অতীতের চেয়ে আরো বেশি বহুমুখী অর্থবহ, আরো অধিক উদযাপনের হেতু।
সেইসাথে এই উদযাপন নীরব উচ্চারণে দাবি জানায় প্রখর করে একে ঘিরে আমাদের আরো সুচিন্তিত ও বিস্তৃত উদযাপন পরিকল্পনার, যা আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবেও স্বীকৃত। কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের দাবিটুকুর পাশাপাশি এই উদযাপন আজ জোর দাবি রাখে আমাদের মেধা-মনন ও শিল্পচেতনার প্রতিফলন ঘটাবার সম্যক আনুষ্ঠানিক পরিকল্পনা ও যত্নের। এই উদযাপন যে আজ বাঙালির নিজস্ব আঙিনা ডিঙ্গিয়ে বৈশ্বিক সীমানায় উপস্থিত। আর সেই সুচিন্তিত ও বিস্তৃত উদযাপন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এর মূল্যায়ন প্রেক্ষিতকেও আরো বেশি বটবৃক্ষ করে তুলবে নিঃসন্দেহে। বর্তমান সময়ে আমাদের দায় তাই অতীত সময়ের চেয়ে জোরালো ও অধিক। সঠিক চিন্তা ও চেষ্টায় অধিকতর গ্রহণযোগ্যতায় আগামীতে এই দিন ও এর উদযাপন নিশ্চয়ই হয়ে উঠবে আরো আরো অধিকতর বৈশ্বিক। এমন অর্জন-স্বীকৃতির মাপকাঠিটি আপেক্ষিক, তবে সন্দেহাতীতভাবে উদ্যোগ-প্রচেষ্টার সমানুপাতিক।
লেখক: কবি ও কথাকার।