শিল্পের ইতিহাসে ‘চলচ্চিত্র শিল্প’ একটি নবীন শাখা হলেও ‘অভিনয় শিল্প’র ইতিহাস বহু পুরনো। তবে ধারণা করা হয়, ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম প্যারিসে চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় মোট দশটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেন। শিল্পের অন্যান্য শাখার তুলনায় খুব দ্রুততম সময়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে চলচ্চিত্র শিল্প। চলচ্চিত্র তথা ‘চলমান চিত্র’ (মোশন পিকচার) যেহেতু দৃশ্যমান বিনোদনধর্মী শিল্পমাধ্যম। সেহেতু এর প্রচার ও প্রসার হয়েছে তড়িৎ গতিতে। চলচ্চিত্র শিল্পের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে চেতনাগত পরিবর্তনও দুর্লক্ষ্য নয়। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে সবার প্রিয়। এমনকি সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে সহজলভ্য বিনোদন মাধ্যম। যদিও বর্তমানে চলচ্চিত্রের মধ্যেও এসেছে নানান বৈচিত্র্য। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র শব্দটিও পেয়েছে নানা অভিধা। যেমন- ‘বই’, ‘সিনেমা’, ‘মুভি’, কিংবা ‘ফিল্ম’।
১৯৪৭ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাস বিবেচনা করা হয়। ’৪৭ পরবর্তী পূর্বপাকিস্তান এবং তৎপরবর্তী রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক স্বাধীন বাংলাদেশের যে শিল্পচর্চার প্রবাহ বর্তমান। সংক্ষেপে এটাই বাংলাদেশের শিল্পের ইতিহাস। ফলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে ’৪৭ উত্তরকালের চলচ্চিত্রকে নির্দেশ করা হয়। ১৯২৭ সালে বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ‘সুকুমারী’ নামের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্রটি নির্মাণের নেপথ্যে ঢাকার নবাব পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। তবে পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক চলচ্চিত্র হিসেবে প্রথম মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র ‘ দ্য লাস্ট কিস্’ (১৯৩১)। এভাবেই মূলত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পের যাত্রা। বর্তমান লেখার অন্বিষ্ট বিষয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ধারার পরম্পরা এবং অভিযাত্রার অঙ্গীকার।
একথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গকে টিকে থাকার জন্যে পুনরায় লড়াই-সংগ্রামে নামতে হয়। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে এদেশের মানুষ ক্রমশ সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রক্তঝরাতে হয়েছে। মূলত এই লড়াই-সংগ্রামের আবর্তে পড়ে শিল্পচর্চার ক্ষেত্রটি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটকসহ অন্যান্য শাখায় এই দ্রোহী চেতনার স্ফুরণ দেখা যায়। তবে শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো পরিবেশ, সামর্থ কিংবা দক্ষতা এখানে তখনো গড়ে ওঠে নি। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭, এই সময় পরিধির মধ্যে পূর্ববঙ্গে সবাক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিতি পায় নি। যদিও চলচ্চিত্রঘনিষ্ঠ নানা কর্মকাণ্ড অব্যাহত ছিল।
চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমানের সহোদর নাজীর আহমদের নাম এক্ষত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯৪৮ সালে ‘ইন আওয়ার মিডস্ট’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। বাংলাদেশ থেকে নির্মিত প্রথম তথ্যচিত্র হিসেবে এটির ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। শুধু তাই নয়, ১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের পূর্ববঙ্গে প্রথম ‘ফিল্ম ল্যাবরেটরি’ তথা স্টুডিও স্থাপিত হয়।
ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত সময়কে বাংলা চলচ্চিত্রের ‘সোনালি যুগ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম মুক্তি পায় ‘মুখ ও মুখোশ’। ছবির পরিচালক ছিলেন আব্দুল জব্বার খান। এটি সবাক চলচ্চিত্র হওয়ায় সেসময় আলোড়ন তৈরি হয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। চলচ্চিত্রনির্মাণে ক্রমশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন অনেকে। নাজীর আহমদের কাহিনী অবলম্বনে প্রখ্যাত পরিচালক ফতেহ লোহানী নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘আসিয়া’ (১৯৬০)। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল সরকারিভাবে অনুমোদিত ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ (ইপিএফডিসি) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ সুগম হয়। ইপিএফডিসি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫৯ সালে ফতেহ লোহানীর নির্মাণ করেন ‘আকাশ আর মাটি’, মহিউদ্দিন নির্মাণ করেন ‘মাটির পাহাড়’। পরিচালক এহতেশাম নির্মাণ করেন আপাতপ্রতিবাদী চলচ্চিত্র ‘এদেশ তোমার আমার’। একই বছর আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দু চলচ্চিত্র ‘জাগা হুয়া সাভেরা’ বেশ প্রশংসিত হয়। এটি প্রখ্যাত কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের কাহিনী কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র।
ষাটের দশকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হয়েছেন কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্রকার। যাঁরা নিজেদের উদ্ভাবনী দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে দিয়েছেন উচ্চাসন। জহির রায়হান একাধারে একজন গল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১)। তবে ১৯৬৪ সালে তাঁর নির্মিত ‘কাঁচের দেয়াল’ চলচ্চিত্রটি ‘নিগার পুরস্কার’ লাভ করে। তাঁর নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্র- ‘বেহুলা’, ‘সঙ্গম’, ‘আনোয়ারা’ এবং ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৭১ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রামাণ্যচিত্রটি জহির রায়হানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র ফুটে উঠেছে।
এসময় পরিচালক হিসেবে আবির্ভূত হন খান আতাউর রহমান। চলচ্চিত্রে তিনি এক বহুমাত্রিক প্রতিভা। যথাক্রমে একজন পরিচালক, অভিনেতা, কাহিনীকার, কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার। তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্রের নাম ‘অনেক দিনের চেনা’ (১৯৬৩)। তবে তাঁর নির্মিত আলোচিত এবং প্রশংসিত চলচ্চিত্রের নাম ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ (১৯৬৭)। ঐতিহাসিক চরিত্র, বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রটি দেশে ও বিদেশে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ‘বাংলাদেশ’। পাকিস্তান থেকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে শুরু হয় নতুন স্বপ্নময় পথচলা। শিল্পসাহিত্যে দেখা দেয় আবেগের নবজোয়ার। কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটকের ন্যায় শুরু হয় নতুন নতুন চলচ্চিত্র নির্মাণ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে গুরুত্বপূর্ণ একটি ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। নন্দিত পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের নির্দেশনায় নির্মিত ছবিটি সমসময়ে বেশ সাড়া ফেলে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে তিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মনের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই ছবি সমকালে অন্যান্য নির্মাতাদের বেশ প্রণোদিত করেছে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় অসংখ্য বাংলা চলচ্চিত্র। ফলে স্বাভাবিকভাবে ‘মুক্তিযুদ্ধনির্ভর চলচ্চিত্র’ শিরোনামে চলচ্চিত্রের একটি ধারা এখনো প্রবহমান। ফলে ২০১৯ সালে এসেও আমরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হতে দেখি। খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের চিত্রকর্ম ‘নারী’ এবং কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধশিশু’ কবিতা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘মায়া দ্য লস্ট মাদার’। পরিচালক মাসুদ পথিকের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ছবিটি দর্শকমহলে প্রশংসিত হয়।
’৭১ পরবর্তী সদ্যস্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক ছবিগুলো বিশেষভাবে নজরে আসে। এসব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা যেমন আছে, তেমনই আছে এদেশীয় নানাসংকট। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের তালিকা অনেক দীর্ঘ। তবুও বিশেষ কিছু চলচ্চিত্রের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন- চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২), ‘সংগ্রাম’, (১৯৭৪) এবং ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ (১৯৯৭)। নাসির উদ্দীন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, (১৯৯৩) হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪)। তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতি’ (১৯৯৫)। খান আতাউর রহমানের ‘এখনো অনেক রাত’ (১৯৯৭)। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ (২০০২)। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘¯পার্টাকাস’৭১, (২০০৭)। মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১)।
চলচ্চিত্রে মানবজীবনের বহুবর্ণিল বিষয় দৃশ্যরূপ লাভ করে। ব্যক্তিমানুষের অনুভূতিজাত ব্যাপার তো আছেই, পাশাপাশি যাপিত জীবনের ঘটনাচিত্র উপস্থাপিত হয় অভিনয় দক্ষতার ভেতর দিয়ে। পারিবারিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, পৌরাণিক, বৈজ্ঞানিক কিংবা ভৌতিক গল্পও চলচ্চিত্রের বিষয় হতে পারে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিষয়বৈচিত্র্যগুণে ক্রমশ অনন্য হয়ে উঠলেও নব্বই দশকের পর ম্লান হতে শুরু করে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বদলে হালকা এবং সহজলভ্য সস্তা বিনোদনে তলিয়ে যেতে থাকে। ষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশক পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রের যে উচ্চাসন ছিল সেটা হারিয়ে যায়। অশ্লীলতার অভিযোগে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে রুচিহীন নিম্নমানের শিল্প। ফলে সচেতন কিংবা শিক্ষিত শ্রেণি সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই সুযোগে ঢুকে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশের চলচ্চিত্র কিংবা সিরিয়ালধর্মী নাটক। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এখন হিন্দি সিনেমার জয় জয়কার।
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র ছাড়াও মানব জীবনের নানাপ্রসঙ্গ নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। সামাজিক ও পারিবারিক বিষয় নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হতে দেখা যায়। যেখানে আবহমান গ্রামবাংলার চিরন্তন জীবনপ্রবাহ উঠে এসেছে। প্রেমকাহিনীর বাতাবরণে ছিল পারিবারিক ও সামাজিক সংকট। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে ১৯৭১ সালে এরকম বেশ ক’টি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। যেমন- নজরুল ইসলামের ‘স্বরলিপি’, অশোক ঘোষের ‘নাচের পুতুল’, আলমগীর কুমকুমের ‘স্মৃতিটুকু থাক’ খান আতাউর রহমানের ‘সুখ দুঃখ’, আলমগীর কবিরের ‘ধীরে বহে মেঘনা’ আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সারেং বৌ’, এবং ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, সামাজিক চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে জনপ্রিয় কোনো উপন্যাস কিংবা গল্পের কাহিনিকে চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হতো। ফলে নৃত্যসংগীত সহযোগে সিনেমার কাহিনী, চরিত্র, সংলাপ সহজেই দর্শকের মনে জায়গা করে নিতো।
মুক্তিযুদ্ধপরবর্তীকালে লোককাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেসময় লোকসমাজে অধিক জনপ্রিয় পৌরাণিক গল্প নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র বিভিশ্রেণির মানুষের মনে ছড়িয়ে দিত শৈল্পিক সুষমা। নিখাদ বিনোদনের পাশাপাশি সিনেমার চরিত্রগুলো দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। লোককাহিনীনির্ভর কিংবা পৌরাণিক আবহে নির্মিত কিছু চলচ্চিত্র এখনো সমান জনপ্রিয়। যেমন- সিরাজুল ইসলামের ‘নিমাই সন্ন্যাসী’ (১৯৭২), সৈয়দ হাসান ইমামের ‘লালন ফকির’ (১৯৭২), বজলুর রহমানের ‘গোপাল ভাঁড়’ (১৯৭৪), সফদর আলীর ‘নদের চাঁদ’ (১৯৭৯), এফ কবীর চৌধুরীর ‘আলিফ লায়লা’ (১৯৮০), ইবনে মিজানের ‘লাইলী মজনু’ (১৯৮৩), মতিন রায়হানের ‘রাধাকৃষ্ণ’ (১৯৮৫), মহম্মদ হান্নানের ‘রাই বিনোদিনী’ (১৯৮৫), আব্দুস সামাদের ‘শিরি ফরহাদ’ (১৯৮৬), এবং এম এ মালেকের ‘চাঁদ সওদাগর’ (১৯৮৬) উল্লেখযোগ্য।
আশির দশকের পরে হলিউড ও বলিউডের অনুকরণে ঢাকাই চলচ্চিত্রে মারকুটে অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের উন্মেষ ঘটে। এসব ছবির একটা বড় অংশজুড়ে থাকত জ্বালাও-পোড়াও এবং ভাঙচুরের দৃশ্য। খলনায়কের জন্য অনিবার্যভাবে বারাদ্দ থাকত নারীর শ্লীলতাহানীর স্পর্শকাতর কাটপিস। বস্তুত অ্যাকশনধর্মী সিনেমার নামে নির্মিত চলচ্চিত্রই বাংলাদেশের সিনেমার জন্য অভিশাপ। কারণ, সচেতন শিক্ষিতশ্রেণি তখন থেকে ক্রমশ হয়ে পড়ে চলচ্চিত্রবিমুখ। রুচির প্রশ্নে সপরিবারে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা বন্ধ করে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে সিনেমার দর্শক কমতে থাকে। বাংলাদেশের সিনেমা ছিটকে পড়ে ‘সোনালি যুগের সরণি’ থেকে। দেশে-বিদেশে নিম্নশ্রেণির রুচিহীন দর্শকের বিনোদন হিসেবেও চিহ্নিত হয়। এধরনের ছবির নামকরণ থেকেও আন্দাজ করা যায় অধঃপতিত চলচ্চিত্রের আগামী। যেমন- ‘ডেঞ্জার মিশন’, ‘নয়া কসাই’, ‘দুর্ধর্ষ খুনী, ‘আজকের সন্ত্রাসী’, ‘কুখ্যাত সন্ত্রাসী’, ‘জ্যান্ত লাশ’, ‘কোপা শামছু, ‘ঢাকাইয়া মাস্তান’ ‘গোলাগুলি’ ‘গজব’ ‘বোমা হামলা:, ‘খুনী শিকদার’ ‘সিটি টেরর’, ‘রংবাজ’, ইত্যাদি।
বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা ভীষণ নাজুক। সারাদেশে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য সিনেমা হল। পরিবর্তে সেখানে গড়ে উঠেছে বিপণীকেন্দ্রের জন্য বহুতল ভবন। এখন টেলিফিল্মধর্মী কিছু সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। বছরজুড়ে সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও প্রায় তলানিতে।
চলচ্চিত্রের এমন দুরবস্থার নেপথ্যের কারণ বোধকরি চলচ্চিত্রের উত্তরাধিকার বিচ্চিন্নতা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের হারানো গৌরব আর ফিরে পাবো কি? এই জিজ্ঞাসা অন্য অনেকের মতো আমার মনেও মাথাকুটে মরে। তবুও আশঙ্কা নিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় থাকি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।