দেড় দশক জুড়ে অন্তহীন জল্পনাকল্পনা এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মহল অবধি বহুল আলোচিত প্রসঙ্গ, পদ্মা সেতু। অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে সম্ভাব্যতা আর প্রতিকূলতার তুমুল তর্ক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে একটা প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলল বাংলাদেশ। এই অর্জন কয়েক শত বছরের ব্যপ্তিতে উল্লেখযোগ্য একটি সংযোজন হয়ে যুক্ত হলো বাংলাদেশের সাফল্য ও গৌরবের ইতিহাসের সঙ্গে।
দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এই দ্বিতল সেতুটির সাফল্যগাথার শুরুটি ছিল সীমাহীন তর্ক-বিতর্ক, সাফল্য-সামর্থ্যের মোটামুটি একতরফা বিচার ও দুর্নীতি অপবাদে তুমুল প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশ এবং পদ্মা সেতু ঘিরে সেইসব সংকট, শঙ্কা ও অপবাদের মূল হেতু বা ক্রীড়নক ছিল বিশ্ব ব্যাংক। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অবকাঠামোগত স্থাপনা ‘পদ্মা সেতু’ প্রকল্পে স্বল্প সুদে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের। শুরুর সময়, প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯০ কোটি ডলার। বলা যায় অনেকটা স্থির হয়ে গিয়েছিল পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্ব ব্যাংক দেবে ১২০ কোটি, এডিবি ৬১.৫ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি এবং আইডিবি ১৪ কোটি ডলার। সে সময় সেতুটি কেবল সড়ক সংযোগ ঘটাবে এটাই ছিল পরিকল্পনা।
শুরুর সেই সময়টাতে, ২০০৭ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে, প্রাক্কলিত ব্যয় ১০ হাজার ১ শ’ ৬১ কোটি টাকা ধরে হলেও, পরবর্তীতে রেল সংযোগ যুক্ত হওয়ায় এবং সেটাকে কেন্দ্র করে নকশা পরিবর্তিত হয়ে কাঠামোগত উপকরণ হিসেবে স্টিল নির্ধারিত হওয়ায় এবং জমি অধিগ্রহণ লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন, ক্ষতিপূরণ তিনগুণ হারে দেয়া, সংযোগ সড়ক ও নদীশাসন ব্যাপ্তি বৃদ্ধি, ইত্যাদি ঘিরে ধাপে ধাপে ব্যয়ের ক্ষেত্র বেড়ে এবং মূদ্রাস্ফীতি ও উপকরণ মূল্য বৃদ্ধির কারণে সবশেষে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ঠেকেছে এসে ৩০ হাজার ১ শ’ ৯৩ কোটি টাকায়। যার পুরোটাই জোগান দিচ্ছে সরকার। সরকারের অর্থ বিভাগ এই টাকার মধ্যে ৩০০ কোটি অনুদান ও বাকি ২৯ হাজার ৯ শ’ কোটি ১% সুদে দিচ্ছে সেতু বিভাগকে। বাজেট সমন্বয় ও রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করা হবে। সেতু বিভাগ এর বিপরীতে ফেরত দেবে ৩৬ হাজার ৪ শ’ ৩ কোটি টাকা। যা আসবে টোল আদায়ের মাধ্যমে, অর্থাৎ ফের এদেশের জনগণের কাছ থেকেই। রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত খরচ ব্যবস্থাপনা এবং টোল আদায়কারীর পাওনা মিটিয়ে টোল থেকে অর্জিত আয় থেকে এই ঋণ ফেরত দেয়া হবে ৩৫ বছরে।
উল্লেখ্য, এছাড়াও রেল সংযোগ যুক্ত হওয়ায় সেতু প্রকল্পের বাইরে আলাদাভাবে একটি রেলপথ প্রকল্প দাঁড়ায়, যার বাজেট নির্ধারিত হয় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটি পৃথক প্রকল্প, যার ৮৫ শতাংশের অর্থায়ন চীন থেকে গৃহীত ঋণে এবং বাকি ১৫ শতাংশ সরকারের তহবিল থেকে।
যে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগকে ঘিরে দুর্নীতির অপবাদে অপমানিত এবং অভিযোগে দুষ্ট, সেই বিশ্ব ব্যাংক আসলে কে? তাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রসঙ্গটি এমন অবধারিত বা আবশ্যক চেহারায় দৃশ্যমান হলো কেন? মূলত বিশ্ব ব্যাংক বলে আলাদা বা একক কোনো ব্যাংক নেই। পাঁচটি পৃথক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত পরিচিতি হলো ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ’। এর আবির্ভাব ও নামকরণের ইতিহাসটি এখানে একটু উল্লেখ করা প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১৯৪৪ সালের ১ থেকে ২২ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যা¤পশায়ারে অনুষ্ঠিত হয় জাতিসংঘের ‘মূদ্রা ও আর্থিক সম্মেলন’। যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বানে একত্রিত হয়েছিল বিশ্বের ৪৪ টি দেশের ৭৩০ জন নীতিনির্ধারক। ২২ জুলাই ১৯৪৪ তারিখে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ তাদের প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সর্বপ্রথম ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক’ নামকরণটি ব্যবহার করে। পরবর্তীতে ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রপ’ শিরোনামে পরিচিতি পাওয়া এটি আসলে ভিন্ন ভিন্ন নামে পাঁচটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত অস্তিত্ব। আইবিআরডি (ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট) এবং আইডিএ (ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন) মূলত বিশ্বব্যাংকের মাতৃ সংগঠন। পরে এদের সাথে যুক্ত হয় আরও তিনটি প্রতিষ্ঠান। আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স করপোরেশন), এমআইএ (মাল্টিল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট এজেন্সি) এবং আইসিএসআইডি (ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর সেটেলমেন্ট অব ইনভেস্টমেন্ট ডিস্পিউটস)। সব সদস্য দেশের প্রতিনিধি এগুলোতে সদস্য হিসেবে থাকলেও ভোটাধিকার যার যার মালিকানার অংশ হারে নির্ধারিত। যেমন আইবিআরডিতে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার ১৬.৪৪ শতাংশ আর ভোটাধিকার ১৫.৫৬ শতাংশ। বাংলাদেশের শেয়ার ০.২৮ শতাংশ আর ভোটাধিকার ০.২৯ শতাংশ। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এর ১৭ নম্বর অভীষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোকে তাদের জিডিপির ০.৭ শতাংশ উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের জন্য দিতে হবে এই মর্মে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আসলে এই জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যংক জাতীয় বৈশ্বিক সাংগঠনগুলো মানব কল্যাণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র সমূহের স্বার্থের বাইরে এদের চলাচল নেই। অন্য অর্থে এটা উত্তরাধুনিক ঔপনিবেশিকতার হাতিয়ার হিসেবেই অবদান রেখে যাচ্ছে। কথাটা খুব শীর্ণ ও নেতিবাচক অভিব্যক্তি বিবেচিত হলেও একটা উদাহরণ দেয়াই যায়। আপনার গৃহপালিত গরুটি থেকে অধিক দুধ পেতে বা গাধাটিকে দিয়ে অধিক বোঝা বইয়ে নিতে তো কিছু ভালোমন্দ খাইয়ে তাকে অতটুকু সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখতে আপনার হবেই। তবে হ্যাঁ, এর কল্যাণে জলে পড়ে যাওয়া কারো কারো কিছুটা বা অনেকটা পরিত্রাণ অনেক সময় ঘটে যায়, গিয়েছে, যাচ্ছে।
আইডিএকে বলা হয় গরীবের ব্যাংক। গরীবদের মধ্যে যারা গরীব তারাই এই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক। আইডিএ ঋণে দিতে হয় শুধু পরিষেবা খরচ। সেটাও মাত্র ০.৭৫ শতাংশ হারে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ প্রথম বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা পায় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে। যার এক তৃতীয়াংশই ছিল অনুদান। বাকি অংশ স্বল্প সুদে ঋণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছর অব্দি আইডিএ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ২১,৮১৬.৩ মিলিয়ন ডলার সহায়তার মধ্যেও ৫.৯৬ শতাংশ অর্থাৎ ১,২৯৯.৭ মিলিয়ন ডলার হলো অনুদান। তবে সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে আইডিএ-এর বদলে বাংলাদেশকে এখন ঋণ নিতে হবে আইবিআরডি থেকে। যা দেয়া হয় তুলনামূলক কঠিন শর্তে। তবু রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অন্য রাষ্ট্র থেকে ঋণ নেয়ার চেয়ে বিশ্ব ব্যাংক শ্রেয়তর। অন্য ঋণে সুদের হার উচ্চ থাকার পাশাপশি তাদের মর্জি অনুযায়ী কাজ দেয়া, উপকরণ কেনা, এসবের ভিতর দিয়ে সংহভাগ অর্থ তাদের কাছেই ব্যয় করতে হলেও সুদসহ পুরো দায়টুকু ঋণগ্রহীতার কাঁধেই চাপে। বর্তমান সময়ে চীনা ঋণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যেভাবে জোয়ালের শিকলবন্দিত্বে ধুঁকছে।
পদ্মা সেতু ঋণ প্রসঙ্গে সেরকম ছড়ি ঘোরানোর জাতীয় প্রশ্নের সংকট কিংবা অধিক সক্ষমতায় পৌঁছে যাবার সম্ভাবনাই সম্ভবত কাল হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে উদ্দেশ্যমূলক এবং ভুল প্রমাণিত হওয়া, বোর্ডের অনুমোদন সম্মতির প্রস্তাব মোড়ল মার্কিন সভাপতির ইচ্ছায় নাকচ হয়ে যাওয়া, ঋণ পরিশোধে সুনামের অধিকারী হয়েও রহস্যজনকভাবে ঋণ প্রস্তাব বাতিল করা, বিশ্ব ব্যাংক তাই এক্ষেত্রে স্পষ্টভাবেই তাদের সামন্তবাদী বা উত্তরাধুনিক ঔপনিবেশবাদী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত করেছে।
পদ্মা সেতুর কল্যাণে বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, প্রথম বছরে এই সেতু থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৬৮ কোটি টাকা। প্রথম দিকে এই সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ৮ হাজার যানবাহন এবং ২০২৫ সাল নাগাদ ৪১ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এই হিসেবের তুলনামূলক বিবেচনা ও বাস্তবতার সাথে যোগসূত্র স্পষ্টতর হবে বঙ্গবন্ধু সেতুর তথ্য বিবেচনায় আনলে। বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে বর্তমানে দিনে ২৪ হাজার যানবাহন চলাচল করে এবং বছরে গড়ে ৬৫০ কোটি টাকা আয় হয়।
অ্যামাজন নদীর পর পৃথিবীর দ্বিতীয় খরস্রোতা নদী পদ্মার বিশাল জলরাশি বয়ে নেয় গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের জলস্রোত। পদ্মার বিশাল খরস্রোতার পানির তীব্র গতিবেগ এতটাই প্রবল যে, প্রতি সেকেন্ডে ১৫ ফুট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এমন নদীতে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ, ১৮.১০ মিটার প্রস্থ, ৪+২ লেনের সড়ক ও এক লেনের রেলপথ সেতু বিশ্বে নজরকাড়া এক প্রকৌশল সাফল্যের নজির স্থাপনা। এই সেতুটি তাই কেবল নানান তথ্য উপাত্তের রেকর্ড করা একটি সেতুই নয়, এটা বাঙালীর এক অনন্য সাফল্য নিশানা। বিশ্ব-মোড়লীপনার দমন ও দাপটরীতির উত্তরাধুনিক সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশিকতার প্রতি স্পর্ধা ও সাহসের বৃদ্ধাঙ্গুলি। গর্বের, গৌরবের, আত্মবিশ্বাসের ও মর্যাদার প্রমাণ প্রতীক।
লেখক: কবি ও কথাকার