‘বাজেট’ তিন অক্ষরের এই শব্দটির যে কতটা অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। তাই তো জুন মাস আসার আগে আমরা একবুক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করি নতুন অর্থবছরের বাজেটের জন্য।
ব্যক্তি জীবনে আমাদের বাজেট আছে। আয় ও ব্যয়ের হিসাব রাখতে হয়। তবে ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের বাজেটের মৌলিক একটা পার্থক্য আছে। ব্যক্তি আগে আয় করেন, তারপর ব্যয়ের খাতগুলো নির্ধারণ করে ব্যায় করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্র ঠিক ব্যাক্তি বাজেটের উল্টো। রাষ্ট্র আগে ব্যয়ের খাতগুলো ঠিক করে। এরপর বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদগণ ও দেশের নীতিমালা প্রণয়নকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো সেই অর্থ অনুসন্ধানে পথগুলো খুঁজে বের করেন। কারণ সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য নানামুখী উদ্যোগ নিতে হয়। আয় ও ব্যয়ের ধরনের ভিত্তিতে এ রাজস্ব বাজেটের প্রধান দুটি অংশ থাকে।
রাজস্ব ব্যয়: রাজস্ব ব্যয় হলো অনুন্নয়ন বাজেট। সরকারের দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসন চালানোর খরচ।
রাজস্ব আয়: ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারের প্রয়োজন আয়। রাষ্ট্রের বেশ কিছু আয়ের উৎস আছে। আয়ের এসব উৎসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর এবং কর বহির্ভূত আয়।
এই কর ছাড়া রাষ্ট্রের আরও কিছু আয় আছে। যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভ, সুদ, সাধারণ প্রশাসন থেকে আয়, ডাক-তার-টেলিফোন থেকে আয়, পরিবহন আয়, জরিমানা ও দণ্ড থেকে আয়, ভাড়া, ইজারা, টোল থেকে আয় ইত্যাদি।
বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো উন্নয়ন বাজেট। যে বাজেটে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ দেখানো হয়, এই অর্থ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। আয় ও ব্যয় সমতা ও অসমতা অনুযায়ী বাজেট দুই ধরনের হয়ে থাকে। সুষম বাজেট ও অসম বাজেট।
ব্যয়ের তুলনায় আয় যদি বেশি হলে সেটি উদ্বৃত্ত বাজেট। ঘাটতি বাজেট হচ্ছে ঠিক উল্টোটা। সাধারণত উন্নত দেশগুলোতে সুষম বাজেট হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে সুষম বাজেট করা কঠিন। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, আমাদের মতো দেশের মতো দেশগুলোতে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো।
আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। নতুন এই বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি ধরা হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে বাজেট ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হয়। আমাদের ভবিষ্যত কি শ্রীলংকার দিকে এগোচ্ছে? এ বিষয়ে কিছু বলার আগে আমাদের ঘাটতি বাজেট কিভাবে সমন্বয় হবে সেই বিষয় আগে জেনে নিতে হবে। ঘাটতি বাজেট পূরণ হয় দুইটি উৎস থেকে। একটি বৈদেশিক উৎস ও অন্যটি অভ্যন্তরীণ উৎস।
বৈদেশিক উৎস: এটি হলো বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা গেলে সেটি অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। কারণ, এতে সুদ কম এবং পরিশোধ করতে সময়ও বেশি পাওয়া যায়। তবে এ ধরণের ঋণে শর্ত থাকে বেশি।
অভ্যন্তরীণ উৎস: সরকার দেশের ভেতর থেকে দুইভাবে ঋণ নেয়। যেমন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংক বহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংক বহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এর ফলে সরকার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয়।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার দুটি সমস্যা রয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ কমে যাবে, ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংক বহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে সুদ বেশি দিতে হয়। এতে পরের অর্থবছরের বাজেট চাপ বেড়ে যায়। আর সরকার বেশি পরিমাণ ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি হলো, কোনো দেশে সর্বোপরি যতটুকু সম্পদ আছে তার মূল্য ওই দেশের বর্তমানের মোট মুদ্রামানের (টাকা) সমান। ধরি বাংলাদেশে সর্বমোট ১০০ টাকা আছে এবং এই দেশের সম্পদ বলতে সাকুল্যে রয়েছে ৫টি সোনার পাত। যেহেতু দেশের মোট সম্পদের মূল্য মোট মুদ্রামানের সমান, সেহেতু এই ৫ টি সোনার পাতের মূল্য ১০০ টাকা। তাহলে প্রতিটি সোনার পাতের মূল্য ২০ টাকা। এখন যদি নতুন করে আরও ৫০টাকা ছাপানো হয়, তাহলে মোট মুদ্রামান হয়ে যাবে ১০০+৫০= ১৫০ টাকা। তবে সোনার পাত তো আর বাড়ে নি, ৫টিই আছে। তাই এখন নতুন ৫০ টাকা ছাপানোর পর ৫ টি সোনার পাতের মূল্য হয়ে যায় ১৫০ টাকা। মানে প্রতিটি সোনার পাতের মূল্য হয়ে যাবে ৩০ টাকা। সম্পদ না বাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে আগে যে পাতের মূল্য ২০ টাকা ছিল তা হঠাৎ ৩০ টাকা হয়ে যায়, এইটাই হলো ‘মুদ্রাস্ফীতি’। একই পণ্য আগের থেকে বেশি দামে ক্রয় করা মানেই মুদ্রাস্ফীতি। সহজ ভাষায় বলা যায়, ‘কোনো দেশের সম্পদের পরিমাণ না বাড়িয়ে টাকা ছাপানোই মুদ্রাস্ফীতি।’
এবার আসা যাক খেলাপী ঋণ প্রসঙ্গে। সহজ ভাষায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে সেই ঋণকে খেলাপী ঋণ বলা যায়।
ধরি, ১০০ টাকা থেকে এক ব্যক্তি ২০ টাকা ঋণ নিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণের ২০ টাকা দেশের মধ্যেই থাকছে, ততক্ষণ দেশের মোট মুদ্রামান ১০০ টাকাই থাকে। মানে প্রতিটি সোনার পাতের মূল্য ২০ টাকাই থাকে। মুদ্রাস্ফীতি হয় নি।
ওই ব্যক্তি যদি ২০ ঋণের টাকা ডলারে কনভার্ট করে বিদেশে গিয়ে খরচ করে ফেলে এবং সে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম হয় তাহলে ডলারে কনভার্ট ওই ২০ টাকা থাকে না তা তখন অন্য দেশের ডলার হয়ে গেছে, ওই ডলার আর বাংলাদেশে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। অথচ খাতা কলমে বাংলাদেশের মোট টাকার মান এখনো ১০০ টাকাই আছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আছে ৮০ টাকা। ওই খেলাপী ঋণের ২০ টাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যদি আবারও ২০ টাকা অতিরিক্ত ছাপানো হয়। ভয়ংকর ব্যাপার। আপনাকে টাকা না দিয়ে বলা হচ্ছে টাকা দিয়েছি, আছে আপনার পকেটে। ফলে সাধারণ জনগণকে বেশি দাম দিয়ে চাল, ডাল, তেল কিনতে হয় আগের থেকে কম পরিমাণে। যা জনগণের ভেতরে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অবস্থাটিই বর্তমানে শ্রীলংকায় বিরাজ করছে।
এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, মুদ্রাস্ফীতি ভালো নাকি খারাপ?
‘মৃদু মুদ্রাস্ফীতি’ যে কোনো দেশের জন্য ভালো। কিন্তু আসলে কেন ভালো?
কারণ যখন কোনো দেশে মৃদু মুদ্রাস্ফীতি থাকে, তখন সেই দেশের বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। কিন্তু কোনো দেশে যদি মুদ্রাস্ফীতি না থাকে তবে সে দেশে বিনিয়োগ কমে যাবে, এবং অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়বে।
এখন যদি খুব বেশি হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়, তখনও একটি দেশের অর্থনীতি ধসে পড়বে। জিনিসের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে, যে মানুষগুলোর পকেটে হাজার হাজার টাকা থাকত, সে মানুষগুলো দেখবে, এই টাকা দিয়ে সে কিছুই কিনতে পারছে না। দেশ ধীরে ধীরে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাবে যদি সমস্যার উত্তরণ করা না যায়। মৃদু মুদ্রাস্ফীতি একটি অর্থনীতির উন্নতির জন্য আবশ্যক। তবে ঋণের নামে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমাদের বাজেটে তার প্রভাব পড়ে।
আর তাইত সবাই এখন ভাবতে বসেছে, আমাদের অবস্থা আবার শ্রীলংকার বর্তমান পরিস্থিতির মতো হবে না তো? আমার মনে হয় না। কারণ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক ধসের কিছু সুস্পষ্ট কারণ ছিল, প্রথম ও প্রধান কারণ শ্রীলংকান পর্যটন খাতে ধস। সেজন্য করোনাই অনেকাংশে দায়ী। শ্রীলংকান সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত হলো পর্যটন, করোনার কারণে সেটি বন্ধ থাকায় রাজস্ব আয় প্রায় বন্ধ ছিল। অন্যদিকে দেশটির উন্নয়নের খাতের নামে নেয়া নানারকম প্রকল্পের জন্য যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নেয়া হয়েছিল তার কিস্তিগুলো ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে সরকারকে। রাজস্ব আয় বন্ধ থাকলেও ব্যয় কিন্তু চলছিল। ঠিক তখনই শুরু হয় বাজেট ঘাটতি। অন্যদিকে শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছিল, রেমিটেন্সও পৌঁছেছিল তলানিতে। আবার রাজস্ব আয়ের আর একটি পথ কর ও ভ্যাট, সেটা না বাড়িয়ে কমানোর কারণে পকেটে দিনে দিনে শূন্যের কোঠায় যাচ্ছিল, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে অর্গানিক খাদ্য উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসে। অপরদিকে বাংলাদেশেও শ্রীলংকার মতো কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু আমাদের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। মেগাপ্রকল্প পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ আরও কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলও চালু হচ্ছে এ বছরই। সবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নও আসবে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে। বাংলাদেশ সরকার রাজস্ব আদায়ে আগের থেকে আরো কঠোর হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি নেই। রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। মাঝে কিছু অর্থ পাচার হয়েছিল, তবে সেখান থেকে কিছু অর্থ ফেরতও এসেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার, শ্রীলংকার রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ শ্রীলংকার মতো মাথাপিছু থেকে ঢের কম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের ছোটবড় সব প্রকল্পেই কিন্তু বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, জাইকাসহ অন্য উন্নয়ন সংস্থার ঋণ এবং নিজের অর্থ যোগ করেছে। এসব সংস্থার সুদের হার খুবই কম। অনেক বছর ধরে শোধ করা যায়। কোনো কোনো ঋণ অবশ্য পরবর্তী সময়ে অনুদান হিসেবে অন্য প্রকল্পেও দেয়। বিশেষ করে জাইকার বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে। অন্যদিকে শ্রীলংকা চীনের কাছ থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট (যে দেশ টাকা দেবে, সে দেশ থেকে পণ্য কেনা) ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সেসব ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে গিয়েই এখন বিপদে পড়েছে শ্রীলংকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উৎপাদন বছর বছর বাড়ছেই। এর মধ্যেও সরকার বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দেয়ার পর এই মুহূর্তে খাদ্যের মজুত ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
তারপরও মাঝে মাঝে মুদ্রাস্ফীতি দেখে মনে হয় লংকা হলাম না তো! কেননা একটি দেশের সরকার আর কত মুদ্রা ছাপিয়ে দেশে চালাবে, ঝুড়ি তো দিনে দিনে শূন্যই হবে। মুদ্রাস্ফীতি, অর্থ-পাচার, বৈদেশিক ঋণে ভ্যাট আসলে আমাদের সরকারের পক্ষে দেশে চালানো মুশকিল হয়ে যাবে। কেননা সাধারণ জনগণের পকেটে তো সেই অর্থই থাকবে। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। সৃষ্টি হবে অরাজকতা। তাই এখন উচিত ঘাটতি বাজেট পূরণ করার জন্য দেশের কৃষি ও রপ্তানিমুখী ব্যবসার দিকে নজর দেয়া ও খেলাপি ঋণ আদায় করে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত নিয়ে আসা। তাছাড়া খাতাপত্রের অর্থের সাথে মূল অর্থের সমন্বয় করে সময় উপযোগী বাজেট প্রণয়ন করলে আমরা যে কোনো জাতি থেকে এগিয়ে থাকব।
লেখক: সিনিয়র অফিসার, ব্র্যাক ব্যাংক।
Leave a comment