দু’ হাজার সালের গোড়ার দিকে সার্স ভাইরাস সংক্রমণের কথা যদি কারো মনে থেকে থাকে, আর কোভিড – ১৯ এর বিরুদ্ধে সচেতনতার এই যে তোড়জোড়, এই সময়ের অংশ যদি হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই দুটো শব্দের সাথে পরিচিত – এপিডেমিক, আর প্যানডেমিক। যখনই কোনো সংক্রামক রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন এই দুটো শব্দ প্রচুর পরিমানে ব্যবহৃত হয়। এবং সেটা কখনো কখনো না জেনে, না বুঝে আমরা ভুল জায়গায় ব্যবহার করি।
দেখা যায় লোকজন এই শব্দ দুটো কেন প্রায়ই গুলিয়ে ফেলে। প্রথমত, দুটো শব্দের পেছনেই ডেমিক শব্দটা আছে। দ্বিতীয়ত, কোনো রোগ ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়লে এই দুটো শব্দই আমরা খুব স্মার্টলি যত্রতত্র ব্যবহার করি। মূলত এই দুই কারণেই অনেকেই শব্দ দুটোকে প্রায় একই অর্থে ব্যবহার করেন। কিন্তু আদতে এই শব্দ দুটো একই অর্থ বহন করে না। আর পার্থক্যটা হলো, মাত্রায়। চলুন, আরেকটু ভালোভাবে বুঝে নেয়া যাক।
আগে বুঝে নিই ‘এপিডেমিক’ কি
কোনো একটা নির্দিষ্ট এলাকায়, কোনো সংক্রামক রোগ যখন একটা জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেটাকে ‘এপিডেমিক’ বা ‘মহামারী’ বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএইচও-এর মতে, ‘এপিডেমিক’ একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।
এবার আসি, ‘প্যানডেমিক’ শব্দটিতে
এপিডেমিক যখন নির্দিষ্ট এলাকার গন্ডি ছাড়িয়ে আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে, পুরো দেশে, মহাদেশে, বা পুরো পৃথিবীতে, তখন সেটাকে বলা হয় ‘প্যানডেমিক’। এর অর্থ, অতিমারী। ডব্লিউএইচও-এর মতে যেটা হলো, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নতুন কোনো সংক্রামক রোগ। সেই অনুযায়ী ডব্লিউএইচও ২০২০ সালের ১১ মার্চ কোভিড ১৯-কে প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে ব্যাপক পরিসরে, অথবা অন্য অনেক দেশে একইসাথে বা সারা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সংক্রামক রোগই প্যানডেমিক বলে বিবেচিত হয়। এবং সংগত কারণেই অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া অন্যান্য সব মহাদেশে এই রোগের অবস্থা জরীপ শেষে বিশেষজ্ঞরা কোভিড ১৯-কে প্যানডেমিক বা অতিমারী বলে ঘোষণা করেছেন। মহামারী বিদ্যাতে অবশ্য সাধারণভাবে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া যে কোনো সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেই এই টার্ম ব্যবহার করা হয়। ল্যাটিন শব্দের মধ্যে দিয়ে ইংরেজিতেও ঢুকে পড়েছে এই ‘প্যানডেমিক’। এপিডেমিকের মতোই প্যানডেমিক এসেছে গ্রিক প্যানডেমোস শব্দটা থেকে, যার অর্থ, সাধারণ জনগণ। আর ইংরেজিতে এসে রোগের সাথে স¤পৃক্ত হয়ে গেছে এই ‘প্যানডেমিক’ শব্দটা।
এবার ‘এনডেমিক’
এই শব্দটার মানে হলো, একটি নির্দিষ্ট এলাকা অথবা জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসরত জনগোষ্ঠী যখন কোনো সংক্রামক রোগের শিকার হয়ে পড়ে, তখন আমরা ‘এনডেমিক’ শব্দটা ব্যবহার করি। যেমন, ম্যালেরিয়া হলো গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া রোগ। শুধুমাত্র গ্রীষ্মম-লীয় এলাকাতেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। কাজেই ম্যালেরিয়া হলো গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলের জন্য এনডেমিক। স্থানীয় সংক্রামক রোগ। শব্দটা অন্যভাবেও অবশ্য ব্যবহৃত হয়। কোনো একটা জায়গা, অবস্থা বা লোকজনের কোনো একটা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বোঝাতেও শব্দটা ব্যবহার করা হয়। যেমন, যে সংস্থায় আমি কাজ করতাম, সেখানে দুর্নীতি ছিল প্রায় এনডেমিকের মতো। মানে হলো, ওই সংস্থার কমবেশি সবাই দুর্নিতিবাজ। ইংরেজিতে ‘এনডেমিক’ শব্দটার ব্যবহার হয় প্রথম ১৬০০ খ্রীস্টাব্দের মাঝামাঝি একটা সময়ে। গ্রিক শব্দ এনডিমস থেকে এর উৎপত্তি। এনডেমিক শব্দটাতে প্রিফিক্স বহ এর অর্থ হলো, ভেতরে বা মধ্যে। আর মূল শব্দ ডেমিক এর অর্থ হচ্ছে, জন বা গণ, যা এসেছে ডেমোস বা জনগণ থেকে। তাহলে এনডেমিক শব্দের মানে দাঁড়াচ্ছে, একটা জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত।
একইভাবে এপিডেমিক এর প্রিফিক্স ‘এপি’ শব্দের অর্থ ওপর। আর ডেমোস মানে তো জনগণ। তাহলে এপিডেমিক অর্থ দাঁড়াচ্ছে জনগণের ওপর এসে পড়া। অর্থাৎ, একটা জনগোষ্ঠীর ওপর উপদ্রুত।
আবার প্যানডেমিকের প্রিফিক্স প্যান এর অর্থ, সবার সাথে জড়িত। তাহলে ডেমোস এর জনগণ অর্থ নিয়ে মানে দাঁড়াচ্ছে, সর্বজন অথবা সর্বত্র জড়িত। অন্যভাবে বলা যায়, যেটার সাথে পৃথিবীর সব জায়গা বা সব জনগণ জড়িত।
তাহলে আমরা বলতে পারি, ‘এপিডেমিক’ হলো কোনো কিছুর শুরুটা, হতে পারে কোনো রোগবালাই, অথবা কোনো ধারা, যেটা খুব দ্রুত কোনো একটা এলাকার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এই রোগবালাই বা ধারা যদি বাড়তে বাড়তে সীমানা অতিক্রম করে দেশ, মহাদেশ ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেটা ‘প্যানডেমিক’। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া, সেটা ‘এপিডেমিক’ আর এই দাবানলের মাত্রা এবং পরিসর যদি অনেক বেশি হয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে সেটা ‘প্যানডেমিক’।
যারা এখনো বিভ্রান্ত তাদের জন্য শেষ একটা উদাহরণ
মহামারী আকারে হাম ছড়িয়ে পড়ায় শহরের স্কুলগুলো আপাতত বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, – এপিডেমিক।
¯প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তি ঠিক কোত্থেকে হয়েছে, সঠিকভাবে জানা না গেলেও ১৯১৮ সালে এই অতিমারীর কারণে পৃথিবীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোকজন আক্রান্ত হয়েছিল, – প্যানডেমিক।
কয়েকটি দেশে পোলিও একটি স্থানীয় সংক্রামক রোগ হিসেবে দেখা দিলেও, পরবর্তীতে শুধুমাত্র ওই কয়টি দেশের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল না, – এনডেমিক।
আউটব্রেক শব্দটাও একটু দেখে নিই। কোভিড ১৯ কে যে শুধু এপিডেমিক বা প্যানডেমিকই বলা হচ্ছে, তা কিন্তু না, এটাকে ‘আউটব্রেকও’ বলা হচ্ছে।
এখন ‘আউটব্রেক’- টা কি?
আউটব্রেক হলো হুট করেই কোনো কিছু দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়া। অথবা বিস্ফোরণ! যখন কোনো একটা সংক্রামক রোগের সাথে ‘আউটব্রেক’ শব্দটা জুড়ে দেয়া হয়, তার মানে বোঝায় খুব দ্রুত রোগটি জনগনের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং সেটা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে। সেক্ষেত্রে বলা যায়, আউটব্রেক আর এপিডেমিক খুব কাছাকাছি অর্থ বহন করে। প্রতিদিন অসংখ্য কথায়, বার্তায়, লেখায়, লোকজন ‘নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রামক রোগ হিসেবে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়েছে’ বলে উল্লেখ করে।
তবে সাধারণ লোকজন যা-ই বলুক, দাপ্তরিক পরিভাষা, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক কর্মকা-ের ক্ষেত্রগুলোতে মোটেও এই টার্মগুলো গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে না। উচিত হবে না একটা স্থানীয় মহামারীকে অতিমারী বলে ভুলভাবে উপস্থাপন করা, যার মানে হলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সংক্রামক রোগ।
এবার ‘এপিসেন্টার’
এপিএন্টার হলো যে কোনো কাজ বা ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। কোনো একটা শহরকে যদি অতিমারীর কেন্দ্রবিন্দু বলা হয়, তারমানে হলো, অন্য যে কোনো জায়গা বা দেশের চেয়ে ওই নির্দিষ্ট জায়গায় রোগের প্রাদুর্ভাব অনেক অনেক বেশি। এপিসেন্টার আরো সহজে বোঝা যায় যদি আমরা শব্দটাকে হট¯পট দিয়ে প্রতিস্থাপিত করি। কোনো একটা নির্দিষ্ট জায়গা, হতে পারে কোনো নার্সিং হোম, যেখানে হুট করেই নতুন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়, সেই জায়গাটাকেও আমরা ‘হট¯পট’ বা ‘এপিসেন্টার’ বলতে পারি।
এই সময়ের আরো দুটো গুলিয়ে ফেলা শব্দ হলো ‘কোয়ারেন্টাইন’ আর আইসোলেশন।
‘কোয়ারেনটাইন’
কোভিড ১৯-এর ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই যে উপসর্গ দেখা দেয়, তা কিন্তু না। বাহকের শরীরে প্রায় সপ্তাহখানেক সে দিব্যি ঘুমন্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কাজেই, কেউ যদি করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে আসে, অথবা করোনায় আক্রান্ত রোগীর সং¯পর্শে আসে, সে নিজেও করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ মনে হলেও সে আসলে আক্রান্ত কি না, এটা বুঝে উঠতে কিছুদিন সময় লাগে। ১৪ দিন। এই ১৪ দিন তাকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, লোকজনের সং¯পর্শ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। কোনো ওষুধ পত্র না, শুধুমাত্র সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে আলাদা ঘরে বা আলাদা জায়গায় নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রাখা, এটা হলো ‘কোয়ারেনটাইন’।
‘আইসোলেশন’
কারো শরীরে করোনার লক্ষন প্রকাশ পেলে, অথবা টেস্টের রেজাল্ট পজেটিভ এলে, অর্থাৎ সে যখন করোনায় আক্রান্ত, তখন তাকে হাসপাতালে ডাক্তার বা নার্সদের তত্বাবধানে আলাদা করে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে বাইরের কারো সাথে তো বটেই, এমনকি নিজের পরিবার পরিজনের সাথেও দেখা করতে দেয়া হয় না। এই সময়সীমাও চৌদ্দ দিন। রোগীর অবস্থাভেদে সময়সীমা বাড়তে পারে। হাসপাতালে এই যে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেয়া, এটা হলো ‘আইসোলেশন’।
ডিকশনারি ডট কম অবলম্বনে