হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগেও মুজিবকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল
আর কে রাধাকৃষাণ
অনুবাদ: সুলতানা পারভীন শিমুল
প্রকাশকাল: ১৩ এপ্রিল ২০১৩ প্রকাশিত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান খুন হন। এবং এই ঘটনার অল্প কয়েক মাস আগেও তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
শেখ মুজিবের ওপর যে হামলা হয়েছিল, এই ব্যাপারটা প্রকাশিত হয় শুধুমাত্র তখনই, যখন ঢাকার আমেরিকান দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে কিসিঞ্জারের জন্য একটা বার্তা প্রেরণ করা হয়, যেটা সম্প্রতি উইকিলিকসেও প্রকাশিত হয়েছে।
এই বার্তায় জানা যায় যে, খবরটা প্রকাশিত না হওয়ার ব্যাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
‘আমরা এরকম দুটো গোপন তথ্য পেয়েছি যে ২১ মে সন্ধ্যায় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হতে পারে।’ বার্তাকক্ষ, ২৩ মে, ১৯৭৫ (>১৯৭৫ডিএসিসিএ০২৫৩৫_বি, কনফিডেনশিয়াল) নোট।
‘ঢাকার অদূরে অবস্থিত একটি নতুন টিভি স্টেশন পরিদর্শন করে মুজিব যখন নিজ বাসভবনে ফিরছিলেন, ঠিক সেই সময় এই হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা চালানো হয়।’
এই তথ্যের একটি উত্স ছিল দূতাবাসের এক বাঙালি রাজনৈতিক সহকারি, তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির (শেখ মুজিবুর রহমান) নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত একজন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাকে এই কথা জানিয়েছেন। এবং অন্যজন ছিলেন একজন সাংবাদিক, যিনি তথ্য অফিসার অ্যালপার্নকে খবরটি জানিয়েছেন। দুটি তথ্যসূত্রই নিশ্চিত করে, এই ঘটনায় গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফিরতে পারলেও তাঁর সঙ্গের দুজন গুরুতরভাবে আহত হন। আর এই ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর নির্দেশনা ছিল বলেও তিনি জানান।
১৯৭১ সালে, যে সময়টাতে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হিসেবে নিজেকে পুনর্গঠিত করছে, সেই সময়ে পাকিস্তানের সাথে নিক্সন প্রশাসনের গভীর আঁতাতের কারণে আমেরিকার সাথে মুজিবের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেনা অভ্যুত্থান এবং মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ এখন কোন্ পথে পরিচালিত হবে, কার নির্দেশে, এই ব্যাপারে আমেরিকার আগ্রহ বেশ স্পষ্টই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আমেরিকান দূতাবাস এক প্রতিবেদনে (>১৯৭৫ডিএসিসিএ০৩৯৬৪_বি, কনফিডেনশিয়াল) জানায়, ‘চোখে পড়ার মতো কোনো উচ্ছাস কোথাও ছিল না, তবুও বাঙালিরা ব্যাপারটাকে বেশ শান্তভাবেই গ্রহণ করেছে, যেন কিছুটা স্বস্তির সঙ্গেই।’
ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ক্ষমতার হাত বদলের এই ব্যাপারটাতে আরো সুসপষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শেখ মুজিব এবং বাঙালিদের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব অনেকটাই বেড়ে গিয়ে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বাঙালিরা শেখ মুজিবের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল, কারণ ক্ষমতাকে তিনি ব্যক্তিগত এবং পারিবারিকভাবে অনেক বেশি ব্যবহার করছিলেন এবং সেই কারণে জনসাধারণের প্রত্যাশিত আশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। গণতন্ত্র ধীরে ধীরে যতটা একনায়কতন্ত্রে পরিণত হচ্ছিল, তিনিও ততটাই জনবিচ্ছিন্ন এবং একা হয়ে পড়ছিলেন।’
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নতুন সরকার ‘মূলত কিছু জনপ্রিয় মানুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি দুর্বল প্রশাসন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।’ যদিও এই সমন্বয়সভার আরো অনেক সুগঠিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। যে শক্তিগুলোর সাথে স্নায়ু যুদ্ধ চলছিল, সেগুলোকে আরো সুন্দরভাবে মোকাবেলা করার সুযোগ ছিল। আদতে তেমনটা পরিলক্ষিত হয় নি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘জুনের মোটামুটি শুরু থেকেই ক্রমশ শক্তিধর হয়ে ওঠা ভাগ্নে শেখ মনির সাথে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শেখ মুজিবের যে প্রাণান্ত চেষ্টা, খুব সম্ভব সেটা দেখেই ষড়যন্ত্রকারীরা যত দ্রুত সম্ভব কাজটা সেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের স্বাধীনতা দিবসটাকেই এই ঘটনার জন্য বেছে নেয়াটা হয়ত নিতান্তই আকস্মিক। কিন্তু এই কাকতালীয় ব্যাপারটিও আমরা বিবেচনায় রেখেছি।’
ভারত সরকার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আবার মাথা গলায় কিনা সেই ব্যাপারে আমেরিকা কিন্তু যথেষ্ট সতর্ক ছিল। নয়াদিল্লিতে তাদের দূতাবাস ভারতীয় আর্মি অফিসারদের কিছু মতামত নিয়ে একটা প্রতিবেদন (>১৯৭৫এনইডব্লিউডিই১১০৫৯_বি, কনফিডেনশিয়াল) প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা এমন কিছু দেখি নি বা শুনি নি যেটা নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশের সেনা অভ্যুত্থানে ভারতীয় সেনাবাহিনী ইস্টার্ন কম্যান্ড কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে বা ভূমিকা রেখেছে। এই ব্যাপারে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে আমাদের বরং বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। যার ফলে যা ঘটার কথা ছিল, তাই ঘটছিল। ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডার জেনারেল জ্যাকব এবং তার ডেপুটি মেজর জেনারেল হরি সেংগাল অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের সাথে পশ্চিম বাংলার গভর্নরের (এ.এল) বাসভবনে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ছিলেন। আমি জ্যাকব আর সেংগাল, দুজনের সাথেই কথা বলেছি, তাদেরকে বরং বেশ নিশ্চিন্ত এবং নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। দু’জনের কেউই বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেন নি।’
কিন্তু বাংলাদেশের সেনা অভ্যুত্থান এর ব্যাপারে ভারতীয় সরকারের আগ্রহ তো অবশ্যই ছিল। এবং ব্যাপারটা সুসপষ্ট হয়ে যায় আমেরিকান দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো একজনের মধ্যে গোপন বার্তালাপে (>১৯৭৫ডিএসিসিএ১১০৬৩_বি, কনফিডেনশিয়াল) । এই কথোপকথনে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে তারা তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
একই তথ্যসূত্র জানায়, ‘১৫ আগস্টে রাষ্ট্রদূতদের জন্য আয়োজিত এক ডিনারে পররাষ্ট্র সচিব কেওয়াল সিং এবং (প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব) ধরকে বাংলাদেশের সামপ্রতিক ঘটনাবলীর বিষয়ে বেশ নির্লিপ্ত মনে হয়েছে। ‘পুরনো পাপীরা’ আবার কিভাবে সব ‘স্বপদে বহাল হচ্ছে,’ এরকম হালকা হাসিঠাট্টার মধ্যেই তারা তাদের কথাবার্তা সীমাবদ্ধ রাখেন।’
বাংলাদেশ যেমন সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নীরব থাকতে বলেছিল, ঠিক তেমনিভাবেই ভারত সরকারও তাদের সংবাদমাধ্যমগুলোকে এই সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে কোনোরকম বিবৃতি দিতে নিষেধ করেছিল। সংবাদের আরেকটি উত্স জানায়, বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে যে কোনো সম্পাদকীয় মন্তব্যই তখন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
লেখক: শিক্ষক