বাজেট একটি দেশের বাৎসরিক আয়ব্যয়ের চূড়ান্ত দলিল। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় বাজেট প্রণয়ণ করে থাকে। বাংলাদেশের অর্থবছর শুরু হয় জুন মাসে। বাজেট সরকার প্রণীত একটি কর্মপরিকল্পনা সেখানে পুরো অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব সন্নিবেশ করা হয়। জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার ঘোষিত হয়েছে আগেই। প্রস্তাবিত আকার ৬ লক্ষ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা যা মোট জিডিপি এর ১৫.৪ শতাংশ। এবারের বাজেটের আকার কিছুটা বড় হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তা কতটুকু যৌক্তিক কী করণীয় সেটাই আলোচ্য বিষয়।
কোভিড-১৯ এর মতো মানবিক বিপর্যয় সারা বিশ্বকে স্থবীর করে দিয়েছিল। একদিকে মৃত্যুর মিছিলে হাজার মানুষ, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সারা পৃথিবী অন্যদিকে বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন। কাজ বন্ধ থাকায় দেখা দেয় খাবারের সংকট। তবে সুখের বিষয় আমাদের দেশের অবস্থা প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভালো ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী উদ্যোগের কারণে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা গিয়েছিল। বিভিন্ন সেক্টরে বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা, কৃষিতে প্রণোদনা দানের কারণে আমাদের মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
তবে অতিমারি কোভিড-১৯ চলাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার ও নিম্নআয়ের মানুষের। নতুন করে প্রায় ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। কত মানুষ কর্ম হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়ে পড়েছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যখন উপায় খুঁজছেন সরকার ঠিক তখন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। যার জন্য নিত্য পণ্যের দাম সীমিত আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আবার আমদানির চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্য দেশকে সংকটময় পরিস্থিতিতে ফেলেছে।
সুতরাং আসছে অর্থবছরের বাজেটের জন্য সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। দেশের সার্বিক মূল্যস্কীতি এখন ৬.২৫% যা গত দেড় বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ।
আবার হুট করে ডলার সংকট অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। ডলারের মূল্য ধাপে ধাপে সমন্বয় করা যেতে পারে। এজন্য দরকার একটি সঠিক কর্ম-পরিকল্পনা। অর্থনীতি সংক্রান্ত যে সকল কমিটি রয়েছে সে সকল কমিটিকে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে একটি পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কর্মকাঠামো তৈরি করার এখনই সময়। সংকট মোকাবেলায় অনেক বেশি সরব হতে হবে সংশ্লিষ্ট জনকে। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর এখনই সময় এসেছে।
সরকার বারবার বলছে, ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় সংকোচনের কথা। কিন্তু ব্যয় সংকোচনটা কারা করবে? উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নাকি নিম্নবিত্তরা?
একটি বিষয় বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশে এখন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট। এই ধনীদের বেশির ভাগই ব্যবসায়ী। দেশে যখন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় বা মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়। তখন সবার আগে গিরগিটির মতো চেহারা বদল করে এই ব্যবসায়িক শ্রেণি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোভিড-১৯ চলাকালে ২০২১ সালের আদা কাণ্ডের কথা। আদা গুদামজাত করে কিভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিল। ২০২২-এ এসে দেখেছি সয়াবিন কা-। সুতরাং সবার আগে ব্যবসায়ীদের ঘৃণ্য সিন্ডিকেটের রাশটি টেনে ধরতে হবে। তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
পণ্যের দাম বাড়ায় ধনিক শ্রেণিই লাভবান হয় বেশি। অধিক মুনাফা তাদেরই ঘরে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল এই দেশের বেশিরভাগ মানুষই মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত। কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলু খাগড়ার প্রাণ যায়।
বিদ্যমান পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্নবিত্ত বা সীমিত আয়ের মানুষ। দেশ যখনই কোনো সংকটে পড়ে তখন মধ্যবিত্তরা না পারে কারো কাছে হাত পাততে না পারে সইতে। ‘তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ অবস্থা। নিজেদের আত্মসম্মান কারো কাছে বিকিয়ে না দেয়া মধ্যবিত্ত ভেতরে ভেতরে গুমরে মরে। তখন বাধ্য হয়েই তারা তাদের ব্যয়ের হিসেবটি সংকুচিত করে ফেলে। পরিস্থিতিই ব্যক্তিকে সাশ্রয়ী হতে বাধ্য করছে। কিন্তু নিম্নবিত্তের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। দিন এনে দিন খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বারবার বলা হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আত্ততায় আরও বাজেট বরাদ্দের কথা। কিন্তু যাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ সেই সঠিক ব্যক্তির হাতে বরাদ্দকৃত বাজেট পৌঁছাবে তো? এখানেও রয়েছে নানা প্রশ্ন, সংশয়। রক্ষক ভক্ষক হয়ে নিজের পকেটে সব ঢোকাবে না তো? আমরা দেখেছি, কোভিড-১৯ চলাকালে সরকারের দেয়া অনুদানগুলো কিভাবে রক্ষকেরা ভক্ষণ করেছে।
জনগণের সেবক, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যানদের কারসাজি। সুতরাং বাজেটে বরাদ্দ থাকলেই হবে না। সেই বরাদ্দটুকু সঠিক ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী ভূমিকা নিতে হবে। আসছে বাজেটে মধ্যবিত্তের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ দীর্ঘকালীন সংকটে ভালো নেই মধ্যবিত্ত। এদিকে পুঁজিতন্ত্রের বিশ্ববাসী যারা, তারা এই গরমে তাল মজিয়ে নিচ্ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মাথার উপরে কাঁঠাল ভেঙে মজা মেরে খাচ্ছেন ফজা ভাই। এদেরকে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। যতই ব্যয় কমানো হোক মানুষের প্রথম এবং প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য, তা তো বাদ দেয়া যাবে না।
রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার আশায় একটি চক্র কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি হু হু করে বাড়ছে ভোগ্য পণ্যের দাম। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা আর জোগানের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কিছু পণ্য আমাদের বার্ষিক চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হয় আবার কিছু পণ্যের সিংহ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের উৎপাদিত চালের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ কোটি ৯৫ লাখ টন যা আমাদের নিজেদের চাহিদার থেকে ৫০ লাখ টন বেশি। এ অর্থবছরের উৎপাদন পেঁয়াজের পরিমাণ ২৫ লাখ ৫ হাজার টন। ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১১ লাখ টন যার ৩০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত আর বাকি ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
অতএব কৃষিই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। অর্থনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সরিষা উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন। এদিকে দেশে যেহেতু প্রচুর ধান উৎপাদিত হয় রাইস ব্র্যান অয়েলের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর ও গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। তাতে কিছুটা হলেও বিদেশি সয়াবিন তেলের ওপর নির্ভশীলতা কমে আসবে। এ জন্য দরকার কৃষিখাততে শক্তিশালীকরণ, কৃষিতে বরাদ্দ বাড়ানো। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দরিদ্র্য কৃষকদেরকে সার, কীটনাশক ইত্যাদি কৃষি সরঞ্জাম দ্বার গোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে। এবারের অর্থবছরে আসছে বাজেট ব্যয় সংকোচনের দিকে নজর থাকবে। আমাদের বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। যেহেতু আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে সেহেতু প্রকল্পে সঠিক অগ্রাধিকার নির্ণয় করা জরুরি। চলমান প্রবৃদ্ধি ধরে রাখাই হবে আগামী অর্থবছরের মূল চ্যালেঞ্জ।
২০২২-২০২৩ অর্থ বাজেটে শিক্ষাখাত নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষাখাত সব সময়ই অবহেলিত। এবারের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কিছু বাড়ালেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কারণ করোনার সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত। দীর্ঘ দুই বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এ সময় অনেক ছেলেমেয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাল্যবিবাহের সংখ্যা ভয়ংকর ভাবে বেড়ে গেছে। যারা নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে ঝরে যাওয়া শিশুর মধ্যে তাদের সন্তানই বেশি। সুতরাং শিক্ষাখাতকে পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর্থিক সাহায্যের আশ্বাসে তাদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে।
আবার যারা লেখা পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে আসছে। গ্র্যাজুয়েট পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করার পরও চাকরি পাচ্ছে না। তাদের একটি অংশ বেকারত্বের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। আমাদের দেশের শিক্ষার মূল সমস্যা কোয়ালিটি এডুকেশনের অভাব। মানবহীন শিক্ষা নিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ ছেলেমেয়ে বেরিয়ে আসছে। সরকারের এদিকেও নজর দিতে হবে। নজর দিতে শিক্ষার মানের উন্নয়নের। সে জন্য দরকার কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষক। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। এদেশে শিক্ষকরা অর্থনৈতিকভাবে দীন। অনেকেই বাধ্য হয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বাজেটে শিক্ষক ভাতা চালু করণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি।
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, কুমুদিনী সরকারি কলেজ, টাঙ্গাইল।