মূল: কেনজাবুরো ওয়ি
দোকানের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা আফ্রিকার মানচিত্র। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্ড। স্লিভলেস ড্রেস পরা আকর্ষণীয় সেলসগার্লদের দিকে তাকাল সে। তাদের মনোযোগ অন্যদিকে। বাইরে গাঢ় হয়ে সন্ধ্যা নামছে। প্রথম গ্রীষ্মের যে প্রচণ্ড তাপমাত্রা, সেটা আর নেই। মৃত কোনো শরীরের মতোই ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে যেন। মধ্যাহ্নের উষ্ণতা মানুষকে নস্টালজিক করে দেয়। আনমনে দীর্ঘশ্বাস বের করে আনে।
জুন মাসের মাঝামাঝি। ঘড়িতে ঠিক সাড়ে ছয়টা। এই সময়ে শহরের একটা মানুষও আর ঘামছে না। কিন্তু বার্ডের স্ত্রী, যে শুয়ে আছে একটা রাবারের মাদুরের ওপর, সম্পূর্ণ নগ্ন শরীর, চোখ দুটো শক্ত করে বন্ধ করে রাখা, প্রত্যাশা, উদ্বেগ, কষ্ট আর যন্ত্রণায় তার সবটুকু গোঙানি আর ঘাম যেন নদী হয়ে ঝরছিল।
কেন যেন কেঁপে উঠল বার্ড। ঝেড়ে ফেলে ম্যাপের খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দিল সে এবার। শীতের সন্ধ্যার আকাশ যেমন জল ছলছল চোখের মতো দেখায়, তেমনি রঙের মহাসাগর ঘিরে রেখেছে আফ্রিকা মহাদেশকে। অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ রেখাগুলো যেন শুধুমাত্র কম্পাসের রেখা নয়, বরং তাতে বিমূর্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীর অস্থিরতা আর মানসিক বন্দিদশা। মহাদেশটাকে দেখাচ্ছে মাথা ঝুলিয়ে রাখা মানুষের কোনো খুলির মতোই। যেন বিশাল মাথাওয়ালা একটা মানুষ মাথা নীচু করে বিষণ্নভাবে তাকিয়ে আছে কোয়ালা, প্লাটিপাস আর ক্যাঙারুর দেশ অস্ট্রেলিয়ার দিকে। ম্যাপের নীচের কোণায় জনসংখ্যা নির্দেশক যে ক্ষুদ্রাকৃতির আফ্রিকা, সেটা দেখতে পচে গলে যেতে শুরু করা মৃত একটা মাথার মতো। আরেকটা অংশ যেটা পরিবহন রুট নির্দেশ করছে, সেটা চুলবিহীন শুধু চামড়ার একটা মাথার মতো, শিরাগুলো যেখানে ভয়ংকরভাবে প্রকট। ক্ষুদ্রাকৃতির এই দুই আফ্রিকাই যেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর আভাস দেয়, হিংস্র আর ভয়ংকর।
আমি কি অ্যাটলাসটা বের করে দেব?
না, না, তার দরকার নেই, বলল বার্ড। আমি আসলে ওয়েস্ট আফ্রিকা আর মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার মিশেলিন রোডম্যাপটা খুঁজছি। সিরিজ নাম্বার ১৮২ আর ১৮৫।
মিশেলিন ম্যাপ ভর্তি ড্রয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়ে খুঁজতে শুরু করে মেয়েটা।
যে ম্যাপটার জন্য বার্ডের দীর্ঘশ্বাস, সেটা আসলে দামি চামড়ায় মোড়ানো এমন একটা অ্যাটলাস, যেটা শুধুমাত্র ধনকুবের কোনো বাড়ির কফিটেবিলের পাশে জায়গা করে নেওয়ার উপযুক্ত। কয়েক সপ্তাহ আগে এই অ্যাটলাসটার দাম জিজ্ঞেস করেছিল বার্ড। ক্র্যাম স্কুল, যেখানে সে পড়ায়, সেখানকার পাঁচ মাসের বেতন লাগবে তার এটা কিনতে। আর পার্টটাইম দোভাষী হিসেবে কাজ করে যা আসে, সেটা অন্তর্ভুক্ত করলেও তার তিন মাস লেগে যাবে ওটার মালিক হতে। কিন্তু আপাতত বার্ডের এত বিলাসিতার সুযোগ নেই। নিজের পাশাপাশি তার স্ত্রী, এবং আসন্ন আরেকটা নতুন জীবনের দেখাশোনার দায়িত্ব তার কাঁধে। পরিবারের প্রধান তো সে-ই।
সেলসগার্ল লাল কাগজে মোড়ানো দুটি ম্যাপ টেবিলের ওপর আলাদা করে রাখল। বার্ডের নজর গেল মেয়েটার হাতের ওপর। সেগুলো অপরিষ্কার আর আঙুলগুলো কেমন ছোট ছোট। এমন ছোট যে, তার কেন যেন গিরগিটির পায়ের কথা মনে পড়ল, কোনো গাছের ডাল যেমন করে আঁকড়ে ধরে থাকে। গিরগিটির পায়ের নীচের মিশেলিন ট্রেডমার্ক চোখে পড়ল। কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে ম্যাপ দুটো কেনা বার্ডের কাছে এখন খুব অযৌক্তিক মনে হলো। অথচ এই জিনিসগুলো খুব যত্ন করে সে রেখে দিতে চেয়েছিল পরে কাজে লাগবে ভেবে।
অ্যাটলাসটা আফ্রিকার পৃষ্ঠাতেই কেন খোলা? জিজ্ঞেস করল বার্ড।
সেলসগার্ল তার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকাল। উত্তর দিল না। আফ্রিকার পৃষ্ঠাতেই কেন খোলা। ম্যানেজার কি ভেবেছে যে এই বইটাতে আফ্রিকার ম্যাপটাই সবচে’ সুন্দর? কিন্তু বর্তমান সময়ে আফ্রিকা যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে যে কোনো সময়ে বদলে যেতে পারে ম্যাপের চেহারা। যেটা দরকার ছিল, সেটা হলো এমন ম্যাপ, যেটা কখনও বদলে যাওয়ার আশংকা নেই। তাহলে কি আমেরিকাকে বেছে নেওয়া যায়? উত্তর আমেরিকা?
ম্যাপ কেনার জন্য টাকা বের করে দেয় বার্ড। যত্ন করে জ্যাকেটের ভেতরে ম্যাপ দুটো ঢুকিয়ে দেয়। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। এক পাশে টবে রাখা গাছ, আর আরেক পাশে দণ্ডায়মান নগ্নমূর্তি, এই দুইয়ের মাঝখান দিয়ে মাথা নীচু করে পার হয়ে আসে সে। মূর্তিটির নগ্ন পেট নিয়মিতভাবে বিভিন্ন হাতের স্পর্শ পেয়ে পেয়ে কুকুরের নাকের মতোই তেল চকচকে হয়ে আছে। বার্ড নিজেও যখন ছাত্র ছিল, এই জায়গা পার হয়ে যাওয়ার সময় এটার পেট ছুঁয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু আজ মূর্তিটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পেল না সে। সে বরং দেখল, ডাক্তার এবং নার্সরা তাদের হাত জীবাণুমুক্ত করে তার স্ত্রী যে টেবিলে শুয়েছিল, সেইখানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একজন ডাক্তারের হাতে কিছু চুল মাখামাখি হয়ে আছে।
ম্যাগাজিন কাউন্টারের ভিড় ঠেলে সে দরজার দিকে এগোয়। আফ্রিকার আরও দুটো ম্যাপ সে কিনেছিল বেশ আগে। ভেবেছিল পরে কাজে লাগবে। এখন বার্ড মাঝেমাঝেই ভাবে, এরকম দিন কি সত্যিই আসবে, যখন সে আফ্রিকার মাটিতে পা রাখবে, আর গাঢ় সানগ্লাসের ভেতর দিয়ে আফ্রিকার আকাশের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকবে? নাকি সে তার আফ্রিকা যাওয়ার সুযোগ একেবারেই হারিয়ে ফেলছে? সে কি তার একমাত্র এবং একমাত্র স্বপ্নকে বিদায় জানাতে বাধ্য হচ্ছে? আর যদি তাই হয়, তাহলে কি কোনো কাজই সে আজ পর্যন্ত ঠিকমত করতে পারল?
ক্রুদ্ধভাবে দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এল বার্ড। পা রাখল গ্রীষ্মের সন্ধ্যা নামা রাস্তায়। ফুটপাত মনে হচ্ছিল কুয়াশায় মোড়া। আসলে দুষিত বাতাস আর সন্ধ্যার বিষণ্ন আলো মিলেমিশে দেখাচ্ছে ওরকম। পাশের দোকানের চওড়া জানালায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়ে থেমে গেল বার্ড। বয়সের তুলনায় বেশ দ্রুত বয়সের ছাপ পড়ছে তার চেহারায়। কত বয়স তার? সাতাশ বছর চার মাস। বার্ড নামটা তাকে দেওয়া হয়েছিল তার পনের বছর বয়সে। তারপর থেকে সবাই তাকে পাখিই ডাকে।
কালচে জানালার কাচে ডুবে যাওয়া মৃতদেহের মতো ভেসে থাকা প্রতিচ্ছবিটাও কেমন পাখির মতোই লাগছে। ছোটখাট এবং রোগাটে শরীর তার। কলেজ ইউভার্সিটি পার করে চাকরি পাওয়ার পরপরই তার বন্ধুদের অনেকের ওজন বাড়তে থাকে। যারা হালকা পাতলাই ছিল, এমনকি তারাও বিয়ের পর মোটা হতে শুরু করেছে। শুধুমাত্র বার্ড, পেটে অল্প একটু পরিবর্তন ছাড়া রয়ে গেল আগের মতোই দুবলা পাতলা। এদিক ওদিক নড়াচড়া করল বার্ড। এখন তার প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছে ক্ষ্যাপাটে প্রাক্তন কোনো বৃদ্ধ ক্রীড়াবিদের মতো। তার কাঁধগুলো যে শুধু গুটিয়ে রাখা ডানার মতো দেখাত, তা নয়, তার অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্যও পাখির মতো ছিল। তার রঙ, তার নাকের গড়ন, মুখের ধরণ, সব কিছুর মধ্যেই একটা পাখি পাখি ব্যাপার ছিল। তার চোখে নিস্তেজ আলো, ভাবাবেগ কখনই তাতে প্রকাশ পায় না। বিষ্মিত হলে খানিকটা আভাস দেখা যায় মাত্র। তার পাতলা ঠোঁট শক্তভাবে চেপে বসে থাকে তার দাঁতের ওপর। তার সুউচ্চ চোয়ালের হাড় থেকে চিবুক পর্যন্ত রেখাগুলো একটা ত্রিভ‚জের মতো। মাথার লালচে চুল খাড়া খাড়া। পনেরতে বার্ডের চেহারা ছিল ঠিক এরকম। বিশ বছর বয়সেও তার কোনো পরিবর্তন হয় নি। আর কতকাল তাকে এরকম পাখির মতো দেখাবে? পনের থেকে পঁয়ষট্টি বছর পর্যন্ত একই চেহারা একই ভঙ্গি নিয়ে বেঁচে থাকা ছাড়া কি আর কোনো উপায় নেই? জানালার কাচের প্রতিচ্ছবির দিকে আবার তাকাল সে। এই কি তার সারাজীবনের অর্জন? ঘৃণায় কেঁপে উঠল বার্ড। তার রীতিমত বমি পাচ্ছে। কি জঘন্য একটা আবিষ্কার! ক্লান্তিকর, বৃদ্ধ অনুভ‚তি…
হঠাৎ কালচে জানালার ছায়ার ভেতর থেকে অদ্ভুত ধরনের এক মহিলা বার্ডের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল। প্রশস্ত কাঁধ, যথেষ্ট লম্বা মহিলা। এতটাই লম্বা যে জানালার কাচের ছায়ায় বার্ডের মাথা ছাড়িয়ে তারও ওপরে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল। বার্ডের মনে হচ্ছিল যেন বিশালাকৃতির এক দৈত্য তাকে পেছন থেকে তাড়া করছে। আস্তে করে ঘুরে দাঁড়াল বার্ড। মহিলা ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বার্ডও একই রকম দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল। কয়েক সেকেন্ড পরেই মহিলার শক্ত কঠিন দৃষ্টি বদলে যেন নরম হতে শুরু করল। তখনও নিশ্চিত নয়, কিন্তু কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর আবার হঠাৎ করেই বুঝতে পারল, সে ভুল ভাবছে। বার্ডও তার পরিবর্তন বুঝতে পারল। স্বর্ণকেশী এই মহিলার মুখ তাকে ফ্রা অ্যাঞ্জেলিকোর এক দেবীমূর্তির কথা মনে করিয়ে দিল।
হেই! পুরুষালী কন্ঠে কিছুটা সন্ধির আভাস। যেন ভুল বোঝাবুঝিটা ভুলে যেতে বলছে।
হ্যালো! বার্ডও খুব দ্রুত একটা হাসি টেনে তার অভিবাদন ফিরিয়ে দিল। পাখি স্বভাব।
হাই হিলে খটখট শব্দ তুলে রাস্তায় নেমে গেল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষটা। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বার্ড। তারপর অন্য দিকে হাঁটতে শুরু করল। সতর্কভাবে একটা সরু গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটা ধরল সে।
সেই বৃহন্নলা আমাকে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখে ভেবেছিল, আমি হয়ত কারও জন্য অপেক্ষা করছি, বিকৃত মানসিকতার কেউ ভেবেছিল আমাকে। অপমানজনক। কিন্তু সে তার ভুল স্বীকার করার সাথে সাথে আমি ওই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছি। যাক বাবা, সম্মানটা তো ঠিক থাকল। আর এখন ওর মুখোমুখি হওয়ার ব্যাপারটা ভাবতে মজাই লাগছে। হেই! এই অভিবাদনের চেয়ে এই অবস্থায় আর কোনো শব্দ বোধহয় উপযুক্ত হতে পারত না। আর তার আচরণ দেখে বোঝা গেল বৃহন্নলা হলেও বুদ্ধিবৃত্তি বেশ ভালো।
মহিলার পোশাকের আড়ালে ছেলেটার প্রতি হঠাৎ করেই বার্ড অদ্ভুত এক মায়া বোধ করতে শুরু করল। আজ কি সে কোনো শিকার ধরতে সফল হবে? আমারই হয়ত তার সাথে যাওয়ার সাহস করে ওঠা উচিত ছিল।
বার্ড কল্পনা করতে শুরু করল, যদি সেই ছেলেটির সাথে সে চলেই যেত, তাহলে কী কী হতে পারত। হয়ত শহরের কোনো সস্তা বার বা রেস্টুরেন্টের উদ্দাম কোনো কর্নারে সময় কাটাতাম একসাথে। হয়ত আমরা নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকতাম পাশাপাশি, ভাইয়ের মতো, এবং গল্প করতাম। আমিও নগ্ন হতাম, যেন ছেলেটা কোনো অস্বস্তিতে না পড়ে। হয়ত তাকে বলতাম, আমার স্ত্রী আজ প্রথমবার সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে। হয়ত এটাও বলতাম, আমি সবসময় আফ্রিকা যেতে চেয়েছিলাম। এবং আমার সবচে বড় স্বপ্ন ছিল আফ্রিকা থেকে ফেরার পর আমার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়ে একটা বই লিখব, যে বইটার নাম হবে, আফ্রিকার আকাশ। তাকে হয়ত আরও বলতাম, বাচ্চাটা যদি পৃথিবীতে এসেই যায়, তাহলে সংসারের খাঁচায় বন্দি হয়ে পড়তে হবে। আর তখন একা একা আফ্রিকা যাওয়াটা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য বিয়ের পর থেকে আমি খাঁচাতেই বন্দি। তবুও সে খাঁচার দরজাটা খোলা মনে হতো। এখন বাচ্চাটার জন্মের পর তো বোধহয় সেই দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আরও অনেক অনেক বিষয় নিয়ে তার সাথে কথা বলতাম আমি। যে ব্যাপারগুলো আমাকে ভাবাচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছি, সেগুলো শুনে ছেলেটাও কষ্ট পেত। সমব্যথী হয়ে উঠত। বিশেষ করে যে রাস্তায় রাস্তায় বিকৃত মানসিকতার লোকজন খুঁজে বেড়ায় সমাজ রক্ষার জন্য, তার একটা সংবেদনশীল মন তো থাকার কথা।
পরের দিন হয়ত রেডিওতে খবর শুনতে শুনতে দুজন একইসাথে দাড়ি কাটতাম, একই শেভিং ফোম ব্যবহার করে। ছেলেটার বয়স কম হলেও দাড়ি বেশ ঘন মনে হয়েছিল আর… কল্পনা থামিয়ে বার্ড নিজের মনেই হাসল। তার সাথে রাত কাটানো সুদূরপ্রসারী ব্যাপার, কিন্তু একটা ড্রিংক নেওয়ার জন্য ছেলেটাকে আমন্ত্রণ জানানো যেতেই পারত।
বার্ড যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, তার দুই পাশেই সারি সারি সস্তা বার। আশেপাশে মাতালের ছড়াছড়ি। তার নিজের গলাও শুকিয়ে আছে মনে হলো। লম্বা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল সে। একটা বারে ঢুকে গলা ভেজানোর ইচ্ছে। বার্ড আন্দাজ করতে পারে, হুইস্কির গন্ধ মুখে নিয়ে সে যদি বউ আর সদ্যজাত বাচ্চাটার কাছে যায়, তাহলে তার শাশুড়ির প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে। সে চায় না তার শ্বশুর শাশুড়ি তাকে মাতাল অবস্থায় দেখুক। অন্তত আবার না।
বার্ডের শ্বশুর কিছুদিন হলো একটা প্রাইভেট কলেজে লেকচারার হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু রিটায়ার করার আগে পর্যন্ত তিনি বার্ডের ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। ক্র্যাম স্কুলে বার্ড যে এই বয়সেও একটা চাকরি জোগাড় করতে পেরেছে, সেটা শুধুমাত্র তার শ্বশুরের কারণে। বার্ড বৃদ্ধ লোকটাকে ভালোবাসে। তার প্রতি কৃতজ্ঞ সে। তার শ্বশুরের মতো বিশাল হৃদয়ের লোক সে কমই দেখেছে। লোকটাকে আবারও নিরাশ করতে চায় না সে।
বার্ড যখন বিয়ে করে, বয়স তখন পঁচিশ। সেটা ছিল মে মাস। আর সেই প্রথম গ্রীষ্মে সে টানা চারমাস পাঁড় মাতাল হয়েছিল। হঠাৎ করেই সে মদের সাগরে ভেসে যেতে শুরু করে। মদের নেশায় আচ্ছন্ন এক রবিনসন ক্রুসো। গ্রাজুয়েট ছাত্র হিসেবে তার সমস্ত দায়িত্ব, পড়াশুনা, চাকরি, সবকিছুকে অবহেলা করে বার্ড তার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের অন্ধকার রান্নাঘরে বসে সারাদিন রাত রেকর্ড শুনত আর হুইস্কি খেতো। সেই ভয়ংকর দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকালে বার্ড বুঝতে পারে যে গান শোনা, মদ খাওয়া, আর মাতাল ঘুম ছাড়া মানুষের করার মতো কোনো কাজই সে করে নি সেই দিনগুলোতে। পাক্কা এক মাস পর বার্ড সেই সাতশ’ ঘন্টার মাতাল নেশা থেকে নিজেকে টেনে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়। দুর্ভাগ্য তার, নিজেকে আবিষ্কার করে ভিন্নভাবে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোনো পরিত্যক্ত শহরের নির্জনতা যেন তার ভেতর। মানসিকভাবে ভেঙে পড়া এমন একজন, যার সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছিল। তার ভেতরের মরুভ‚মিই শুধু নয়, তাকে বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত সম্পর্কগুলো স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রাণপণ লড়াই করতে হচ্ছিল। ইউভার্সিটির পাট চুকিয়ে দিয়ে বার্ড তার শ্বশুরকে শিক্ষকতার একটা চাকরি খুঁজে দিতে বলে। আর এখন, তার দুই বছর পর, সে অপেক্ষা করছে, তার স্ত্রীর প্রথম বাচ্চার জন্মের জন্য। জন্ম নিক। রক্তে মাখামাখি হয়ে জন্ম নেওয়ার পর অ্যালকোহলের গন্ধ কি তখন নিজের রঙ দেখাবে? তার শাশুড়ির কথা ভেবে হাসি পেল।
অ্যালকোহলের প্রতি বার্ডের খুব গভীরে প্রচণ্ড এক তৃষ্ণা কাজ করে, এবং এটা নিয়ে সে খুব সতর্ক থাকার চেষ্টা করে। হুইস্কিতে ডুবে থাকার সেই যে ভয়ংকর চার সপ্তাহ, তারপর সে প্রায়ই নিজেকে জিজ্ঞেস করত, সেই সাতশ’ ঘণ্টা মাতাল সে আসলে কেন থেকেছিল? কিন্তু সদুত্তর পায় না কোনো। হুইস্কিতে ডুবে থাকার আসল কারণটা যতদিন তার নিজের কাছেই ধাঁধা হয়ে থাকবে, ততদিনই যে কোনোদিন আবার সেই একই গর্তে পড়ার একটা সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আফ্রিকা নিয়ে যে বইগুলো বার্ড খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিল, তার মধ্যে একটা বইয়ের একটা অংশ মনে পড়ল তার। ‘আফ্রিকার গ্রামগুলোতে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যাওয়াটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। যেটা নির্দেশ করে, এই সুন্দর দেশেও কিছু কিছু মৌলিক ব্যাপারে লোকজনের অসন্তোষ রয়েছে। এই মৌলিক অসন্তোষই আফ্রিকান গ্রামবাসীদের হতাশ করে তোলে, আর সেই হতাশা থেকেই মাতাল হতে প্ররোচিত হয় তারা।’ এই অংশটা আরও একবার পড়ল বার্ড। তার মনে হলো, তার নিজের জীবনেও কিছু অসন্তোষ, কিছু অপ্রাপ্তি আছে, যেগুলো সে হয়ত নিজের কাছেই আড়াল করতে চায়। কিন্তু সেগুলো তো নিশ্চিতভাবে আছেই। আর তাই অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকার এই সতর্ক চেষ্টা।
হংকি টংকের পেছনের চত্বরে ঢুকল বার্ড। এখানকার কোলাহল আর গতি চোখে পড়ার মতো। সামনেই একটা থিয়েটার। তার ফ্ল্যাশলাইটে সন্ধ্যা সাতটা জ্বলজ্বল করছিল। এখন তার স্ত্রীর খবর নেওয়ার সময়। সেদিন বিকেল তিনটার পর থেকে প্রতি ঘন্টায় সে তার শাশুড়িকে ফোন করেছে। চারপাশে তাকাল বার্ড। প্রচুর পাবলিক টেলিফোন বুথ, কিন্তু সবগুলোই ব্যস্ত। শাশুড়ির কথা মনে হওয়ায় অস্বস্তি জাগল আবার। হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকে মহিলা এই চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন যে, হাসপাতালের কর্মী যারা আছে, সবাই তাকে অবহেলা করছে, অপমান করার চেষ্টা করছে। ইস্! ফোনের অপর প্রান্তে যদি অন্য কোনো আত্মীয় থাকত! বার, কফিহাউজ, চাইনিজ ন্যুডলস শপ, কাটলেট রেস্তোরাঁ এবং জুতার দোকান, সবকিছুর ওপর নজর বুলিয়ে নিল সে। যে কোনো দোকানের ভেতরে গিয়েই ইচ্ছে করলে সে ফোন করতে পারে। কিন্ত সে আসলে যে কোনো বার এড়িয়ে যেতে চাইছিল। ইতিমধ্যেই সে তার ডিনার সেরে নিয়েছে। পেট ঠিক করার জন্য ওষুধ কেনার প্রয়োজন বোধ করছে।
একটা ওষুধের দোকান খুঁজছে বার্ড। রাস্তার পাশে একটা বিদেশি দোকান দেখে থেমে গেল সে। দরজার ওপর যে বিশাল বিলবোর্ড, সেখানে একজন কাউবয় পিস্তল হাতে জ্বলজ্বল করছে। দোকানের নাম, ‘গান কর্নার’। লাল নীল কাগজ দিয়ে ঘেরা কাচের দরজার পেছনে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ভিড়। জুক বক্সে রক-এন-রোল চিৎকার করে যাচ্ছে। কান ফাটানোর মতো জোরালো শব্দ। ডার্ট গেম, বিভিন্ন পাজল, লাক গেমস আর আড্ডাবাজি চলছে ধুমতালে। এর এক কোণায় পাবলিক টেলিফোন। বিভিন্ন গেমস আর ভিড় পার করে অবশেষে বার্ড টেলিফোনের কাছে পৌঁছাতে পারল। কয়েকটা কয়েন ফেলে সে হাসপাতালের নাম্বার মুখস্ত ডায়াল করল। এক কানে সে শুনতে পাচ্ছে ওপাশে বেজে যাওয়া রিং, আরেক কানে রক-এন-রোলের চিৎকার। কে জানে তার শাশুড়ি এই শব্দ শুনে কী ভাববে। হয়ত দেরি করে ফোন করার অজুহাত হিসেবে বার্ড এইসব গোলমাল আর শব্দ কাজে লাগাতে পারবে।
চারবার ফোন বাজার পর শাশুড়ি ফোন ধরলেন। তার কন্ঠ অনেকটা বার্ডের স্ত্রীর কন্ঠস্বরের মতোই, শুধু তার স্ত্রীরটায় আরেকটু তারুণ্য মেশানো। কোনোরকম অজুহাত না দেখিয়েই বার্ড তার স্ত্রীর কথা জিজ্ঞেস করল।
‘এখনও না। জন্ম মৃত্যুর মাঝখানে লড়ছে বাচ্চাটা। মনে হয় না সে পৃথিবীর মুখ দেখতে পারবে।’
ভাষাহীন বার্ড রিসিভারের দিকে নিশ্চল তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। সে নিজেও জানে না কী ভাবছে সে। ‘আমি আটটায় ফোন করব।’ ফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ফোনের পাশে ‘ড্রাইভ আ কার’ গেম চলছে। খুব সম্ভব ফিলিপিনো হবে, একটা ছেলে ছোট সাইজের একটা জাগুয়ারের ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। নীচের বোর্ড একটা অক্ষকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত ঘুরছে। বিভিন্ন ছোটখাট অন্য গাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। ছেলেটার কাজ হলো ঘুর্ণায়মান এই মেঝেতে সেগুলোর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে দ্রুতগতিতে ড্রাইভ করা। সে তাই করছে। গতি তার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। উত্তেজনায় তার মুখ অল্প হা করে আছে, কখনও সজোরে কামড়ে ধরছে নিজের ঠোঁট। বোর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ খেলা দেখল বার্ড। ভীষণ ক্লান্ত বোধ করছে সে। পা যেন আর শরীরের ভার নিতে পারছে না। পিছিয়ে আসল সে। বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াল। মেঝের ধাতব প্লেটগুলো বিভিন্ন রঙ এ জ্বলছে আর নিভছে। মনে হচ্ছে যেন পায়ে লাগছে। গ্যালারির পেছনের দিকে অদ্ভুত এক জোড়া মেশিন দেখতে পেল।
ডান দিকের মেশিনটা ঘিরে আছে এক দংগল ছেলে, তাদের গায়ে সোনা আর রুপা দিয়ে কারুকাজ করা ড্রাগনওয়ালা সিল্কের পোশাক, আমেরিকান ট্যুরিস্টদের জন্য হংকং এর স্যুভেনির। তারা জোর গলায় অচেনা সব শব্দে চিৎকার করছে। বাম দিকের মেশিনটা সেই মুহুর্তে খালি ছিল বলে বার্ড সেদিকেই এগুলো।
আদতে এটা ছিল আয়রন মেইডেন, মধ্যযুগীয় নির্যাতনের একটা যন্ত্র। মানুষ সমান একটি নারীমূর্তি, লাল কালো ডোরাকাটা ধাতব বাহু দিয়ে তার নগ্ন বুক ঢেকে রাখার চেষ্টা করছে। এক খেলোয়াড় সেই ধাতব বাহু টেনে সরানোর চেষ্টা করছে, নগ্ন বুক এক ঝলক দেখা যায় কি না, সেই প্রত্যাশায়। এই যে আঁকড়ে ধরা আর টান দেওয়া, সেগুলো সংখ্যা হিসেবে দৃশ্যমান হচ্ছিল আয়রন মেইডেনের চোখে, চোখের জানালায়। আর তার মাথার ওপর আছে এইসবকিছুর গড় হিসেব রাখার সারনী।
বার্ড মেইডেনের দুই ঠোঁটের মাঝখানে কয়েন ঢুকিয়ে দিল। তারপর সে জোর করে তার হাত দুটি বুক থেকে সরানোর চেষ্টা করল। ধাতব বাহু দুটো একগুঁয়ে নারীর মতোই প্রতিবাদের চেষ্টা করছে। কিন্তু বার্ড আরও জোরে চেষ্টা করেই যেতে থাকল। ধীরে ধীরে তার মুখটা মেইডেনের ধাতব বুকের কাছাকাছি সরে এল। মেইডেনের ধাতব মুখটায় সুস্পষ্ট যন্ত্রণার অভিব্যক্তি আঁকা। বোধহয় সে কারণেই বার্ডের এক সময় মনে হলো সে যেন মেয়েটাকে ধর্ষণ করছে। তবুও তার শরীরে যতক্ষণ শক্তি ছিল, বার্ড মেইডেনের হাত ধরে জোর টানাটানি করেছে। হঠাৎ একটা গিয়ার টান দেওয়ার পরেই মেইডেনের বুকের ভেতর কেমন যেন ঘড়ঘড় শব্দ হলো। এবং তার চোখে কিছু সংখ্যা দেখা গেল।
নিস্তেজ বার্ড খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে দাঁড়িয়ে গড় সারনীতে তার স্কোর দেখল। ইউনিটগুলো দিয়ে আসলে কী বোঝায়, ব্যাপারটা তার কাছে অস্পষ্ট । ওখানে দেখল ধরার জন্য সত্তর পয়েন্ট আর টানার জন্য পঁচাত্তর পয়েন্ট ফুটে আছে। সাতাই-এর নীচে লেখা কলামে ফুটে আছে, গ্রিপ একশ’ দশ, পুল একশ’ দশ। টেবিল স্ক্যান করে সে দেখল, তার যে গড় স্কোর সেটা চল্লিশ বছর বয়সীদের গড়পড়তা স্কোরের সমান। চল্লিশ! সাতাশ বছর চার মাস বয়স তার। আর সে কিনা চল্লিশ বছরের স্কোর অতিক্রম করতে পারল না! এটা কিভাবে সম্ভব? সে অবশ্য বলতে পারত যে তার কাঁধ এবং মাসল পেইনের কারণেই এমনটা হয়েছে হয়ত। কিন্তু তার মনে হলো হারানো সম্মান পুনরুদ্ধার করা দরকার। সে ডানদিকের গেইম খেলার জন্য এগিয়ে গেল। বিস্ময়ের সাথে সে উপলব্ধি করল যে প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়েই সে শক্তি পরীক্ষার এই খেলায় অংশ নিতে চাচ্ছে।
বার্ড যখন খেলতে এল, বন্য প্রাণীর মতো সচকিত হয়ে উঠল ড্রাগন জ্যাকেট পরা ছেলেগুলো, যেন তাদের নিজস্ব এলাকা আক্রান্ত হয়েছে। বার্ডের মুখভঙ্গি যে কোনো চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তাদের মাঝখানে রাখা মেশিনটায় হাত বুলিয়ে ভালোভাবে দেখে নিচ্ছে সে। মেশিনটা দেখতে খানিকটা ফাঁসির মঞ্চের মতো, ওয়েস্টার্ন মুভিগুলোতে আমরা যেমন দেখি। পার্থক্য শুধু এটাই, যেখানে অপরাধীকে ঝুলানোর কথা, সেইখানে একটা বালির বস্তা। কালো চামড়ায় আবৃত। মাথাটা হেলমেটে ঢাকা। যখন হেলমেটের চোখের ফাঁকা জায়গায় কয়েন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তখন খেলোয়াড় বস্তাটা নামিয়ে নিতে পারে। এবং একই সাথে ইন্ডিকেটরের কাঁটা শূন্য নির্দেশ করে নিজেকে রিসেট করে নেয়। ইন্ডিকেটরের মাঝখানে একটা রোবটিক ইঁদুরের কার্টুন। তার হলুদ মুখ পুরোটা হা করা। যেন চিৎকার করে বলছে, এসো! তোমার শক্তি পরীক্ষা করে দেখে যাও!
সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ বার্ডের মধ্যে দেখা গেল না। তখন ড্রাগন জ্যাকেটদের মধ্যে একজন এগিয়ে এল সামনে, হেলমেটের ভেতর কয়েন ফেলল, বালির বস্তা টেনে নামাল নীচের দিকে। আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে গেল। তারপর নাচের মুদ্রার মতো করে তার পুরো শরীর যেন ছুঁড়ে দিল বস্তার দিকে। প্রচণ্ড ধাক্কার শব্দ হলো। হেলমেটের ভেতর শেকলের সাথে ঘষা খেয়ে বিকট শব্দ হলো। ইন্ডিকেটর এর কাঁটাটি সব সংখ্যা অতিক্রম করে লাফিয়ে উঠে কাঁপতে থাকল। পুরো দল হাসিতে ফেটে পড়ল। ছেলেটির পাঞ্চ, ইন্ডিকেটরের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। বিজয়ী ড্রাগন জ্যাকেট এবার কারাটে স্টাইলে অপেক্ষাকৃত কম জোরালো একটা লাথি ছুঁড়ল বস্তায়। এবার ইন্ডিকেটর এর কাঁটা নেমে এল পাঁচশ’-তে। বস্তাটা যেন এবার হামাগুড়ি দিয়ে নিজ জায়গায় ফিরে গেল। আবারও হুল্লোড় তুলল ছেলেরা।
একটা অদ্ভুত আবেগ ভর করল বার্ডের ওপর। ম্যাপগুলো যেন কুঁচকে না যায়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রেখে জ্যাকেট খুলে একটা টেবিলের ওপর রাখল। হাসপাতালে ফোন করার জন্য পকেটভর্তি করে কয়েন রেখেছে সে। সেখান থেকে একটি কয়েন নিয়ে হেলমেটের ভেতর ফেলল। ছেলেরা মনোযোগ দিয়ে বার্ডের প্রতিটি নড়াচড়া দেখছে। বার্ড বস্তাটা টেনে নামাল, এক পা পিছিয়ে গেল, এবং মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ওপরে তুলল। হাইস্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করার পর কলেজে ভর্তির জন্য যখন সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার শহরের বখাটেদের সাথে তার হাতাহাতি হতো। তার আশেপাশের ছেলেপেলেরা তার প্রশংসা করত। নিজের পাঞ্চের ওপরে বার্ডের বিশ্বাস ছিল। অকারণ আত্মতুষ্টিতে ভোগার মতো মানুষ সে নয়। শরীরের ভর এক পা থেকে অন্য পায়ে নিল সে। হালকা পায়ে এক ধাপ এগিয়ে ডান হাতে সমস্ত শক্তি দিয়ে জোরালো একটা ঘুসি ছুঁড়ল সে। তার ঘুসি কি দুই হাজার পাঁচশ’ পার করে যন্ত্রটাকে বিকল করে ফেলেছে? বলে কি যন্ত্রটা! ইন্ডিকেটর এ কাঁটা তিনশ’-তে! ঘুসিটা যেন দ্বিগুণ হয়ে এসে আঘাত করল বার্ডের বুকে। হতবাক হয়ে ইন্ডিকেটর এর দিকে তাকিয়ে থাকল বার্ড। গরম রক্ত ছলকে উঠে এল মুখে। ড্রাগন জ্যাকেট পরা ছেলেগুলোও চুপ হয়ে গেছে। তারা একবার বার্ডকে দেখছে, আরেকবার ইন্ডিকেটর। প্রচণ্ড বেগ নিয়ে ঘুসি ছোঁড়া মানুষটার সাথে ইন্ডিকেটরের নির্দেশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ লাগছে বোধহয় তাদের কাছেও।
পুরো দলটার যেন অস্তিত্বই নেই, বার্ড আরেকটা কয়েন নিয়ে ঢুকিয়ে দিল হেলমেটের ভেতর, নামিয়ে নিল বস্তাটা। স্টাইল নিয়ে ভাবাভাবির সময় নেই এখন। শরীরের সমস্ত ভর আর শক্তি দিয়ে পাঞ্চ বসিয়ে দিল সে। কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত পুরো অসাড় হয়ে গেল তার ডান হাত। তাকিয়ে দেখল, কাঁটা পাঁচশ’ এর ঘর ছুঁয়ে আছে।
মুখ ঘুরিয়ে নীচু হয়ে জ্যাকেট তুলে নিল বার্ড। টেবিলের দিকে মুখ রেখেই জ্যাকেট পরে নিল সে। তারপর ঘুরলো ছেলেগুলোর দিকে। একজন প্রাক্তন চ্যাম্পিপয়ন দীর্ঘ অবসর থেকে যখন জুনিয়রদের মাঝখানে আসে, সেইরকম করে হাত নেড়ে অভিজ্ঞ একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল তাদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ছেলেগুলা শক্ত মুখে শূন্যদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকল লোকটার দিকে, যেন তারা কোনো কুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। সমস্ত কান চোখ মুখ উত্তপ্ত লাল হয়ে আছে বার্ডের। মাথা নীচু করে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল সে। তার পেছনে ফুটে উঠল আলোর কিছু ঝাড়বাতি।
একরাশ লজ্জা ঘিরে আছে বার্ডকে। চত্বরের মূল রাস্তা পাশ কাটিয়ে অন্ধকার একটা গলিতে ঢুকে পড়ল সে। অপরিচিত লোকের ভিড়ের সাথে চলার সাহসও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। এই রাস্তায় প্রচুর নিশিথিনী। তারা খদ্দেরকে বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বার্ডের চেহারার বর্তমান কাঠিন্য তাদেরকে তার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বড় বাধের কাছে এসে দাঁড়াল বার্ড। এখানে ঘাসের তাজা গন্ধ পাচ্ছে সে। তারমানে সামনে ঘাসের ঢাল। বাধের ওপর রেললাইন। ট্রেন আসছে কি না বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু নিকষ কালো অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। আকাশের দিকে তাকাল। সেটাও যেন কালো কালি দিয়ে আঁকা। মাটির ওপরে লালচে কুয়াশার মতো একমাত্র যে আলো, সেটা চত্বরের নিয়নের আলোর প্রতিফলন। এক ফোঁটা বৃষ্টি বার্ডের গাল ছুঁলো। বৃষ্টি আসবে বলেই হয়ত ঘাসের সুবাস এত তীব্র। মাথা নীচু করল বার্ড। আর কিছুই করার নেই। তাই যেন হিসু করল সে। শেষ করার আগেই পেছনে বিশৃঙ্খল পায়ের শব্দ শোনা গেল। পেছন ফিরে দেখতে পেল, ড্রাগন জ্যাকেটের ছেলেগুলো ঘিরে ফেলেছে তাকে।
ছেলেগুলোর পেছনে ক্ষীণ অন্ধকার। সামনের গাঢ় অন্ধকারে তাদের বৈরি মনোভাব সুস্পষ্ট দেখা না গেলেও সেটা অনুভব করতে পারছে বার্ড। গান কর্নারে বার্ডের উপস্থিতি এবং তার কর্মকাণ্ড ওরা ভালোভাবে নেয় নি। দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার বা যন্ত্রণা দেওয়ার যে একটা সহজাত কিন্তু অসভ্য প্রবৃত্তি আছে, সেটা তাদের মধ্যে জেগে উঠেছে। নেকড়ের দল একটা ভীত মেষ শাবককে তাড়া করছে যেন। বার্ড খুব ভয় পেল। আতিপাতি করে উদ্ধার পাওয়ার উপায় খুঁজছে সে। একটাই উপায় দেখতে পাচ্ছে। আলোকিত চত্বরে পৌঁছাতে হলে তাকে ওদের শক্ত বৃত্ত ভেঙে ওর ভেতর দিয়েই দৌড় লাগাতে হবে। কিন্তু তার শক্তি তো প্রশ্নাতীতভাবেই চল্লিশ বছর বয়সির আঁকড়ে ধরা আর টেনে ধরা। পালাতে পারলেও ড্রাগন জ্যাকেটের দল ঠিক তাকে ফিরিয়ে আনবে আবার।
ডানদিকে একটা কানাগলি, একটা বেড়াতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে, সেটা বোর্ডের তৈরি। আর বামদিকে বাধ আর একটা ফ্যাক্টরির সীমানার কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে দিয়ে একটা সরু গলি। প্রায় একশ’ গজের মতো দূরত্ব পার হতে পারলে ওপাশের ব্যস্ত আলোকিত রাস্তায় পড়া যাবে। ধরা না পড়ে যদি এইটুকু দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে, তাহলে এ যাত্রায় বার্ড বেঁচে যাবে। একটা চাল চালল বার্ড। ডানদিকের কানাগলির দিকেই দৌড় দিচ্ছে এরকম একটা শুরু করেও বাউলি কেটে বাম দিকের গলির দিকে দৌড় লাগাল সে। দেখা গেল প্রতিপক্ষ এইসব চালাকি ধরে ফেলায় বেশ ওস্তাদ। বোকা না হয়ে ড্রাগন গ্যাং দিব্যি আবার বার্ডকে ঘিরে রাখতে সক্ষম হলো। বার্ড আবারও সোজা হয়ে দৌড় লাগাতে যাবে, কালো একটা ছায়ার সাথে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেল যেন। পুরো শরীর ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেল সামনের দিকে। সেই বালির বস্তায় যে আঘাত যন্ত্রটাকে প্রায় বিকল করে দিয়েছিল, সেই একই ওজনের পাঞ্চ পেটে নিয়ে বার্ড ছিটকে পড়ল রাস্তায়। আর্তনাদ করতে করতে সে একদলা থুথু ফেলল, রক্তমাখা। তীক্ষèভাবে হেসে উঠল ছেলেগুলো। পাঞ্চিং মেশিন নষ্ট হয়ে গেলে যেভাবে হেসেছিল ওরা, সেইভাবে। আস্তে আস্তে ওরা ওদের বৃত্ত আরও ছোট করে আনলো। অপেক্ষা করছে ওরা।
বার্ডের মনে হলো মাটি এবং তার শরীরের চাপায় পড়ে ম্যাপগুলো নিশ্চয়ই কুঁকড়ে যাচ্ছে। ওদিকে তার বাচ্চাটা জন্ম নিচ্ছে। এই দুই চিন্তা নতুন করে ভাবালো তাকে। প্রচণ্ড রাগ হলো, সেইসাথে হতাশা। এতক্ষণ পর্যন্ত আতংক আর বিভ্রান্তিতে পড়ে সে কেবল পালানোর কথাই চিন্তা করছিল। এখন সে ঘুরে দাঁড়াবার কথা ভাবল। এখন যদি আমি রুখে না দাঁড়াই, লড়াই না করি, আমার আফ্রিকা যাওয়ার স্বপ্ন যে ধূলিস্যাৎ হবে, শুধু তাই না। আমার বাচ্চাটা এই পৃথিবীতে আসবে একটা পরাস্ত জীবন যাপন করার জন্য। ভেতর থেকে নতুন করে অনুপ্রেরণা জাগল। বার্ডও সেটা বিশ্বাস করল।
বৃষ্টির ফোঁটা তার আহত ঠোঁট ছুঁলো। মাথা নাড়ল বার্ড, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু আস্তে আস্তে উঠল সে। তাকে ঘিরে থাকা অর্ধবৃত্ত একটু পিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মধ্যে সবচে আত্মবিশ্বাসী জন এক ধাপ এগিয়ে এল। বার্ড ছেলেটির হাত তার চিবুক পর্যন্ত এগিয়ে আসতে দিল। অলসভাবে পড়ে থাকল সে। লক্ষ্য ঠিক করে ড্রাগন জ্যাকেট এক পা তুলল, আঘাত করার জন্য ডান হাত যতখানি পেছনে নেওয়া যায়, নিল, এবং মারার জন্য রেডি হলো। বার্ড মাথা একটু নীচু করল, তারপর ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের মতো প্রচণ্ড গতিতে ছেলেটার পেটে আঘাত করল। ককিয়ে উঠল ছেলেটা, বমি করতে করতে তার ওপরে পড়ে গিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। মাথা ঝাঁকিয়ে বার্ড আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। অন্যদের মুখোমুখি হলো। এইমাত্র যুদ্ধজয় তার ভেতর নতুন শক্তি এনে দিয়েছে, অনেক বছর পর এই অনুভ‚তির অনুভব। বার্ড এবং প্রতিপক্ষরা নিঃশব্দে একে অপরকে মাপছে। কিছু সময় পার হলো। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল, চলো চলো, এই বুড়ো লোকটার সাথে মারামারির কোনো মানে হয় না। চলো। তারা তাদের অচেতন কমরেডকে তুলে নিয়ে বার্ডকে বৃষ্টির মধ্যে একা ফেলে চলে গেল। বার্ডের হঠাৎ হাসি পেল। মিনিটখানেক একা একাই হাসলো । তার জ্যাকেটে রক্ত লেগে আছে। তবে বৃষ্টির মধ্যে আর কিছুক্ষণ হাঁটলে সেটা আর থাকবে না। বার্ডের শান্তি লাগছে এখন। চিবুকের যে জায়গাটাতে ঘুসি খেয়েছিল, জায়গাটা ব্যথা করছে। ব্যথা করছে সারা শরীর। সেই সাথে দুই চোখ। কিন্তু তার স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার পর এই প্রথম সে নিজের ভেতরে প্রাণ অনুভব করল। ফ্যাক্টরি আর বাধের মাঝখানের গলিতে লুটিয়ে পড়ল বার্ডের শরীর। অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা ট্রেন ট্র্যাকে এসে পড়ল। বার্ডের মাথার ওপর দিয়ে যখন ট্রেনটি পার হচ্ছে, মনে হচ্ছিল বিশাল কালো এক জলহস্তী যেন কালো আকাশটাকে গ্রাস করে নিচ্ছে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যখন বার্ড একটি ক্যাবের জন্য অপেক্ষা করছে, তার জিভ মুখের ভেতর একটি ভাঙা দাঁত খুঁজছে। পেয়ে গেল, থু করে সেটা ফেলল রাস্তায়।
চলবে
উপন্যাস: ‘এ পারসোনাল ম্যাটার’ (একটি ব্যাক্তিগত ব্যাপার)
ঔপন্যাসিক: কেনজাবুরো ওয়ি
নোবেলজয়ী সাহিত্যিক কেনজাবুরো ওয়ি জাপানের মূল দ্বীপগুলোর মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে ছোট শিকোকুতে ১৯৩১ সালে জন্মছিলেন। সাত ভাইবোনোর মধ্যে তৃতীয় ওয়ির বাবা মারা যান ১৯৪৪ সালে। তারপর মায়ের কাছে বেড়ে উঠেছেন। শৈশবেই ওয়ির মধ্যে সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন তার মা।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি সাহ্যিত্যে ¯œাতক সম্পন্ন করা কেনজাবুরো ওয়ির লেখালেখির শুরু ছাত্রাবস্থাতেই। ১৯৫৮ সালে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় জাপানের বিখ্যাত আকুয়াতাগা সাহিত্য পুরষ্কার পান, তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি।
ওয়ির পুরো সাহিত্যজীবনে দু’টো বিষয় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সময়ে জাপানে পারমাণবিক বোমা হামলা এবং তার ছেলে হিকারি। চার সন্তানের তৃতীয় হিকারি মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। বর্তমানে হিকারি জাপানের একজন সফল সুরকার।
২০১৪ সালে কেনজাবুরো ওয়ির উপন্যাস ‘এ পারসোনাল ম্যাটার’ (একটি ব্যাক্তিগত ব্যাপার) সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয় এবং নোবেল অর্জন করে। কিন্তু জাপানের রীতি অনুযায়ী দেশটির সম্রাটের কাছ থেকে এই পুরষ্কার গ্রহণ করতে হতো বলে ওয়ি নোবেল বর্জন করেন। কেননা ওয়ি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন- ‘গণতন্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী ও মর্যাদাসম্পন্ন কোনো শক্তির অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে নেই।’
সুলতানা পারভীন শিমুল কেনজাবুরো ওয়ির নোবেল পুরষ্কার পাওয়া ‘এ পারসোনাল ম্যাটার’ উপন্যাসটি ‘একটি ব্যাক্তিগত ব্যাপার’ শিরনামে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এর আগে উপন্যাসটি বাংলা অনূদিত হয় নি। এই উপন্যাসের এটিই প্রথম বাংলা অনুবাদ। উপন্যাসটি ‘অনুস্বর সাহিত্য’ ধারাবাহিকভাবে ছাপবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সংখ্যায় উপন্যাসটির প্রথম কিস্তিটি ছাপা হলো।