ধারণভাবে বাজেট মানে আয়-ব্যয়ের হিসাব। অর্থাৎ কীভাবে কতটা আয় হবে এবং কীভাবে তা ব্যয় হবে সেটাই বাজেটের আকার ঠিক করে। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়েই রচিত হয় বাজেট। সরকারের বাজেটও এর বাইরে নয়। সরকার যেভাবে বাজেট প্রণয়ণ করে, যাদের অংশগ্রহণে তা স¤পন্ন হয় তারা সমাজের সংগঠিত, ক্ষমতাশালী ও সুবিধাভোগী অংশ। সেখানে সাধারণ মানুষের নাক গলানোর সুযোগ নেই। তবে বাজেটে প্রান্তিক মানুষ একেবারেই উপেক্ষিত বলা যাবে না। তারা অধিকার হিসেবে নয়, বাজেটে বরাদ্দ বা সাহায্য হিসেবে কিছু পায়। দান, দয়া, প্রণোদনা এখন যাকে ঘটা করে উপহার বলে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা বড় হয়ে উঠেছে। এ সবই তো বাজেটের অংশই!
একইভাবে বাজেটে স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণও কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। বাজেট প্রণয়নে স্থানীয় সরকারের সীমাবদ্ধতা বা সক্ষমতার অভাব তাদের কর্মকা-কেই সীমাবদ্ধ করে নি, তৃণমূলে মানুষজনের সেবা পাওয়ার অধিকারকেও দারুণভাবে সংকুচিত করেছে। বিদ্যমান এমন বৈষম্যমূলক অবস্থার অবসানে অনেকেই বাজেট অংশগ্রহণমূলক হওয়ার ওপর জোর দিয়ে থাকেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার মতো বাজেট প্রণয়নও ওপর মহলের কাজ। নিচ থেকে কিছু চাহিদা আসে, প্রস্তাবনা আসে কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে ওপরের মতামতই চূড়ান্ত। কারণ ক্ষমতা উপরেই কেন্দ্রীভূত। নিচের মানুষ অসংগঠিত। বিভক্ত, বিভ্রান্তও। এই বাস্তবতা সৃষ্টি করা হয়েছে সচেতন ও পরিকল্পিতভাবেই। বাজেট প্রণয়নে নিচের মতামতের গুরুত্ব পাওয়া নির্ভর করে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনের ওপর। বিকেন্দ্রীকৃত কাঠামোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলেই তা সম্ভব।
এজন্য সাধারণ মানুষের সংগঠিত হয়ে ওঠার বিকল্প নেই। সংগঠিত মানুষই নিজের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এছাড়া অংশগ্রহণমূলক বাজেটের কথা কতটা বাস্তবসম্মত সেটা ভেবে দেখার বিষয়!
জোট তথা শাসন ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই যেহেতেু সাধারণ মানুষের কল্যাণ তাই সাধারণের অংশগ্রহণের বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। বর্তমানে নিচের মতামত ওপরে যায় রাষ্ট্রীয় ও দলীয় কাঠামোর মাধ্যমে। এই কাঠামো নিয়ন্ত্রণকারীদের ওপরেই নির্ভর করে সবকিছু। দলীয় বা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে সব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। তাদের জবাবদিহিতা বা নিয়ন্ত্রণের মতো কোনো ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের হাতে নেই। কেতাবে যাই লেখা থাক বাস্তবে অসংগঠিত মানুষের কোনো ভূমিকাই নেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে।
সাধারণ মানুষের অর্থাৎ তৃণমূলের সংগঠন বলতে বর্তমানে বিভিন্ন নামের দলীয় সংগঠন ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব নেই। শ্রেণী ও পেশাগত সংগঠনের মতো স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও পুরোপুরি দলীয়করণ হয়ে গেছে। দলীয় ব্যক্তিরাই ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে শ্রেণী-পেশা এমনকি সমবায় সংগঠনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে একচ্ছত্র ক্ষমতা চর্চা করে। আইনগতভাবেই এটি হয়ে থাকে। ফলে প্রান্তিক মানুষকে অসহায়ভাবে তাদের মুখাপেক্ষি হতে হয়। অন্যথায় বিপদের মুখে পরতে হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুই সাঁওতাল কৃষকের সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যার ঘটনা অথবা বাধ ভাঙা ঢল থেকে হাওরের কৃষকদের ধান বাঁচাবার প্রাণান্তকর অবস্থা থেকেই অসহায়ত্বের চিত্রটা বুঝতে পারা যায়।
স্বাধীনতার পর এই ৫০ বছরে দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। উন্নয়নও হয়েছে নানা ক্ষেত্রে। এসব নিয়েই কথামালার রাজনীতি জমে উঠেছে। বাজেটে জনগণের স্বার্থ রক্ষার উপায় আলোচনায় অংশগ্রহণমূলক বাজেটের কথা শোনা যায়। এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানাভাবে লেখালেখি, সেমিনার-সি¤েপাজিয়াম, আলোচনা অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে। সে সব থেকে নানা-ধরনের পরামর্শ, অভিমত, দাবিও উত্থাপিত হয়। সেখানে সমাজের বিভিন্ন সংগঠিত অংশের দর কষাকষির চিত্র দৃশ্যমান। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যবসায়ীদের অগ্রগামী ভূমিকা বলাই বাহুল্য। প্রভাবশালীদের চাহিদা বিবেচনার ফলে বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও প্রান্তিক জনগোষ্টির জন্য ছিঁটেফোটার বেশি কিছু থাকে না। তাবে তাদের ভাগ্যে নানা ধরনের উপহার জোটে, দান-দক্ষিণার দেখা মেলে। হাত পেতে তা নেবার দৃশ্য ফলাও প্রচার পায়। এ সবই যে তাদের নাগরিক অধিকার অস্বীকার করে সেটি গ্রহীতা হিসেবে তারা যেমন বুঝতে পারে না তেমনি দাতাদের কাছেও তা বিবেচনায় আসে না।
দিন যতই যাক এক্ষেত্রে পরিবর্তন অন্তত সামান্যই। সমাজের সংগঠিত প্রভাবশালীরাই বাজেট ঠিক করার মতো দেশ শাসনের ক্ষেত্রেও প্রাধান্য বিস্তার করে আছে সেই আগের মতোই। নি¤œবর্গের মানুষের অসংগঠিত, বিভক্ত ও বিভ্রান্তিকর অবস্থা দূর করার মতো ব্যবস্থার দেখা মেলে নি। এ নিয়ে রাজনীতির মাঠে কথাবার্তা শোনা গেলেও আইনগত বা কাঠামোগত পদক্ষেপ নেয় নি কেউ। দলে, সমাজে বিভেদ, বিভক্তি, বৈষম্য, বিশৃঙ্খলা দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। এমন অবস্থা যে বেশিদিন চলতে পারে না সেটাও এখন বেশি বেশি শোনা যাচ্ছে।
এজন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়ানোর বিকল্প নেই। তাদের নিজস্ব সংগঠনের অভাব দূর করা ছাড়া কার্যকর পরিবর্তন আশা করা যায় না। এখন শ্রেণী-পেশার যে সংগঠনগুলোর তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় সেগুলো যতটা তাদের স্বার্থে কাজ করে তার চেয়ে বেশি করে দলীয় স্বার্থে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে। সেখানে সরকারের সমর্থন বা বিরোধীতাই প্রাধান্য পায়। পেশাগত বা সামাজিক সমস্যা নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে উঠলেও এক পর্যায়ে এসে তা গতি হারায়। নেতৃত্বের অবস্থান, দলগত বিভক্তি বড় হয়ে ওঠে। পেশাগত ঐক্য চাপা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোও পেশাগত ঐক্যের চেয়ে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রাধান্য দেয়। দলের অনুসারী সংগঠন গড়ে তুলে, মদদ দেয়। ফলে নানা নামে শ্রমজীবীদের সংগঠনের সংখ্যা বেশি হলেও কার্যকর ভূমিকা নেই বললেই চলে। তাই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো জাতীয় বাজেটেও তাদের স্বার্থ উপেক্ষিতই থাকে।
এক্ষেত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও যথার্থ ভূমিকা রাখেন না বা রাখতে পারেন না। ভোটারদের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থেই তারা চালিত হন। জাতীয় সংসদে নির্বাচিতরা সাংবিধানিকভাবেই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। আর স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দলীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও স্বাধীনতা এতটাই সীমিত যে চাইলেও স্থানীয় বা সাধারণের স্বার্থে দাঁড়াতে পারেন না। কাঠামোতগতভাবেই তারা নিয়ন্ত্রিত হন আমলাতন্ত্র তথা সরকার দ্বারা। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধির বেশি কিছু করা সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে। তাই শুধু উপরের পরিবর্তনে তৃণমূলের অবস্থা নড়চড় হয় কমই।
বিদ্যমান স্থানীয় সরকার কাঠামোও সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সৃষ্টি। যার জন্মই হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। সেই ভূমিকার পরিবর্তন হয় নি পাকিস্তান আমলে। স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থাও ভিন্ন নয়। পরিচালনার ক্ষেত্রে যেমন তেমনি আয়-ব্যয়, বাজেট সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা এতটাই যে স্থানীয় জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই বললেই চলে। স্থানীয় সরকারের বাজেটেও এমন অবস্থা সাদা চোখেই দেখা যায়। তাই শেষ বিচারে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারও কেন্দ্রীয় সরকারের তল্পিবাহকের বেশি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। যা তৃণমূল থেকেও গণতন্ত্রকে নির্বাসিত করেছে।
এ অবস্থায় সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক বাজেট চাইলে কাঠামোগত পরিবর্তন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে প্রান্তিক মানুষদের নিজস্ব আন্দোলন-সংগ্রাম প্রয়োজন। যাতে তারা নিজস্ব স্বার্থে পরিচালিত হতে পারে। তেমন সংগঠন ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিকল্পিত উদ্যোগ। এনজিও ধরনের বা সামাজিক সংগঠন যে এ পথে বেশি দূর এগোতে পারে না সেটা জানা কথা। যদি স্থানীয় সরকারের অংশগ্রহণমূলক বাজেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয় তা হলে জাতীয় সরকারের ক্ষেত্রেও তা প্রসারিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। তবে এ জন্য স্থানীয় পর্যায়ের মতো রাজনৈতিক পর্যায়েও সংগঠিত শক্তির চাপ সৃষ্টি হতে হবে। আরও দরকার কাঠামোগত সংস্কারের পদক্ষেপ। এছাড়া বাজেটের আকার বৃদ্ধি সত্যিকার অর্থে কোনো কাজ আসবে না।
বৃহত্তর স্বার্থেই অংশগ্রহণমূলক বাজেটের গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করে না। এর ফলে তৃণমূলের কল্যাণে বাজেটের সক্ষমতা সৃষ্টি হবে। তখন কথার চাইতে বাস্তবেই দারিদ্র্য দূরীকরণের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা পাবে স্থানীয় সরকার। প্রান্তিক পর্যায়ের সমস্যা সমাধান সহজ হবে। অন্যদিকে স্থানীয় জনগণের ক্ষমতায়নের ফলে জবাবদিহিতার সুযোগ বাড়বে। নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে সাধারণ মানুষের। এভাবে শুধু বাজেটের ক্ষেত্রেই নয়, শাসন ব্যবস্থাতেও জনবিচ্ছিন্নতা কমে আসবে। যা গণক্ষমতার স্ফূরণ ঘটাবে। মূর্ত হয়ে উঠবে সংবিধানের সেই কথা- ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক