বর্ষ ১, সংখ্যা ৭, আগস্ট ২০২১
সম্পাদক
শাহ্ জে. চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক
মুবিন খান
প্রচ্ছদ
বিপ্লব দত্ত
দাম:
বাংলাদেশে ২৫ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২.৪৯ ডলার
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী যখন নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করল, সে হত্যাযজ্ঞের তারা নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট।’ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ লিখেছেন, সে রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ‘…কেন তোমরা গুলি করছ? আমাকে যদি মারতে চাও আমি তো এখানেই রয়েছি। কেন তোমরা আমার লোকজনকে মারছ?’
এরপর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে হয়ত ওরা মেরে ফেলবে। ফিরে আসতে পারব কিনা জানি না। কিন্তু কোনো একদিন আমাদের দেশের মানুষ মুক্ত হবে। তখন আমার আত্মা তা দেখে খুশি হবে।’ একথা বলে তিনি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান। না, পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলতে পারে নি। তবে চেষ্টাটা ছিল তাদের। বাংলাদেশ যেদিন স্বাধীন হলো সেদিনও বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। পারে নি।
রামেশ্বর নাথ কাও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করতে বললেন, আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, আমার কিছুই হতে পারে না, তারা আমার লোক। রামেশ্বর নাথ কাও হলেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’-এর প্রথম প্রধান। ১৯৭৫ সালের মার্চেই কাওয়ের কাছে আরও বিস্তারিত খবর পৌঁছে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে খবর বিশ্বাস করেন নি। বাংলাদেশের কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে এমন কথা বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন না। ঘাতকরা যখন তাঁরই বাড়িতে ঢুকে গুলি করল, তখন কি বঙ্গবন্ধু বিস্মিত হয়েছিলেন? দেহটি ছেড়ে যেতে যেতে কি ঘুরে সিঁড়িতে পড়ে থাকা আপন দেহটির দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি? বাঙালি তাঁর আপনজন। বাঙালি তাঁকে মারতে পারে না বলে বুকটা ভরা যে অহংকার তাঁকে প্রদীপ্ত রাখত, সে অহংকারই কি তাঁকে লজ্জিত করেছিল? বাঙালিই তো মারল তাঁকে। কেবল তাঁকে নয়। তাঁর পুরো পরিবারের প্রতিটি মানুষকেই! দু’জন বেঁচে গিয়েছিলেন ঘাতকদের নাগাল থেকে দূরে ছিলেন বলে। একজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্যজন তাঁর ছোটবোন শেখ রেহানা। নাগালে পেলে নিশ্চিতভাবে তাঁদেরকেও মেরে ফেলত ঘাতকরা।
নিউ ইয়র্ক টাইমস্ সম্পাদকীয়তে লিখেছে, বঙ্গবন্ধুর লাশ ১২ ঘন্টা ৩২ নম্বরের সিঁড়িতে পড়েছিল। সাড়ে তিন বছর আগে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা বীর বাঙালি ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড নিয়ে টুঁ শব্দটিও করে নি। একটি মানুষও প্রতিবাদে রাস্তায় নামে নি। গেল বছর বিজয় দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের হত্যার ঘটনা তুলে ধরে এত বড় একটা ঘটনা, বাংলাদেশের কোনো লোক জানতে পারল না? কেউ কোনো পদক্ষেপ নিল না? লাশ পড়ে থাকল ৩২ নম্বরে! সেই কথা আমি এখনও ভাবি! এত বড় সংগঠন, এত নেতা, কোথায় ছিল তখন? মাঝে মাঝে আমার জানতে ইচ্ছে করে, কেউ সাহসে ভর দিয়ে এগিয়ে আসতে পারল না? বাংলার সাধারণ মানুষ তো বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিল।’
প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে বেজে ওঠা দারুণ এ আক্ষেপ আর বিস্ময় আমাদের লজ্জা।
১৫ আগস্টের পরদিন ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সেসময় আওয়ামী লীগের মুখপত্র বলে পরিচিত দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছিল, ‘রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।… শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।’ ইত্তেফাক একলা নয়। সেসময় বীর বাঙালির সকল পত্রিকাই এ এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ নামক এই রাষ্ট্রপতিটির পরিচিতি হলো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগী। ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোগীটি ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম কালো আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ- ৫০/১৯৭৫’ জারি করল। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ রয়েছে, প্রথম অংশে বলা হয়েছে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেয়া হলো।
আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করা হয়। বীর বাঙালি জাতি হয় অভিশাপ মুক্ত।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সমপন্ন হয়েছে। ছয়জনের ফাঁসি কার্যকরও হয়েছে। পাঁচ খুনি এখনও পলাতক রয়েছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে আর দশটা হত্যাকাণ্ড যেভাবে হয়ে থাকে সেভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কি কেবলই ক’জন বিপথগামী সেনা সদস্যর হঠকারী সিদ্ধান্ত? নাকি এর পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো ক্ষেত্র? এ বিষয়টি এখনও সেভাবে আলোচনায় উঠে আসে নি। এইটি উন্মোচন হওয়া জরুরি।
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।