বর্ষ ১, সংখ্যা ৮, সেপ্টেম্বর ২০২১
সম্পাদক
শাহ্ জে. চৌধুরী
নির্বাহী সম্পাদক
মুবিন খান
প্রচ্ছদ
আনিসুজ্জামান মুহাম্মদ
দাম:
বাংলাদেশে ২৫ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২.৪৯ ডলার
প্রত্যাশা
প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর এসে আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, এক দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে দখলদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে এই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। কিন্তু আর তার আগের নয় মাসে, সেই পঁচিশে মার্চ থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় শুরু করে করে পাক সেনারা তিরিশ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছে। ধর্ষণ করেছে তিন লক্ষ নারী।
১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরব ও অহংকারের দিন। এ দিন পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়াল একটি নতুন দেশ- বাংলাদেশ। উজ্জ্বলতম এ দিনে মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের। এবারের বিজয় দিবসটির বয়স পঞ্চাশ বছর। আমাদের বাংলাদেশটার বয়স পঞ্চাশ বছর। বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী।
দাসত্ব থেকে, শৃঙ্খল থেকে, শোষণ থেকে, সাম্প্রদায়িকতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতেই সংঘটিত হয়েছিল মুক্তির যুদ্ধটা।
‘৪৭য়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো বটে, কিন্তু ভারতবর্ষকে ভাগ করে ফেলে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটানো হলো। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করা হলো শুধুই ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তানের পূর্ব অংশটি আমাদের বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ হলেও ’৪৭ থেকে ’৭১ – ২৪টি বছর আমাদের মানুষদের সঙ্গে পাকিস্তানিরা অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন আর শোষণ করছিল। বাঙালিরা তার নিজভুমিতেই অধিকারহারা হয়ে পড়েছিল। বাঙালিদেরকে সবদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। সামাজিক থেকে মানবিক- সকল ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছিল। তারা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবতে শুরু করেছিল। এই বৈষম্যর অবসান ঘটাতে, পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ থেকে মুক্তি পেতেই এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ- এই চারটি আদর্শর ওপর দাঁড়িয়ে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তির যুদ্ধ। কেননা পূর্ব পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় এদেশের মানুষ খুব করে জেনে গেছে এই চারটিই মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে। এই চারটি আদর্শই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
১৬ ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। গেল পঞ্চাশ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে আমাদের অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কমেছে শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যুর হার। গড় আয়ু বেড়েছে, পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ক’দিন আগে খবরের কাগজ জানালো নতুন ভিত্তিবছরের হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অথচ ২০১৭ সালের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ, অর্থাৎ ২৭ লাখ। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই বিদেশে পাড়ি জমাতে চায়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস রপ্তানি নয়, রেমিটেন্স। অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে শিশুরা ২০ টাকা পারিশ্রামিকে শ্রম বিক্রি করছে। শিক্ষা এখন চারটি ধারায় বিভক্ত।
অন্যদিকে অবনতি হয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতা, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব হয়েছে। এমন কিছু আইনকানুন প্রণয়ন করা হয়েছে, যেগুলো একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ বিকাশের পক্ষে প্রতিকূল। মূলত রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দুর্বলতার কারণে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বেড়েছে দুর্নীতি, বেড়েছে অনিয়ম। জবাবদিহির অভাব প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে।
পঞ্চাশ বছর মহাকালের যাত্রায় তেমন কিছু নয়। কিন্তু মানুষের জীবনের সবটা না হলেও অনেকটা জুড়ে। যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, আমরা তার কতটা পূরণ করতে পেরেছি? নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা কেবল নিজেদের দেশটিকে স্বাধীন করেছি। যে চেতনা স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করেছিল তাকে প্রতিষ্ঠা করা যায় নি পঞ্চাশটি বছরেও। সেটি প্রতিষ্ঠিত হবে যেদিন বিজয়টা সেদিনই অর্জিত হবে। কেননা পাকিস্তান আমলে বাঙালির ওপর বঞ্চনা আর নির্যাতন নির্মাণ করেছিল ওই স্বপ্ন আর আকাক্সক্ষা মেশানো চেতনা। এবং এখনো সে চারটি আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করা যায় নি বলেই মানুষ বঞ্চিত হয়ে চলেছে।
স্থাপত্য নির্মাণ মানেই উন্নয়ন নয়, তেমনি ভুখণ্ড প্রাপ্তিও বিজয় নয়। নির্মাণ করতে হবে মানুষ, নির্মাণ চাই ব্যবস্থার। আমাদের একাত্তরের মতো আবারও ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করা দরকার। কারো জন্যে নয়, আমাদের নিজেদের জন্যে, আগামী প্রজন্মর জন্যেই এইটি খুব জরুরি।
এবারের বিজয় দিবস সংখ্যায় যারা লিখেছেন:
সেলিনা হোসেন
মাহমুদ জামাল কাদেরী
আইয়ুব হোসেন
আজিজুল পারভেজ
লুৎফুল হোসেন
আফসার বিপুল
জাহান আরা
ড. নাজমুন খাতুন
রুনু দাশ
হাসনাত বেগ
ডা. শফিকুল ইসলাম
আহসান কবির
শাহ্ জে. চৌধুরী
মুবিন খান
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।