ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির গৌরব ও অহঙ্কারের প্রতীক ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নতুন রূপ নেয়। পাঁচটি স্তম্ভের পেছনে যুক্ত হয় উদীয়মান সূর্যের প্রতীক লাল বৃত্ত। কিন্তু সারা বছর থাকে না এই লাল বৃত্ত। কেন থাকে না? এটা কি শহীদ মিনারের নকশার অংশ নয়? অংশ হলে সারা বছর থাকবে না কেন? এই প্রশ্নগুলো প্রতি বছর ঘুরে ফিরে এলেও উত্তর মেলে না সহজে।
বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা একুশের মহান শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে এবার এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। স্বনামধন্য কয়েকজন স্থপতির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার কেউই এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেন নি। তারা বলেন, লাল বৃত্তটা তো শহীদ মিনারেরই অংশ। এটা অবশ্যই সারা বছর থাকতে হবে। না থাকলে শহীদ মিনারের নকশার অঙ্গহানী হয়।
শহীদ মিনারের নকশার দিকে তাকালে দেখা যায়, এতে রয়েছে মোট পাঁচটি স্তম্ভ। মাঝখানের স্তম্ভটি সবচেয়ে উঁচু, উপরের অংশটি সামনের দিকে নোয়ানো। দুই পাশে আরও চারটি স্তম্ভ। মনে করা হয়, অতন্দ্র প্রহরী চার সন্তানকে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মা। সেই গানের কথার মতো, ‘মাগো… ভাবনা কেনো? আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে শক্ত হাতে লড়তে জানি/ তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’। পেছনে উদীয়মান লাল টকটকে সূর্য। অর্থাৎ মাতৃভাষার অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যেমন অকাতরে জীবন দিয়েছিল সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত, রফিক; তেমনি মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব আর মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় মায়ের পাশে এখনও অতন্দ্র প্রহরায় তার সন্তানেরা। আর পেছনের লাল সূর্যটা স্বাধীনতার, নতুন দিনের, অন্ধকার দূর করে আলোর উৎসারণ।
শহীদ মিনারের নির্মাণ সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে বাঙালিদের রাজপথে জীবনদানের স্মরণে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করেছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ স্মৃস্তিম্ভটি ভেঙে ফেলে। এর পর ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের আমলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বর্তমান স্থান নির্বাচন করে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশায় নির্মাণযজ্ঞে যুক্ত হন ভাস্কর নভেরা আহমদ। মূল রূপকল্পনায় ছিল স্নেহময়ী আনত মস্তক মায়ের প্রতীক হিসেবে মধ্যস্থলে সুউচ্চ কাঠামো এবং দুই পাশে সন্তানের প্রতীক স্বরূপ দুটি করে কাঠামোর সামনে বাঁধানো চত্বর। সম্মুখ চত্বরে থাকবে দুটি ম্যুরাল। পেছনে দেয়ালচিত্র। ছিল বেদনাঘন শহীদ দিবসের প্রতীকী রূপে একটি ফোয়ারা স্থাপনের পরিকল্পনা। আরো ছিল ভাষা আন্দোলন জাদুঘর ও পাঠাগার। এ পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে কেন্দীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ অসম্পূর্ণ ও খণ্ডিত শহীদ মিনারেই ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সেই থেকে শহীদ মিনার হয়ে ওঠে বাঙালির আন্দোলন সংগ্রামের চেতনার চেতনার প্রতীক। ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর আজম খানের গঠিত কমিটির পরামর্শ মতে মূল নকশা অনেকটাই পরিবর্তন ও সঙ্কুচিত করা হয়। মূল নকশাকে খণ্ডিত করে আরেকটি নকশা দাঁড় করানো হয়। এ নকশানুযায়ী নির্মিত শহীদ মিনারটি ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন শহীদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভেঙে বাঙালির গৌরব ও অহঙ্কারের শহীদ মিনারটি। তারা সেখানে ‘মসজিদ’ লিখে রাখে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরের বছরই বাঙালির দুর্জয় সাহসের প্রতীক হিসেবে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়। বর্তমান রূপ পায় আশির দশকে এসে। ১৯৮৩ সালে সম্প্রসারণ করা হয় শহীদ মিনার চত্বর। শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে স্ব-মহিমায়। ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
এত সব জানার পরে জানা গেল, শহীদ মিনারের লাল বৃত্তটি মূল নকশার অংশ ছিল না। এটি আশির দশকে যুক্ত করা হয়েছে। এ তথ্যটি জানা গেল, বর্ষিয়ান চিত্রশিল্পী মোস্তাফা মনোয়ারের কাছ থেকে। তিনি জানান, বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মিত হওয়ার পর লাল বৃত্তটি যুক্ত করা হয়েছে। প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি জানান, শহীদ মিনার নির্মিত হওয়ার পর দেখা গেল এর সামনে দাঁড়ালে দৃষ্টি চলে যায় তার পেছনে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ভবনের দিকে। দেখা যায় ভবন বারান্দায় মানুষের চলাফেরা। এ কারণে হাসপাতাল ভাবনকে আড়াল করার জন্য শহীদ মিনারের পেছনে একটি প্রাচীর নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এ সংক্রান্ত একটি সভায় অন্যান্য শিল্পীদের সঙ্গে তাঁকেও (মোস্তাফা মনোয়ারকে) আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন তিনি একটি লাল বৃত্ত যুক্ত করার প্রস্তাব করলে সেটা গ্রহণ করা হয়।
শিল্পী মোস্তাফা মনোয়ার বলেন, গোল্ডেল সেকশন বলে একটা কথা আছে। যে কোনো কিছুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের শরীরের মধ্যেও এমন ‘গোল্ডেন সেকশন’ আছে। শহীদ মিনারের গোল্ডেন সেকশনে এই লাল বৃত্ত স্থাপন করা হয়েছে।
তিনি জানান, তখনকার কর্মকর্তারা এই লাল বৃত্তকে স্থায়ীভাবে স্থাপনের কথা বলেছিলেন। তখন তিনি বলেন, বসন্তকালে নতুন ফুল ফুটে। সৌরভ ছড়িয়ে এক সময় সেই ফুল ঝরে যায়। বছর শেষে আবার সজীবতা নিয়ে আসে নতুন ফুল। সে কারণে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা শহীদ মিনারে লাল বৃত্তটি লাগাবো। এটা বিবর্ণ হয়ে গেলে আবার নতুন বছরে নতুন করে লাল বৃত্ত লাগাবো। তাঁর এই ভাবনাকেও তখন গ্রহণ করা হয়। এভাবেই চলছে এখন। এ কারণেই সারা বছর থাকে না লাল বৃত্ত। প্রতি বছর ২০ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে যুক্ত হয় নতুন লাল বৃত্ত।❐
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, কালের কণ্ঠ।