জনসাধারণের আশা পূরণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে তার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়েছিল ১৯৪৮ সালে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও দেশের সকল বুদ্ধিজীবীই যে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন তা নয়। ঢাকাতে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে একটি ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল অধ্যাপক ও ছাত্রদের নিয়ে। এঁরা সংস্কারমুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার ওপর গুরুত্ব দিতেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও এঁদের মনের মধ্যে নানান প্রশ্ন উঠেছিল। নজরুল ইসলামকে নিয়ে পাকিস্তানবাদীরা পরবর্তীকালে অনেক বাগাড়ম্বর করেছে, কিন্তু নজরুল ইসলাম কোনোদিনই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না, তিনি বরং আস্থা রেখেছিলেন শ্রমিক-কৃষকদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে। এটা আগের কথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ সালে, এমনকি যাঁরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে মঙ্গলের প্রত্যাশা দেখেছিলেন তাঁরাও কিছুটা চিন্তিত না হয়ে পারেন নি। চিন্তিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালু করবার উদ্যোগ-প্রয়োজন দেখে। ১৯৪৮-এর গোড়ার দিকেই অধ্যাপক ও ছাত্রদের একাংশ দাবি তুললেন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে। সরকারের দিক থেকে বিরোধিতা এলো, প্রত্যাশিত বিরোধিতা। এবং তখনি, সেই সময়েই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জায়গায় নতুন এক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটল বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ঘটনাটা তেমন কোনো ঘটা না করেই ঘটল। অধিকাংশ মানুষই লক্ষ করল না রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য যে কি, এ যে কোন পর্যন্ত যাবে সেটা শাসকরা তখন বোঝে নি, এমন কি তাঁরাও বোঝেন নি যাঁরা শুরু করেন এই আন্দোলন।
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যখন জন্ম হয় তখন সেই জন্মের পেছনে একটি অতিপ্রধান ভূমিকা ছিল ভয়ের। মুসলিম মধ্যবিত্ত ভয় পেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই মনে করে। সেই ভয় তারা সংক্রমিত করে দিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে। প্রধানত ভয়ের কারণেই- ইংরেজের ভয়, তারও চেয়ে বড় ভয় হিন্দুর- ভয়ের তাড়নাতেই মুসলমানদের প্রায় সব ভোটই গিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বাক্সে। এখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই এলো এই নতুন ভয়- উর্দুর অর্থাৎ উর্দু ভাষাভাষীদের। আশঙ্কা হলো উর্দু চাপিয়ে দেয়ার ফলে বাঙালিরা চিরকালের জন্য বোবা হয়ে যাবে, তারা গোলাম হয়ে যাবে পাঞ্জাবিদের। বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো সেই ভয় জাগিয়ে দিল মানুষকে- প্রথমে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশকে, পরে ছাত্রদের এবং তারও পরে সমগ্র দেশবাসীকে। বড় ভয় এসে ছোট ভয়কে, নিরাপত্তার ভয়কে, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারার ভয়কে জয় করে নিলো। ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি দেখলো তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন মরিয়া হয়ে ওঠা ভিন্ন অন্য কোনো পথ রইল না। যে শাসকরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল, সেই শাসকরাই আজ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সকল মানুষের স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন সেই জ্ঞানটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এনে দিল। শাসকদের স্ববিরোধিতার পুরাতন নাটক এইখানেও নতুন করে অভিনীত হলো, স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই তারা স্বার্থ বিনষ্ট করল।
বলাই বাহুল্য যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না। থাকলে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হতো না। এই আন্দোলন অনেক দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে, স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত এর গতিধারা প্রসারিত। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতা এদেশের পুরাতন ব্যাধি, ইংরেজ আমলে এই ব্যাধির প্রকোপে আমরা অনেক দুর্ভোগ ভোগ করেছি। পাশাপাশি থেকেও দুই সম্প্রদায় পর¯পরের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, নিজেদের স্বার্থকে এক করে দেখতে পায় নি। ইংরেজ যুগে সৃষ্ট অতিশয় সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যে মুসলিম জীবন ও লেখকদের উপস্থিতির সামান্যতাটা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, মুসলমান মধ্যবিত্ত সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়েছিল এবং হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া মুসলমানের এমন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি যাতে করে সাহিত্যে মুসলিম জীবন অনায়াসে চিত্রিত হতে পারে। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ রদ করা সম্ভব হয়েছিল বটে, কিন্তু ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। বিভাগ মুসলমান মধ্যবিত্ত তো চেয়েছিল বটেই, শেষ পর্যন্ত হিন্দু মধ্যবিত্তের পক্ষেও না চেয়ে উপায় থাকে নি। ১৯০৫-এ যাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধী ছিলেন। ১৯৪৭-এ তাঁরা আর বিরোধী থাকতে পারে নি। এই রকমের একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশে, সাম্প্রদায়িকতার ফলে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্রে এতো তাড়াতাড়ি যে অসা¤প্রদায়িক গণআন্দোলন গড়ে উঠতে পারলো, এর দ্বারা এটাই প্রমাণ হয় যে পাকিস্তানের ব্যর্থতা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং সেই ব্যর্থতা দেখে বাংলাদেশের মানুষ ভয় পেয়েছিল।
শুধু অসাম্প্রদায়িক নয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও বটে। সমাজতন্ত্রের কথা আন্দোলনের কালে ¯পষ্ট করে বলা হয় নি বটে, কিন্তু সন্দেহ নেই এ আন্দোলন ছিল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হবার আন্দোলন। বাংলাদেশের সন্ত্রন্ত মুসলমানরা একদিন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল, এর সাহায্যে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে বলে। সেই অস্ত্র যখন বরং উল্টো কাজ করবে বলে ভয় হলো, তখন তারা একে পরিত্যাগ করে অন্য একটা অস্ত্রই শাণিত করে তুলতে চাইল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের অস্ত্র। স্বাধীনতা আন্দোলনে সেই অস্ত্রই মুক্তিযোদ্ধারা ব্যবহার করেছে, যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন একটি সম্পূ র্ণ নতুন ও অতিশয় প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা সরবরাহ করেছে তরুণ ছাত্রদের জীবনে। সে অভিজ্ঞতা আত্মত্যাগের ও নির্যাতনভোগের। বাংলাদেশের মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য যথেষ্ট দুর্ভোগ সহ্য করে নি, পর্যাপ্ত পরিমাণে রক্ত দেয় নি বলে তরুণ সমাজের মনে একটা লজ্জা ছিল। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন রক্ত বইলো, যখন কারাভোগ এলো, এলো পুলিশের পিছু নেয়া, তখন লজ্জা ঘুচল কিছুটা, দ্বিধা কাটল অনেক পরিমাণে, দৃঢ়চিত্ততা এলো সঙ্গে সঙ্গে।এ দেশের লেখক, সাংবাদিক, গায়ক, চিত্রকর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্যে শিল্পের যে পরিমাণ উপাদান যত সহজে পেয়েছেন তেমন অন্য কোথাও পান নি। একুশে ফেব্রুয়ারি কোনোদিন ম্লান হয় নি, ১৯৫২ সালের পর প্রতিটি বছর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে। বাইরে রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আবেদন কমে নি, ক্রমশ বেড়েছে। তার কারণ এই আন্দোলন শক্তি পেয়েছে পাকিস্তানের ব্যর্থতা থেকে, যে ব্যর্থতার বোঝা দিনকে দিন বাড়ছিল, শক্তি পেয়েছে জনসাধারণের অসন্তোষ থেকে, যে অসন্তোষও প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের পুঞ্জীভূত রূপ হচ্ছে এই আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের দাবিদার মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে দিয়ে সাধারণ মানুষ জানিয়ে দিল যে মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানের হাতে তাদের স্বার্থ যে নিরাপদ নয় এ সত্য তাদের কাছে আর অস্পষ্ট নয়। পরে এই সত্য আরো প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, যত প্রত্যক্ষ হয়েছে তত বেড়েছে বিক্ষোভ। বিক্ষোভ সব সময়ে প্রকাশের পথ পায় নি, যখন পায় নি তখন তা আরো বেশি দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি। শিল্প ও সাহিত্য সৃষ্টির উপাদান জোগাতে পেরেছে আরো এই কারণে যে এই আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা অত্যন্ত বড় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মুসলিম মধ্যবিত্তের দৃষ্টি অনেক সময়ে ছিল পশ্চিমমুখো, তাদের মনে অভিমান ছিল, তাদের মাতৃভাষা বাংলা কিনা এ নিয়েও এক সময়ে প্রশ্ন উঠেছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি বুদ্ধিজীবীদের দেশের সঙ্গে একা করে দিল। তাঁরা ঘরে ফিরে এলেন গভীর ভালোবাসা নিয়ে। তাঁরা দেশের মানুষের হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। এতদিন ধর্ম ছিল ঐক্যের বন্ধন, এখন সেখানে এলো ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারির পর বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী যখন দেশের কথা বলছেন, তখন অধিকাংশ সময় তাঁরা আসলে বাংলাদেশের কথাই বলেছেন, পাকিস্তানের কথা নয়। দেশপ্রেম তাঁদের দেশদ্রোহী করেছে- এক অর্থে। বায়ান্নর পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি মমতার ক্ষেত্রে, চর্চার ক্ষেত্রে বান ডেকে জোয়ার এসেছে। রচনার উৎকর্ষতাও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক পরিমাণে। এর ফলে শুধু যে ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে তা নয়, মানুষের মধ্যে ঐক্যের বোধ বেড়েছে, বেড়েছে সচেতনতা, বেড়েছে সুন্দরতর জীবনের প্রতি আকর্ষণ। বাইরে যাই বলুক, পাকিস্তানের শাসকরা একুশে ফেব্রুয়ারি শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল, তাই গণহত্যা শুরু করেই তারা ছুটে গিয়েছিল শহীদ মিনারের দিকে, মিনারকে ভেঙে দিয়ে আক্রোশ মিটিয়েছিল তারা। আর মিনারের জায়গায় মসজিদ তৈরি করে তারা তাদের পুরাতন কৌশল নতুন করে প্রকাশ করেছিল: কৌশলটা হলো ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিক্ষোভকে স্তিমিত করা।
বাংলা ভাষার ব্যাপারে পশ্চিমা শাসকবর্গ একগুঁয়েমির পরিচয় দিয়েছে প্রথমটায়। হয়ত তার পেছনে ভয় ছিল, স্বার্থ নষ্ট হবার ভয়, কিন্তু পরে যখন তারা দেখেছে যে এ আন্দোলন কিছুতেই স্তব্ধ হবার নয়, তখন ১৯৫৬ সালে এবং পরে ১৯৬২ সালের সংবিধানে বাংলাকে তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু ততদিনে বাংলাদেশের মানুষ আরো অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গেছে। পাকিস্তানে যে তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই এটা তাদের জানা হয়ে গেছে, এবং জানা হয়ে গেছে বলে ততদিনে তারা শুধু ভাষার অধিকার না, পূর্ব আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দাবি করেছে।
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সচেতনতা ও বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ যত বৃদ্ধি পেয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে তত বেশি চেষ্টা হয়েছে তাদের প্রলুব্ধ করবার। বুদ্ধিজীবীদের পেছনে আর্থিক বরাদ্দ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের জন্য সংগঠন প্রতিষ্ঠান গড়া হয়েছে, পুরস্কার পারিতোষিকের সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। বাইরে থেকে মনে হয়েছে প্রলোভনের জালে অনেকেই ধরা দিচ্ছেন। ধরা দিয়েছেন কেউ কেউ কিন্তু এমনকি যাঁরা দিয়েছেনও তাঁরা দেখা গেছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করতে পারছেন না। তার কারণ পাকিস্তানের কৃত্রিমতাটা তাঁদের কাছে ততদিনে ধরা পড়ে গেছে। পাকিস্তানের শাসকরা চিরকালই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে ছিল, সেই দূরত্ব যে ক্রমশ বাড়ছে, বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে সেটাও লক্ষ না করে উপায় ছিল না। সরকার টাকা দিল, কিন্তু মন গেল না। তমঘা দিল, সেই তমঘা পরে কেউ কেউ পরিত্যাগ করলেন, করে বিব্রত করলেন সরকারকে। সরকার সাহিত্যের জন্য পুরস্কার দিল, কিন্তু সেই পুরস্কার সরকার বিরোধীরা পাওয়া শুরু করলেন। এমনকি পাকিস্তানের শাসন-ব্যবস্থার ওপর প্রচ্ছন্ন বিদ্রƒপকারী রচনাও পুরস্কার নিয়ে গেল। সরকার টাকা দিল লেখক সংঘ গড়বার জন্য, কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেল লেখক সংঘ সরকারি নীতির সমর্থন তো করছেই না, পরন্তু প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে।
সরকার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও পশ্চিম পাকিস্তানের ইতিহাস যে অভিন্ন ধারায় প্রবাহিত তা প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু ইতিহাস তো সরকারের কেনা গোলাম নয়, ইতিহাস ওই কৃত্রিম ছকে আবদ্ধ হতে রাজি হয় নি। অতীতের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা সফল হয় নি, বাংলাদেশের মানুষ তাতে আস্থা রাখে নি এবং চলমান ইতিহাসের ধারা তো চোখের সামনেই দেখা গেছে দুই ভিন্ন দিকে চলেছে। চেষ্টা হয়েছে এটা প্রমাণ করার যে বাংলা ও উর্দু ভাষার মধ্যে সাধারণ ঐতিহ্য আছে, আছে নিকটবর্তিতা। কিন্তু এসব কথাতেও বাংলাদেশের মানুষ সাড়া দেয় নি। উর্দু যে বাংলার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এ কথা তারা কিছুতেই ভুলতে পারে নি। বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সরকারি কাজের ভাষা হিসেবে প্রয়োগ করার দাবি বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তুলেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানেও দাবি উঠেছে উর্দুর পক্ষে। মাতৃভাষাকে জীবনের সর্বত্র প্রচলিত করার পক্ষে দুই পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় একসঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন এই দাবি গভীর দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত। তা উৎসারিত ঠিকই, কিন্তু সে দেশ এক দেশ নয়, দুই দেশ। উর্দু প্রচলনের দাবি বাংলার আন্দোলনকে সাহায্য করেছে। সরকার চেষ্টা করেছে ধর্মের কথা বলতে, পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম থাকবে না, ইসলাম না থাকলে বেঁচে থেকে কি লাভ- এ ধরনের যুক্তির অবতারণা করতে, কিন্তু এই ধর্মীয় প্রতারণাতেও কোনো সুফল হয় নি।❏