সম্পাদকীয়, অনুস্বর
ফেব্রুয়ারি ২০২১, প্রস্তুতি সংখ্যা ১, বর্ষ ১
অবশেষে ‘অনুস্বর’ আত্মপ্রকাশ করল। ‘অনুস্বর’ এর পরিচয়টি অনুনাসিক বর্ণ। অনুনাসিক হলো নাক ব্যবহার করে যেসব বর্ণ উচ্চারণ করা হয়। না, নাসিকা কিংবা ব্যাকরণ আমাদের বলবার জায়গা নয়। আমাদের জায়গাটি নিয়মতান্ত্রিকতা ও শুদ্ধতা। উচ্চারনের নিয়ম না মেনে অনুস্বর বর্ণটি বলতে গেলে বলাটা হয়ে উঠবে না। শুদ্ধও হবে না। ঠিক এই অশুদ্ধতার বিপরীতেই আমাদের অবস্থান। আমরা— যা কিছু, সকল কিছুর শুদ্ধতায় থাকতে চাই। সত্যটা বলতে চাই। অনুস্বর স্বতন্ত্র কোনও বর্ণ নয়। ‘অ’ উচ্চারণে বিরতি বর্ণ। অনুমোদিত ব্যবহার। অনুমোদিত ব্যবহার চর্চা মানুষের মধ্যে সততা, সম্প্রীতি নির্মাণ করে। নিশ্চিত করে সুস্থ সুন্দর নিয়মতান্ত্রিক সমাজ। তৈরি করে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ।
জীবনে অনেক রকম দর্শন থাকে, আছেও। কিন্তু দর্শনের মূল জায়গাটি হলো আদর্শ। আদর্শটি হলো নীতি। নীতি থেকে বিচ্যুত জীবন কখনোই আদর্শ জীবন হতে পারে না। ক্ষমতার অপব্যবহার কখনও নীতিগত কাজ হতে পারে না। অস্তিত্ব, জ্ঞান, মূল্যবোধ, মানসিকতা ও ভাষা স¤পর্কে সাধারণ এবং মৌলিক প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোচনাই হলো দর্শন। লক্ষণীয় বিষয়, মৌলিক এ প্রশ্নগুলো সকলের মধ্যেই উত্থাপিত হতে পারে, হয়ও। ফলে সকলেই জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময়ে দার্শনিক বটে। এ কারণেই কাউকেই উপেক্ষা করবার জো নেই। সে কারণে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই সকলকে নিয়েই অনুস্বর পরিবার। অনুস্বর সকলের। অনুস্বর সবার।
এখন ফেব্রুয়ারি মাস। কিন্তু বাঙালির কাছে ‘ফেব্রুয়ারি’ নাম’ ছাপিয়ে ‘ভাষার মাস’ বলে পরিচিত হয়েছে সত্তর বছর হতে চলল। সে পরিচিতি এখন আর বাঙালির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিকভাবেই ভাষার মাস। মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন শুধুই শহীদ দিবস আর ভাষা দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর ভাষার এই মাসে নিজের ক্ষীণকায় শরীরটি নিয়ে পাঠকের সামনে এসে গর্বিত অথচ ঋজু ভঙ্গীতে দাঁড়াল ‘অনুস্বর’।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কিছু তরুণ মিছিল করেছিল। তরুণদের সে মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে কয়েকজন তরুণ প্রাণ হারায়। প্রতিবছর ওই দিনটি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। সব বয়সের মানুষ ভোরবেলা ফুল হাতে কালো ব্যাজ পরে খালি পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে যান শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাতে— এই-ই প্রভাতফেরি।ভাষা দিবস সংখ্যা
প্রভাতফেরি এখন প্রায় উঠেই গেছে। পশ্চিমের মতো রাত ১২টা ১ মিনিটে আমাদের সরকারপ্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দেন। শহীদ দিবস কথাটা আর তেমন শোনা যায় না। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা করার যে দাবি উঠেছিল, সে দাবি এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। রাষ্ট্রীয় কাজে এখনও ইংরেজির প্রাধান্য। উচ্চ আদালতে খুব কমসংখ্যক রায় বা আদেশ বাংলায় দেয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার না বাড়ার মূলে রয়েছে প্রথাগত মানসিকতা।
বস্তুত প্রথাগত এই মানসিকতা কেবল আদালত প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের রন্ধ্রেও প্রবাহিত। ফলে যাঁর সামর্থ্য বা সুযোগ আছে, তাঁর মধ্যেই নিজের সন্তানকে বাংলা মাধ্যমের বদলে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া শেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাকে আমরা এখনও ‘কাজের ভাষা’ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি নি। বাংলাকে শিক্ষা ও পেশার প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য করে তোলার প্রয়াস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মাতৃভাষাকে নিয়ে সেভাবে এগুতে পারি নি।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু আমাদের স্বকীয় চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হলে বাংলাকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা বা পেশার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে চাইলে তার উপযুক্ত পরিভাষাকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই বাংলা সর্বস্তরে ব্যবহারযোগ্য ভাষা হয়ে উঠতে পারবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশে যে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেদের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে, সে ভাষাগুলোর চর্চা ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করার দায়টিও আমাদেরই।
যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ভাষা হিসেবে বাংলার এই প্রতিষ্ঠা ও স্বীকৃতি, যে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাংলাভাষী মানুষেরা সে ভাষার নামে একটি দেশ পেয়েছে, সেই সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ সকল ভাষাশহীদকে আমাদের শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। ❐
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।