চৈত্রের শেষ দিন মাটি চৌচির হওয়া রোদে আমরা যখন বাতাসের আদুরে স্পর্শ পেতে বাড়ির দক্ষিণে খোলা মাঠের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য বেরুতাম, দেখতাম বাবা ডাল ধরনের কিছু একটা খাচ্ছেন। পরে জেনেছি ১৩ রকমের বনজ ফল ও সবজি দিয়ে রান্না হত এক ধরনের তরল খাবার যাকে বলা হতো ঝোল। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বাবা মেজ চাচীর হাতের ঝোল খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। এর পরেরদিনই বৈশাখের প্রথম দিন বা বাংলা বছরের প্রথম দিন। সেদিন দেখতাম ঘর-বাড়ি পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন রাখা, ভালো খাবার রান্না করা; যার ভেতর মাংস, মিঠা পানির মাছ, আমডাল, বিভিন্ন রকম ভর্তা, এসব থাকত। ওইদিন আনা হতো দেশী ফল; তরমুজ, বাঙ্গি এসব। বাজারের দোকানে দোকানে বসত চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ দু’দিন ধরে হালখাতা। এই দু’দিন ক্রেতা বা ভোক্তারা মিটিয়ে দিতেন দোকানদারের সমস্ত পাওনা। দোকানদার ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। হালখাতার মিষ্টন্ন খাবারের জন্য বাড়ির মেয়েরাও অপেক্ষা করে থাকত। গ্রামে স্কুল, কলেজের মাঠে বসত চুরি, ফিতা, মাটির তৈজসপত্র, ঝুরিভাজা, গজা, দানাদার মিষ্টি, বাতাসা, এসব নিয়ে মেলা। এমনই ছিল শৈশব মানে ’৯০-এর দশকের পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের চেহারা।
তার কিছু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশাখ উদযাপন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরোটা যেন সেজে উঠত ররেক রঙ আর বাহারি মেলায়। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, টিএসসি, রোকেয়া হল সংলগ্ন পুরোটা রাস্তা জুড়ে চুড়ি, গয়নার পসরা, কাঁচা আমভর্তা সে এক হুলস্থুল বৈশাখ উদযাপন। যা অমলিন আনন্দের স্মৃতি হয়ে থাকবে আমৃত্যু।
শূন্য দশকে এসে পুঁজিবাদ, অতিপ্রযুক্তি যখন মানুষের ঘাড়ে কালসাপের মতো নিঃশ্বাস ফেলছে; তখন ফ্যাশন হাউসগুলোর লাল সাদা রঙের অতি বাড়াবাড়ি, ইলিশ পান্তায় বৈশাখকে বন্দী করে ফেলার জোর অপচেষ্টা আর ইলিশের অবিশ্বাস্য মুল্য এসব কিছুর কারণে বৈশাখ কখনো কখনো মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের এক মৃদু আফসোসেও পরিণত হয়েছে।
ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এ পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
পহেলা বৈশাখ বা বর্ষবরণ বাঙালি জাতির উৎসব। এই উৎসব বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাঙালির অনুষ্ঠান। ২০১৬ সালে, ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি সমস্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক অর্জন। যখন সংস্কৃতির কোমর ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে জোরালো ভাবে, যখন ধর্মান্ধতার জয়জয়কার চলছে, দেশ ব্যাপী চলছে বঙ্গবন্ধু, লালন প্রমুখ মহাপুরুষ এর মূর্তি ভাঙার মহোৎসব তখন বৈশাখ প্রবল ঝাঁকুনি দিক বাঙালির মন আর মননে। ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি যেমন বাঙালির ধমনীতে প্রবাহিত, তেমনি বৈশাখ বাঙালির নাড়িতে পোঁতা। শুদ্ধ সংস্কৃতিতে অবগাহন করে বেড়ে উঠুক সুস্থ প্রজন্ম। বাংলাদেশ হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর মানবিক উৎকর্ষের আদর্শ।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে কারোনা মহামারির রাহুগ্রাস। আর এবার পহেলা বৈশাখের দিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রথম রমজান। রোজা রেখেই আমরা নিরাপত্তার সাথে পালন করব বাঙালি খাবার; মাছ, ভাত, ভর্তা আর মিষ্টান্নের সাথে বর্ষবরণ উদযাপন। এ বছর হয়ত পালন করা যাবে না মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখি মেলা। পৃথিবী সুস্থ হলে আবার আমরা মিলব প্রাণের উৎসবে।❐
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক