মহামারীর ইতিহাস মানব সভ্যতার মতোই প্রাচীন। প্রস্তুর যুগ থেকেই বিভিন্ন সময় সংক্রামক ব্যাধি মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, কখনও কোনো নির্দিষ্ট এলাকায়, কখনও আবার বিশ্বব্যাপী। দুনিয়া কাঁপানো কিছু মহামারীর তথ্য তুলে ধরা হলো-
৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব: প্রস্তর যুগ হামিন মঙ্গা। প্রাচীনতম মহামারী সাইটের মধ্যে মধ্য মঙ্গোলিয়া, উত্তর-পূর্ব চিনের ৫০০০ বছরের পুরনো ছোট্ট গ্রাম হামিন মঙ্গা। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিকরা আবিষ্কার প্রমাণ করেন মহামারী এ অঞ্চলকে পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল।
১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব: শেষ ব্রোঞ্জ যুগের প্লেগ প্রাচীনতম মহামারীগুলির মধ্যে একটি ১৩৩৫ খ্রিস্টপূর্ব অব্দে মিশরে আঘাত হানে অজানা প্লেগ। ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের পুত্র আখেনাটনের অধীনে লেখা একটি চিঠি পাওয়া যায়, যেখানে তার পিতার সময়ে এ মহামারীর উল্লেখ রয়েছে।
১২০০ খ্রিস্টপূর্ব: ব্যাবিলনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ব্যাবিলন, মধ্য এশিয়াও দক্ষিণ এশিয়াতে ১২০০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দের মহামারীর কথা ভারতীয় সংস্কৃত প–িতরা জানতে পারে। তারা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো একটি অজানা মহামারীতে বিনা চিকিত্সায় অগণিত মানুষের মৃত্যুর রেকর্ডও পেয়েছিলেন।
৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব: প্লেগ অব এথেন্স। ৪৩০ খ্রিস্টপূর্ব অব্দের দিকে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে প্লেগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাঁচ বছর ধরে চলা এই মহামারীতে ওই অঞ্চলের তিন ভাগের দুইভাগ অর্থাত্ প্রায় এক লাখের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। মহামারী এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, এতে কেউ মারা গেলে তার আশ-পাশের দুই-তিন ঘরের মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল।
১৬৫-১৮৫: এন্টোনাইন প্লেগ অফ রোম। ১৬৫-১৮৫ সালের মধ্যে এন্টোনাইন প্লেগ চীনে উত্পত্তি হয়ে এশিয়ার কয়েকটি দেশ,আফ্রিকার মিশর, সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যসহ প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়ে এই মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় গুটি বসন্তের জীবাণু থেকে এ মহামারী শুরু হয়েছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষই সংক্রমিত হয় এন্টোনাইন প্লেগে। শুরুতে আক্রান্ত সেনাদের জ্বর, গলা ব্যথা ও ডায়রিয়া দেখা দিত। পরে দেহে পুঁজযুক্ত ক্ষত হতো এবং শেষ পর্যন্ত মারা যেত তারা।
২৪৯-২৭১: সাইপ্রিয়ান প্লেগ বিশ্বে দীর্ঘসময় যেসব মহামারি টিকে ছিল এটি তার মধ্যে অন্যতম। কার্থেজ অঞ্চলের চার্চের যাজক সেন্ট সাইপ্রিয়ানের নামানুসারের এ মহামারীর নামকরণ করা হয়। অনুমান করা হয় সাইপ্রিয়ান মহামারীতে রোমে একদিনে পাঁচ হাজার মানুষ মারা যায়। সাইপ্রিয়ান প্লেগ ২৪৯ থেকে ৪৪৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩শ’ বছর ধরে আক্রমণ চালায়।
৫৪১ সাল: জাস্টিনিয়ান প্লেগ, রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নামানুসারে রাখা ভয়াবহ মহামারী ৫৪১ সালে শুরু হয়ে ৭৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই শতাব্দী চলতে থাকে। চীন ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে সমুদ্র পথে ছড়িয়ে পড়েসমগ্র ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ পুরো বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যজুড়ে। মৃতের সংখ্যা এতই বেশি ছিল বিশালাকার গর্ত করে ৭০ থেকে ৮০ হাজার লাশ পুঁতে রাখা হয়। মারা যায় অন্তত পাঁচ কোটি মানুষ। ধারণা করা হয়, এ সময় ইউরোপের অর্ধেক মানুষই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
৬৩৯ সাল: সিরিয়া ও ফিলিস্তিন প্লেগ এপিডেমিক। মুসলিম খিলাফতের প্রাথমিক সময় ৬৩৯ সালে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। খলিফা ওমর (রা.) প্লেগ দেখা দিয়েছে জানতে পেরে সিরিয়া সফর বাতিল করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে প্লেগ ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে মহামারীতে প্রায় আড়াই হাজার সাহাবি ও বিশ হাজার মুসলিমসহ অনুমান করা হয় কয়েক লক্ষ মানুষ মারা যায়।
৭৩৫-৭৩৭ সাল: স্মলপক্স দুইবছরে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্সের ছোবলে জাপান প্রায় জনমানবহীন হয়ে পড়েছিল। এই গুটি বসন্তের কারণে জাপানের এক তৃতীয়াংশ, অর্থাত্ প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় ।
১৩১৩-১৩৫৩ সাল: ১৩১৩ থেকে ১৩৫৩ সালে মহামারীর ইতিহাসে ব্ল্যাক ডেথ নামে পরিচিত। চীন থেকে মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে থেকে সিল্ক রোড হয়ে ১৩৪৮ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সমগ্র ইউরোপে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। ছয় বছরে ইউরোপের অর্ধেকের মতো, আনুমানিক ২০ থেকে ৩০ মিলিয়ন মানুষ বুবোনিক প্লেগে মারা যায়। সারা বিশ্বে এ মহামারির ফলে ১৫০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়।
১৩৬১ থেকে ১৪৮০ সাল: এপিডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ’ বা দ্বিতীয় প্লেগ ইংল্যান্ডে ১৩৬১ থেকে ১৪৮০ পর্যন্ত মহামারী বারবার আঘাত হানে। ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা অর্ধেক কমে গিয়েছিল। ১৪২০ সালে রোমে ছড়িয়ে পড়ে ‘দ্য এপিডেমিক অব ব্ল্যাক ডেথ’ অর্থাত্, দ্বিতীয় প্লেগ প্রলয়। পরবর্তীতে অন্য দেশেও ছড়িয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই এটি নিশ্চিহ্ন করে দেয় অনেক জনপদ।
১৪৯২ সাল: ক্যারিবিয়ান স্মলপক্স এপিডেমিক। ক্যারিবিয়ানে সপ্যানিশদের আগমনের পর ১৪৯২ সালে মহামারি রূপ নেয় গুটি বসন্ত। দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে পড়া মহামারীর ফলে দ্বীপটির প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ মানুষেরই মৃত্যু হয়েছিল।
১৫১৯-১৫৩২ সাল: স্মলপক্স এপিডেমিক অব মেক্সিকো। অ্যাজটেক রাজধানীতে ১৫১৫ সালে সেপনিয় বাহিনী এবং বণিকরা নিয়ে আসে গুটি বসন্ত বা স্মল পক্স। ফলে মেক্সিকোতে ১৫১৯-১৫২০ সালে স্মল পক্স ছড়িয়ে পড়লে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ। আর সমপূর্ণ ধ্বংস হয় আমেরিকার অ্যাজটেক ও ইনকা সভ্যতা। অনেকে মনে করেন পশ্চিম গোলার্ধে আদিবাসীদের ৯০ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল।
১৫৪৫-১৫৪৮ সাল: কোকোলিজিটলি এপিডেমিক। অ্যাজটেক ভাষায় পোকা বা কোকোলিজিটলি মহামারি মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকার ১৫ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল। বর্তমানে এটি এস প্যারাটিফি সি নামে পরিচিত, যা এন্ট্রিক জ্বর, টাইফয়েডসহ এক ধরণের জ্বরের কারণ। এতে উচ্চ মাত্রার জ্বর, ডিহাইড্রেশন এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে,যা আজও একটি বড় স্বাস্থ্য হুমকিস্বরূপ।
১৬২০ সাল: ‘মে ফ্লাওয়ার’ এপিডেমিক। ১৬২০ সালে লন্ডনে অন্যতম মহামারী মে ফ্লাওয়ার থাবা বসায়, যা সারা বিশ্বে দ্রুত তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। মহামারীর এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে একে ইউরোপের তুষারাচ্ছন্ন পর্বতে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া রক্তিম মে ফ্লাওয়ার বলা হত। নানা অজানা বিভিন্ন ভাইরাস জ্বর, স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাসে ৯০ শতাংশ মানুষই আক্রান্ত হয়ে লন্ডন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।
১৬২৯-১৬৩১ সাল: প্লেগ অফ ইটালি। ১০ বছর পর আরেকটি মহামারীর আসে ইউরোপের আরেক দেশ ইটালিতে। ১৬২৯ থেকে ১৬৩১ সালে প্লেগ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। আড়াই লাখ মানুষ মারা যায় এই মহামারীতে।
১৬৩৩ সাল: স্মলপক্স এপিডেমিক অব আমেরিকা। ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন ও নেদারল্যান্ডসবাসীর মাধ্যমে ১৬৩৩ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় ।
১৬৬৫ সাল: গ্রেট ব্রিটেনে ব্ল্যাক ডেথের বড় আকারের প্রাদুর্ভাব হয় লন্ডনে ১৬৬৫-৬৬ সালে। এটাই ইংল্যান্ডের গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন। প্লেগের শেষ বড় আঘাত। মহামারীটি ১৬৬৫ সালের এপ্রিল মাসে শুরু হয়ে গ্রীষ্মের মাসগুলিতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হয় এই মহামারীতে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মারা যায়, যা লন্ডনের মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ ছিল।
১৭২০-১৭২৩ সাল: ফ্রান্সের মার্সেইলে তিন বছর বিরাজমান দ্য গ্রেট প্লেগ অব মার্সেইল মহামারীর ফলে মার্সেইয়ের জনসংখ্যার ৩০ ভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল। ঐতিহাসিক রেকর্ড অনুসারে ভূমধ্যসাগর থেকে পণ্যবাহী জাহাজে করে, সম্ভবত প্লেগ মহামারী আকারে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুধু মার্সেইল নগরীতে ৫০ হাজার আর পুরো ভলকান ও ফ্রান্স জুড়ে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
১৭৭০-১৭৭২ সাল: রাশিয়ান প্লেগ এপিডেমিক। মধ্য রাশিয়ায় প্লেগের সর্বশেষ প্রাদুর্ভাব ছিল যা, ১৭৭১ এর প্লেগ নামে পরিচিত। ধারণা করা হয় শুধুমাত্র মস্কোতেই ১ লক্ষ মানুষ মারা যায়। প্লেগ-বিধ্বস্ত মস্কোয় বিচ্ছিন্ন নাগরিকদের দাঙ্গার ফলে আর্চবিশপকে হত্যাসহ সমস্ত কারখানা মস্কো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৭৯৩ সাল: ইয়েলো ফিভার এপিডেমিক অব আমেরিকা। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় ১৭৯৩ সালে ইয়েলো ফিভার মহামারী আকার ধারণ করে। পাঁচ হাজার আফ্রিকান আমেরিকানসহ নগরের ১০ ভাগের এক ভাগসহ প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ মারা যায়। এই জ্বর শহরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে ফিলাডেলফিয়ায় দাস ব্যবসার পথ ধরে রাশিয়া ইউরোপসহ পৃথিবীর লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়।
১৮১৭ সাল: কলেরা এপিডেমিক। দুই গ্রিক চিকিত্সকের লেখায় বহু আগেই গঙ্গার তীরবর্তী এলাকায় কলেরার মতো রোগের কথা উল্লেখ করা হলেও রোগটি প্রথম বৈশ্বিকভাবে মহামারী আকার ধারণ ১৮১৭ সালে।
বাংলাদেশের যশোরে এই রোগের প্রাদুর্ভাবে মানুষের প্রাণহানি ঘটতে থাকে। কিছুদিনের মধ্যে তা ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারের অধিকাংশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৮২০ সাল নাগাদ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সে মহামারী আকারে এই রোগ দেখা দেয়। ওই সময় ইন্দোনেশিয়ার শুধু জাভা দ্বীপেই কলেরায় এক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পরের বছর ইরাকের বসরায় তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রাণ হারান ১৮ হাজার মানুষ। এরপর আরব থেকে বাণিজ্য পথ ধরে পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী সহ ইউরোপ ও আমেরিকায় দেশগুলোতে কলেরা সাতবার ছড়িয়ে পড়ে বৈশ্বিক মহামারীর রূপ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এখনও প্রতি বছর এই রোগে প্রায় ৯৫ হাজার মানুষ মারা যায়।
১৮৬০ সাল: দ্য থার্ড প্লেগ প্যানডেমিক বা তৃতীয় প্লেগ। ইতিহাসে তৃতীয় প্লেগ মহামারির উত্পত্তি ছিল ১৮৬০ সালে চীনে। ইউয়ান নামক একটি ছোট্ট গ্রামে থেকে ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে করতে হংকং আর গুয়াংঝু প্রদেশে থেকে ছড়িয়ে যায় ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এ মহামারীতে প্রাণ হারায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ।
১৮৮৯-১৮৯০ সাল: রাশিয়ান ফ্লু (টাইপ- এইচ৩এন৮) এপিডেমিক। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে এই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। মাত্র কয়েক মাসে রোগটি বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। সর্বোচ্চ মৃত্যুহারে পৌঁছাতে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময় নেয়। ১৮৮৯ সালে ‘রাশিয়ান ফ্লু’ (টাইপ- এইচ৩এন৮)-তে পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ায় মারা যায় ১০ লক্ষ মানুষ।
১৯১০ সাল: দ্য প্লেগ এপিডেমিক অব ফার্স্ট ডিকেড। বিশ শতকের সবচেয়ে বড় প্লেগ মহামারী দেখা দেয় ১৯১০ সালে। চীনের মাঞ্চুরিয়ায় দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। এটি চতুর্থ প্লেগ মহামারী হলেও মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। বিস্তীর্ণভাবে ছড়ায় নি।
১৯১৬ সাল: দ্য পোলিও এপিডেমিক অব আমেরিকা। ১৯১৬ সালে পোলিও প্রথম মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ জুন, শনিবার নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে পোলিওকে মহামারী হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। সেই বছর আমেরিকাতে ২৭ হাজার মানুষ পোলিওতে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৬ হাজারই মারা যায়! ফলে মহামারীটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
১৯১৮-১৯২০ সাল: সপ্যানিশ ফ্লু (টাইপ এইচ১এন১) এপিডেমিক। ‘সপ্যানিশ ফ্লু’ (টাইপ এইচ১এন২)-তে ১৯১৮ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। যা ‘দ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যানডেমিক’ বা সপ্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত। অল্প সময়ের মাঝেই সমগ্র বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ, দক্ষিণ সমুদ্র থেকে উত্তর মেরু পর্যন্ত আনুমানিক ৫০ কোটি মানুষ সপ্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী বিলুপ্তির পথে চলে যায়। সপ্যানিশ ফ্লু ভারতে ‘বোম্বে ফিভার’ নামে ছড়িয়ে পড়ে। এ মহামারীতে প্রায় ১২ বিলিয়ন লোকের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। যা ছিল সে সময়ের সমগ্র জনসংখ্যার ৫ শতাংশ।
১৯৫৭-১৯৫৮ সাল: এশিয়ান ফ্লু এপিডেমিক। বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জার ধাক্কার আরেক নাম এশিয়ান ফ্লু। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাপুরে এবং এপ্রিলে হংকংয়ে ফ্লু শনাক্ত হয়। চীন-সিংগাপুর-হংকং হয়ে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লু ভাইরাসটি ‘এশিয়ান ফ্লু’ (টাইপ এইচ১এন২) নামে বিশ্বে আতঙ্কের সৃষ্টি করে, ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে যুক্তরাজ্যে মহামারীতে রূপান্তরিত হয়। মারা যায় আনুমানিক ২০ লক্ষ মানুষ।
১৯৭০ সাল: স্মলপক্স এপিডেমিক অব ইন্ডিয়া। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কারের পরেও পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে ১৯৭০ সালে ভারতে হঠাত্ মহামারী আকারে ছড়িয়ে যায় স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত। ১ লক্ষাধিক মানুষ রাতারাতি এ রোগে আক্রান্ত হয়। মারা যায় ২০ হাজারের বেশি মানুষ।
২০০৩ সাল: সার্স এপিডেমিক (সার্স-কোভ) বা প্রথম করোনা ভাইরাস এপিডেমিক। চীনের ইউনান প্রদেশ হতে সার্স (সার্স-সেভার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম, সার্স-কোভ) নামে ২০০৩ সালে প্রথম করোনা ভাইরাস আবির্ভূত হয়। সব মিলিয়ে ২৯টি দেশে ৮ শতাধিক লোক সার্সে মারা যায়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বায়ুবাহিত এ রোগের জীবাণু সহজেই এশিয়ার সামান্য কিছু অংশসহ ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৪ সাল: ‘বার্ড এভিয়ান ফ্লু’ (টাইপ এইচ৫এস১) এপিডেমিক ২০০৪ সালে ‘বার্ড এভিয়ান ফ্লু’ (টাইপ ঐ৫ঘ১) নামে এ ভাইরাসটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে বিশ্বব্যাপী আতংক তৈরি করে। পশুপাখি মারা গেলেও এ রোগে খুব বেশি মানুষ মারা যায় নি। এটিকে বার্ড ফ্লু বা বার্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং এভিয়ান ফ্লু নামেও ডাকা হয়। ভাইরাসজনিত একটি ছোঁয়াচে রোগ হিসাবে এই রোগটি পাখিদের থেকে মানুষের হাঁচি বা কাশি থেকে নির্গত ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়।
২০০৯ সাল: সোয়াইন ফ্লু এপিডেমিক ২০০৯ সালের এপ্রিলে মেক্সিকোতে প্রথম সোয়াইন ফ্লুতে আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। সেখান থেকে এই ভাইরাস ৭৪টি দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বজুড়ে ২০০৯ সালে এ রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখ ৭৫ হাজার বলেও ধারণা করা হয়।
২০১০ সাল: কলেরা এপিডেমিক অব হাইতি। ভূমিকম্পের নয় মাস পরে, ২০১০-এর অক্টোবরে, হাইতিতে
কলেরা মহামারী রূপ ধারণ করে। কলেরা মহামারীর সামপ্রতিক ইতিহাসে এইটাই ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, প্রায় ৮ লক্ষের বেশি আক্রমণ এবং সঙ্গে সঙ্গেই ১০ হাজারের বেশি মৃত্যু।
২০১৪-২০১৬ সাল: ইবোলা এপিডেমিক ঘাতক ভাইরাসের শীর্ষে থাকা ২০১৪ সালে বিশ্ব আতঙ্ক ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণে মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি হতে পারে। পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে শুরু হয়ে লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনসহ কয়েকটি দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দূরবর্তী ভূখ–েও পাওয়া গেছে। দুই বছরে ১২ হাজারেরও বেশি মৃত্যু হয়। এ ভাইরাসের কোনো কার্যকর প্রতিষেধক তৈরি করা যায় নি। ইবোলা ভাইরাস সংক্রামিত মানুষের রক্ত, লালা বা যে কোনো নিঃসৃত রস থেকে কিংবা শরীরের ক্ষতস্থানের মাধ্যমে অপরের শরীরে সংক্রামিত হয়ে থাকে।
২০১৫ সাল : মার্স (মার্স-কোভ) দ্বিতীয়করোনা ভাইরাস এপিডেমিক। ২০০৩ সালের পর সৌদি আরব ও কাতারে দ্বিতীয়বার করোনা ভাইরাস মার্স (মার্স-মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম মার্স-কোভ) নামে দেখা দেয়। মার্সের উত্পত্তি ঘটে ২০১৫ সালে ২১টি দেশে মার্সের প্রকোপ ঘটে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্স ভাইরাস সৃষ্ট নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর হার ছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। মার্সের লক্ষণগুলো হলো— সর্দি-কাশি-জ্বর আচমকা প্রবল শ্বাসকষ্টে পরিণত হয় এবং তা ক্রমে জটিল আকার ধারণ করে। মার্স করোনা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয় নি।
২০১৯-২০২১ সাল: কোভিড-১৯ (২০১৯-এনকোভ) তৃতীয় করোনা ভাইরাস। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে আবির্ভাব হলো তৃতীয় করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। ভাইরাসটির এবারের প্রজাতির নাম ২০১৯-এনকোভ। ইতোমধ্যে ভাইরাসটি বিশ্বে সকল দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি জনস্বাস্থ্য বিষয়ে বিশ্বব্যাপী জরুরি অবস্থা এবং ২০২০ সালের ১১ মার্চ মহামারী হিসাবে ঘোষণা করে। ১৩ মে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৬০ মিলিয়নেরও বেশি রোগী এবং ৩.৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে এটি পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক চলমান বৈশ্বিক মহামারী।
লেখক: গবেষক