চলচ্চিত্রের ভাষা নিয়ে আলাপ করতে গেলে প্রথমেই ভাষাকে আলাদা করে নিতে হয়, একটি হলো চালচ্চৈত্রিক ভাষা, আর অন্যটি হলো চলচ্চিত্রের ভেতরে ব্যবহৃত কথা বা সংলাপ। যত দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্র নির্বাক ছিল, তত দিন চলচ্চিত্র তার নিজস্ব ভাষা দিয়ে, অর্থাৎ ছবির মালা গেঁথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে দর্শকের সঙ্গে। যখন চলচ্চিত্রের বোল ফুটল, তখন থেকে মুখের ভাষা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হতে শুরু করল, কখনো সংলাপে, কখনো ধারাবর্ণনায়।
তবে এটা মনে রাখা দরকার, শব্দযুক্ত চলচ্চিত্রে অন্যান্য শব্দ ও নৈঃশব্দ্য তো থাকেই, সেগুলোর মধ্যে সংলাপ বা কথাবার্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, ওটাই সবার আগ্রহের শীর্ষে থাকে। ঋত্বিক ঘটক ‘ছবিতে শব্দ’ প্রবন্ধে যেমনটা বলছেন, ‘শব্দের যে ফিতেটা বাহিত হয়ে অহরহ বয়ে চলেছে প্রেক্ষণ যন্ত্রের মধ্যে ছবির সঙ্গে সঙ্গে তার উপাদানগুলো কী কী? পাঁচটি। কথা বা সংলাপ, সংগীত, রহপরফবহঃধষ হড়রংব অর্থাৎ যা ছবিতে দৃশ্যমান ঘটনাগুলোর পরিপূরক শব্দ, বভভবপঃ হড়রংব অর্থাৎ দৃশ্যোর্ধ্ব দ্যোতনাময় শব্দ এবং নীরবতা। সংলাপ নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, ওটি সবচেয়ে প্রকট। ওটি ছবির গল্পকে (অবশ্য যদি থাকে) সোজা এগিয়ে নিয়ে যায় দৃশ্যমান ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে। ওটি প্রাথমিক স্তরের।’
প্রাথমিক স্তরের প্রকট জিনিসটি এই ভূখণ্ডে প্রথম শোনা যায় ‘মুখ ও মুখোশ’ (১৯৫৬) চলচ্চিত্রে, কারণ ওটাই প্রথম বাংলা সবাক ছবি। আব্দুল জব্বার খান পরিচালিত এই ছবিতে সংলাপ হিসেবে যে ভাষা আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি, তাতে মান বাংলার প্রভাবই ছিল বেশি। চরিত্রদের মুখে পূর্ববঙ্গের ভাষা ছিল, তবে কম।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদিয়া ও হুগলি এলাকার মানুষের মুখের ভাষাই যেহেতু প্রমিত বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তাই সেখানকার কথাবার্তার ধরনটাই ধারণ করা আছে ছবিতে। ওই অঞ্চলের ভাষা যে মান ভাষার সম্মান পেল এর পেছনে ভাষার রাজনীতি তো ছিল অবশ্যই, নয় তো আজকে ময়মনসিংহের ভাষাই ব্যবহৃত হতে দেখা যেত টালিউডের দেব বা শুভশ্রীর ঠোঁটে। সেটা যেহেতু হয় নি, তাই আমাদের শাকিব-অপুরা কলকাতার ভাষায়ই কথা বলেন ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছবিতে অবশ্য পূর্ববঙ্গের গ্রামের ভাষার ব্যবহার বেড়েছে, একেবারে ‘নয়ন মণি’ (১৯৭৬) থেকে শুরু করে হালের ‘সোনাবন্ধু’ (২০১৭) পর্যন্ত, গ্রামনির্ভর এসব ছবির চরিত্ররা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের ভাষারীতি ব্যবহার না করলেও মান ভাষা অন্তত ব্যবহার করে নি। তবে মিশ্র ভাষার ব্যবহারও দেখা গেছে বাংলাদেশের ছবিগুলোতে। সবচেয়ে ব্যবসা সফল ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ (১৯৮৯) ছবির ভেতর চরিত্রদের মুখে বিশুদ্ধ মান বাংলা যেমন শোনা গেছে, তেমনি শোনা গেছে গ্রামের ‘অশুদ্ধ’ ভাষা, সাধু ভাষার সঙ্গে চলতি বাংলা মিলিয়ে গুরুচণ্ডালি ভাষাও বলতে শোনা যায় এই ছবিতে। তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত এই ছবিতে বেদের মেয়ে জোসনা কখনো শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে, কখনো আবার আঞ্চলিক বাংলায়। তাতে অবশ্য গল্পের কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না।
কোনোরকম বাংলা ভাষাকে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হবে বা হচ্ছে, মান বাংলা, অ-মান বাংলা, মিশ্র বা আঞ্চলিক, সেগুলোর থেকেও বড় প্রশ্ন এলে গোটা সমাজে বাংলা ভাষার চর্চা কতটুকু হচ্ছে? আমাদের সমাজে যেমনটা চলছে, তাতে যদি আগামী ১০ বছরের মধ্যে ইংরেজিকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করে দেওয়া হয়, তাহলে কেউই আর আপত্তি জানাবে না। তাছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রেও কিন্তু এর সপক্ষে অনেক দৃশ্য দেখা যায়, দেখা যায় নায়ক যখন ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, তখন তাকে খুব বাহবা দেওয়া হয়। নায়ক বা নায়িকার ইংরেজি জানা যেন যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা ছোঁয়ার মতো ব্যাপার। ঘটনা আসলে এমনটাই, ইংরেজিকে আমরা উচ্চতর আসনে বসিয়ে ফেলেছি। আমরাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছি, যেখানে ‘বাংলা ভালো বলতে পারি না’ মন্তব্যকে বেশ ইতিবাচক ও শিক্ষিত মানুষের স্বাভাবিক বুলি হিসেবে ধরি, আত্মতুষ্টি লাভ করি এবং বাংলা সিনেমাকে ছোটলোকের বিনোদন বলে উড়িয়ে দিই।
কথা হলো চলচ্চিত্রে বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার, সেটা হোক আঞ্চলিক বা মান বাংলা; তখনই নিশ্চিত হবে, যখন গোটা সমাজে বাংলা ভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা বাড়বে, উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মাতৃভাষার প্রতি বেইমানি বন্ধ করবে এবং নির্মাতারা যখন বুঝতে শিখবেন কোন চরিত্রের মুখে কোন ভাষা বসালে চলচ্চিত্রে সেটা বেখাপ্পা লাগবে না। চলচ্চিত্র কোনো বিচ্ছিন্ন বস্তু নয়, সমাজেরই অনন্য ভাষ্যকারমাত্র।❐