‘আব্বা চলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটা ঘুরে আসি।’
আমার বড় কন্যা নিয়ন্তাও বলে উঠল, ‘নানাভাই, এই তো বাসার কাছেই, আগারগাঁও।’
আব্বা শুনেই বললেন, ‘আগে না সেগুনবাগিচায় ছিল!’
‘জ্বি আব্বা। এখন এখানে।’
‘নানাভাই, কি যে সুন্দর!’
‘আচ্ছা যাওয়া যায়।’
কেন যেন সেদিন বিকেলে যাওয়া হলো না। কিন্তু সন্ধ্যার পর মা-মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পর আব্বা তাঁর দুঃসহ স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর অংশগ্রহণের গল্প শোনালেন। বর্ণনা করলেন সেই রোমহর্ষক রাতের আঁধারে কিভাবে জীবন বাজি রেখে, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
‘সাতই মার্চের পর থিকা এই কুত্তা কমিনের চাকরি আর ভাল্লেগতেছিল না। ঘুম হতো না। মনে হতো কখন এই খাঁচা থেকে মুক্ত হবো। সুযোগ পাইলেই কোনোমতে একটা অস্ত্র নিয়া পালাব, দেশের জন্য যুদ্ধ করব। কাল রাত্রিটাই সেই সুযোগ করে দিল। জীবন যেতে যেতেই পায়া গেলাম সেই সুযোগ।’
আব্বা ছিলেন তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) সদস্য। পদবী নায়েক।
‘পঁচিশে মার্চ রাতে বেলুচ রেজিমেন্ট থেকে গ-গোল লাগবে লাগবে এমন আভাস পিলখানার ১১ নম্বর সিগন্যাল আগেই পাওয়া যাইতেছিল। তার আগে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাদের দুই তিনজন একসাথে কইরা ডিউটি পড়ত। ওইখানে তেমন বড় কোনো কাজ ছিল না। পিলখানার ভেতরে পাঞ্জাবিরা এসে কি ধরনের কর্মকাণ্ড চালায়, কি করে না করে এগুলো একটু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছে দেয়া। পঁচিশে মার্চের হামলার আগে পাকসেনারা পিলখানায় এসে ‘রেকি’ করত। এগুলো বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জানায়তাম।’
‘আমি আর নিয়ন্তা বিস্ময়ে একই সাথে জিজ্ঞাসা করে উঠলাম ‘রেকি করা’ কি?’
আব্বা বলতে লাগলেন, ‘রেকি হলো দেখা। কোথায় কিভাবে কোন্ পজিশন থেকে হামলা করবে, কোথায় নিজেরা আত্মরক্ষার জন্য লুকাবে এগুলো আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করা। এ সময় পাঞ্জাবিরা পিলখানায় এসে ঘোরাঘুরি করত, টহলদারি করত কিন্তু কোনো অসদাচরণ করত না। আমি থাকতাম, ১০ নম্বরের ওয়াটার গার্ডেনের সাথে একটা বিল্ডিং আছে, সেইখানে। খাওয়া-দাওয়া এইখানেই হতো। এর ঠিক পাশেই সিগন্যাল ব্রাকে নাইট ডিউটি থাকতো। ধানমন্ডির ৩২ এর সাথে সবসময়ই খবরাখবর ছিল। রাতে যখন জানলাম বঙ্গবন্ধু পতাকা উড়ায়ছেন তখন কিন্তু আমরাও নিজেরা নিজেরা পিলখানাতে লাল সবুজের পতাকা উড়ায়ছিলাম। কিন্তু ওই রাতে বেলুচ রেজিমেন্টের পাক হানাদার দিয়ে পিলখানা একেবারে ভরে গেল। পাকিস্তানি জানোয়ারেরা যখন আক্রমণ শুরু করল তখন আমি শোয়াছিলাম। ঘুম আসে নাই। হামলা শুরুর মেসেজ পাইতেছিলাম বিভিন্ন জায়গা থেকে। মূহুর্মুহু গুলির আওয়াজ, ঝাঁকে ঝাঁকে বুটের শব্দ আর সৈনিকদের আর্তনাদে পিলখানার বাতাস ভারী হয়ে গেল। পরে শুনেছিলাম বেশি হত্যাযজ্ঞ চালায় ঢাকা কলেজের বর্ডার ঘেঁষে পিলখানার যে অংশটা সেখানে। প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার বিডিআর মেরে ফেলছে ওই রাতেই (স্বাধীনতার পর ইপিআর নাম পরিবর্তন করে বিডিআর মানে বাংলাদেশ রাইফেলস্ করা হয়। আব্বার মুখে আমরা বিডিআর নামটাই শুনতাম)।’
‘ধীরে ধীরে বুটের শব্দ একেবারে কানের পাশে মৃত্যুর বার্তা নিয়া আসলো। বুঝলাম এবার আমাদের পালা। পাকসেনারা সিগন্যাল ব্রাকে (ব্যারাকে) আক্রমণ কইরা সবাইকে ড্রেনের পাশে নিয়া এক জায়গা করল। ব্রাশ ফায়ারের সময় যখন সব পড়তে শুরু করল তখন আগেই ড্রেনে পইড়া গেলাম। ওইটাই আমার বাঁচার সুযোগ তৈরি করে দিল। পিলখানার ড্রেন বেশ গভীর, প্রায় এক কোমড়।’
আমি কল্পনায় তখন যুদ্ধে চলে গেছি। আমার শিশুকালের দেখা পিলখানার ড্রেনগুলো চোখে সামনে এসে পড়ল। আর ভাসছিল আব্বা কিভাবে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। গায়ের রক্ত আমার হিম হয়ে গেছে তখনই, ‘তারপর আব্বা?’
‘জানোয়ারেরা যখন সরে গেল তখন উইঠা রাইফেল নিলাম। রাইফেল নিয়ে ওই ড্রেন দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে আগাইতেছিলাম। উপরে উঠলেই শুধু লাশ আর লাশ। পিলখানার হাজারিবাগ নবাবগঞ্জের দিকে যে গেইট সেদিকের ওয়াল টপকায়া বাইরে আসলাম। এই গেইটার সাথে পরে যেখানে সিনেমা হল করা হয়েছে তখন এখানে মানুষের পায়খানা, পচা আবর্জনা দিয়ে ভরা থাকতো। কিসের গু কিসের ময়লা সব পায়ের নিচে ফালায়া সোজা দিলাম হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে বুড়িগঙ্গার তীরে আসলাম। এখন ভাবতেছি কিভাবে নদী পার হবো! কিছু নাই। আবার ভাবতেছি ওরা যদি ধরে তাহলে তো মেরে ফেলবে। ওদের হাতে মরবো ক্যান, মরলে নিজের দেশের পানিতে ডুবে মরব। এটা ভেবেই পানিতে নাইমা পড়লাম। কিভাবে সাঁতরাইছি জানি না সাঁতরায়া কামরাঙ্গীরচরের ওপারে উঠলাম। শুধু হাঁটতেছি আর হাঁটতেছি পিছনে আর তাকাই না। হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। গ্রামের লোকজন পায়া জাপটে ধরল। ঘরের ভেতরে নিয়ে বসাইলো, খাবার দিতেছে, মাথা হাতায় দিতেছে। আর কত প্রশ্ন! কি হইতেছে ওইখানে! কেমনে আসলা! ক্যামনে তুমি বাঁচলা! তারা রাইফেল দেখেও ভয় পাইতেছে না। তারা দেখতেছে একজন বাঙালি বাঁইচা আসছে। আমার মনে পড়ল মায়ের মুখখানা। মনে হলো গ্রামে আমার এখনই যাইতে হবে। আবার হাঁটা দিলাম ওই রাতেই। হাঁটতে হাঁটতে তখন সকাল গড়ায় গেছে। পদ্মার পাড়ে তখনও পৌঁছাই নাই।’
‘এদিকে হইছে আরেক কাণ্ড! আব্বা খবর পাইছে পিলখানায় হামলা হইছে। উনি মের্জারচর (মাদারীপুরের শিবচর থানার একটি গ্রাম) থেকে রওনা দিছে আমার জন্য। গ্রামের লোকজন আমারে দেখতেছে আর আব্বার কথা শুনে মিলায়া বলতেছে যে আমি তারই ছেলে, আমার আব্বা আমার জন্য ঢাকার দিকে রওনা দিয়ে দিছে।
পথে আব্বার সাথে আমার দেখা হয় নাই। নৌকায় পদ্মা নদী পাড় হয়ে আমি গ্রামে গেলাম। আমার মা আমাকে জাপ্টায়া ধরলো (এটা বলতে গিয়ে আব্বার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল)। কয়েকটা দিন বাড়িতেই থাকলাম। ভাবতেছিলাম কিভাবে শুরু করা যায়, অস্ত্রটাও সাথে। এর মধ্যে আব্বা আমাকে খুঁজতে ঢাকা পর্যন্ত গিয়া তিন চার দিন পর ফেরত আসছেন। মজার বিষয় হইল যে পথ দিয়া তিনি গেছিলেন সেই পথ দিয়াই ফেরত আসছেন।তাই গ্রামের লোকজন তাঁকে বলে দিছে আমি বাঁইচা আছি। লোকজন মনে হয় বইসা ছিল কখন আব্বা যাবে পথ ধরে। আব্বা বাড়িতে ঢুকলেন, ‘আজিজ, আমার আজিজ, বাবা তুমি কই।’
‘আমাকে বুকে জড়ায়া ধরলেন।’
আব্বার গাল বেয়ে আবার টপটপ করে পানি গড়াতে লাগল।
‘খোঁজ নিতে নিতে জাইনা গেলাম কারা মুক্তিযুদ্ধের সাথে সরাসরি জড়িত। যোগাযোগ করলাম। আমার কাছে অস্ত্র আছে শুইনা এক নিমিষেই দলে জায়গা দিল। দলে শুরু থেকে আমার অবস্থা খুব শক্ত ছিল, আমার ফিটনেস আর অস্ত্র চালনা জানার জন্য। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল লোকাল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার। এক এক করে আরো অনেক জোয়ান যোগ দিতে থাকলো। যতই দিন যাইতেছিল আমরা ততই সংগঠিত হতে থাকলাম। এদিকে হানাদার বাহিনী গ্রামের রাজাকার দোসরদের নিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ চালায় যাইতেছিল। শিবচর থানা পুরাপুরি পাকিস্তানিদের দখলে তখন। ওইটাই আমাদের মূল নিশানা হইলো।’
‘আক্রমণের জন্য ভারতে যারা ট্রেনিংয়ের জন্য গেছে তাদের ফেরার অপেক্ষায় রইলাম আমরা। ১৮ দিন পর ওরা আসলো। আমরা আক্রমণের ছক আঁকতে থাকলাম। শিবচর থানার সামনে মাইলখানেক নালা জমি এরপর বিল পদ্মা নদী। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে নালা জমি থ্যাকথ্যাকে কাদায় ভরা, একটু উঁচু জমিতে কিছু কিছু শীতের সবজি লাগানো, জায়গায় জায়গায় শন টাইপের ঘাসের গোছা। পুরো পরিবেশটাই যেন পাকিস্তানিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুইখা দাড়ানোর উপযুক্ত সময়। দেরি করলাম না আমরা। আক্রমণ করলাম ভোরের দিকে। আমরা অবস্থান নিলাম নালার মধ্যে। ফিটনেস, নিশানা ভালো থাকায় আমাকে সব সময়ই দলের সামনে রাখতো। আমারও পিছ পা হইতে ইচ্ছা করত না। ছক অনুযায়ী আগাতে থাকলাম। শিবচর থানার সামনে থেকে শুরু করে বাজার পযন্ত সামনা-সামনি যুদ্ধ হইল। আমরা জিতলাম। থানার সামনে দুইজন পাকসেনাকে মারলাম আমরা। সে কি নাচানাচি আমাদের! গ্রামের লোকজন পারলে তাদের পাড়ায়া মাটির নিচে ঢুকায়া ফেলে। আমাদের যে দুই তিনজন আহতো হইছে তাদেরকে নেয়া হইল স্থানীয় ডাক্তার আবদুল মান্নান খানের চেম্বারে। তিনিও খুব সাহসের সাথে আমাদের চিকিৎসা করছিলেন। এটাই শিবচরের প্রথম যুদ্ধ, প্রথম বিজয়। পরে শুনলাম যুদ্ধে আহতোদের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার আবদুল মান্নান খান সাহেবকে হানাদাররা ওদের ক্যাম্পে তুলে নিয়া গেছিল। বুঝলাম জানোয়াররা এই যুদ্ধে থানা ছাড়ে নাই, পিছু হটছিল মাত্র। তাই বিজয়টা আনন্দের ছিল, মুক্তির না।’
‘তাহলে শত্রুমুক্ত হলো কবে? আব্বা।’
আব্বার চোখেমুখে ঝিলিক খেলে গেল। বললেন, ‘নভেম্বরের শেষে। মাদারীপুর জেলার ভাঙ্গা, সদরপুর থানার সব মুক্তিযোদ্ধা এক হয়া যুদ্ধ করলাম। এই শিবচর ছিল হানাদারদের, রাজাকারদের ঘাঁটি।অনেক বড় যুদ্ধ হইল। প্রায় দুইশো জন যোদ্ধা ছিলাম আমরা। এগারো-বারো বছরের একটা ছেলে ছিল আমাদের দলে। নামটা মনে করতে পারতেছি না। কি সাহস ছিল! শহীদ হইলো সে। আরো অনেকে শহীদ হইলো। তবে জানোয়াররাও মরছে অনেকগুলা- বিশ-বাইশ জন হবে। মাঝ রাত থিকা শুরু কইরা পরেরদিন সন্ধ্যা পযন্ত যুদ্ধ করলাম, প্রাণপণ যুদ্ধ করলাম, মুক্ত করলাম আমার মাটি, আমাদের মাটি।’
আম্মা রাতের খাবারের জন্য ডাকতেই আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। কিন্তু নিয়ন্তার তখনও ঘোর কাটে নি, ‘নানাভাই, শুনেছি আপনার ছোটভাই মানে আমার নতুন নানাভাইও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। তাঁর গল্প শোনান।’
আমি বলে উঠলাম, ‘আজকে আর না। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে।’
‘আজকে শুধু আর একটা প্রশ্ন করব মা। আপনি কত নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন, নানাভাই?’
‘তা কি আর মনে আছে! অত কি আর মনে থাকে! তখন তো আর এগুলা মাথায় নিয়া যুদ্ধ করি নাই। যুদ্ধ করছি দেশের জন্য, দেশের মাটির জন্য, বাবা মায়েরে জাপ্টায়া ধরা বুকে স্বস্তির নিঃশ্বাসের জন্য।’
আব্বার মনে নেই। কিন্তু স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পর এদেশ তাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননার খাতায় অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। তাঁর অবদানকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে লিপিবদ্ধ করে নিয়েছে তাঁর নাম ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ সিকদার।’
[আমার আব্বার মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধটা হুবহু এখানে তুলে ধরা হয়েছে]
লেখক: প্রভাষক, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা।
1 Comment
ফারজিনা মালেক স্নিগ্ধা
মনে হলো ফিরে গেলাম সেই সময়টাতে।