বাঙালির নববর্ষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব। প্রাচীন সভ্যতায় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম কেন্দ্রিক হলেও বাংলার ক্ষেত্রে হয়েছে সেটি একেবারেই ব্যতিক্রম। নদী ঘেরা খাদ্য বৈচিত্র্যের প্রাচীন বাংলায় কৃষিকাজকে ঘিরেই মূলত এই বর্ষপঞ্জির শুরু। সেই সময়ে আজকের মতো এমন জাকজমকপূর্ণ আয়োজনে বছরের প্রথম দিনটি পালিত না হলেও ঋতুকেন্দ্রিক ফসল উত্তোলনের পর ছোট ছোট উৎসব পালনের রীতি ছিল বাঙালি কৃষকদের মধ্যে।
বাংলা সনের উৎপত্তি নিয়ে কয়েকটি তত্ত্ব থাকলেও মোঘলদের আগমনের বহু আগেই যে বাংলা ফল-ফসলের প্রাচুর্যে সমৃদ্ধ ছিল তা আমরা কেউ হয়ত অস্বীকার করব না। আর ফসল ফলানোর তাগিদেই ঋতুর হিসেব ঠিক ঠিক করে রাখতে জানতেন গৌড় জনপদের মানুষ। ফলে মোঘলদের পূর্বে বাঙালি বাৎসরিক হিসেব রাখার কোনো পদ্ধতি ছিল না বলাটা অনেকটা হাস্যকর হবে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে সার্বভৌম বাঙালি নৃপতি শশাঙ্কের সময় থেকেই বাংলা ফসলী মাসের হিসেব রাখা শুরু হয়। মোগলদের ভারতবর্ষে প্রবেশের শতবছর আগে গৌড় অঞ্চলের কয়েকটি মন্দিরের শিলালিপিতে ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটির যে উল্লেখ পাওয়া যায় তা থেকে বাংলায় বাৎসরিক হিসেব রাখার পদ্ধতি যে মোঘলদের পূর্বেও প্রচলিত ছিল সেটিকে আরও নিশ্চিত করে।
মোঘল সম্রাটদের আগমনের পর তাদের রাজকার্যে ব্যবহৃত হিজরি পঞ্জিকার সঙ্গে মিলিয়ে বাংলায় কৃষি পণ্যের খাজনা আদায়ে জটিলতা শুরু হলে সম্রাট আকবর প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন এবং সেই থেকে বাংলায় নতুন করে একটি বর্ষপঞ্জির স‚চনা হয় যা এখন পর্যন্ত বাংলা সন হিসেবেই পরিচিত।
মূলত বছরের (চৈত্রের) শেষ দিনটিতে কৃষকরা তাদের বাৎসরিক খাজনা, দেনা-পাওনা পরিশোধ করে মুক্ত হতেন। নতুন বছরে নতুন করে কৃষি কাজের আনন্দ শুরু হতো। এ উপলক্ষ্যে বছরের প্রথম দিন থেকে বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে মাস ব্যাপী বিভিন্ন উৎসবের আযয়োজন করার প্রচলন শুরু হয়। আর তা শুধুমাত্র আনন্দকে উপজীব্য করেই নয় বরং সেখানে বাৎসরিক সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের লেনদেন হতো কৃষক থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কেনাবেচা হতো কৃষিজীবি মানুষের হরেক রকমের পণ্য। এই উৎসবটি ধীরে ধীরে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
শত বছরের ধারাবাহিকতায় নদী কেন্দ্রিক বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মানুষের লোকাচার, সংস্কৃতির সঙ্গে পহেলা বৈশাখ বা বৈশাখী বরণের উৎসব মিলে মিশে একেক অঞ্চলে একেকটা রূপ নিয়েছে। তাই পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গ, ভাগীরথী আর পদ্মা নদীর তীরবর্তী জনপদে পহেলা বৈশাখের নতুন-নতুন রূপ আর বৈচিত্র্য দেখা যায়। এবং আজও সেটি সমানভাবে ভিন্ন মাত্র পাচ্ছে। মাত্রা পাচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের খাদ্যাভ্যাস এবং অঞ্চল কেন্দ্রিক চাষ হওয়া বিভিন্ন ফসলকে ঘিরে। আঞ্চলিক সংস্কৃতির এই চলমান পারস্পরিকতা উৎসবকে যেমন নতুন মাত্রা প্রদান করে ঠিক তেমনই কখনো কখনো সেখান থেকে তার আদি উপাদান বা রেওয়াজ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
তার একটা জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো, সম্প্রতি ঢাকার রমনা-শাহবাগ- টিএসসিতে মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে, এর সঙ্গে আমাদের শত বছরের পুরনো বৈশাখী ঐতিহ্যের কোনো মিল নেই। তবে কবে কিভাবে এবং কেনই বা এমন প্রথা প্রচলিত হয়েছে সেটি নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। কারণ নববর্ষের প্রথম দিন বাঙালির মধ্যে আগের দিনের বাসি খাবার খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। এইদিনে নতুন পোষাকে গরম ভাতের সঙ্গে নদীর বড় মাছ খাওয়ার রেওয়াজই দেখা যায়- যা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এখনো বিদ্যমান।
ঢাকার চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন বটবৃক্ষের নিচে বৈশাখী মেলা হতে দেখা যায়। সোনারগাঁয়ের পেরাব গ্রামে ঘোড়া মেলা নামে একটি মেলার আয়োজন হয়। এক সাধক ঘোড়ায় চড়ে এইদিনে সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করতেন বলে তার সম্মানে সে অঞ্চলের মানুষ একটি করে মাটির ঘোড়া তাঁর সমাধি স্তম্ভে রেখে পালন করে বৈশাখী ঘোড়া মেলা। এছাড়াও সোনারগাঁয়ের জয়রামপুর গ্রামে আয়োজন হয় বউ মেলার। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন।
বাঙালি ছাড়াও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা জনজাতিরা এক সঙ্গে পহেলা বৈশাখ পালন করেন বৈসাবি নামে। বাংলাদেশ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় মহাসমারোহে পালিত হয় পহেলা বৈশাখ। পুরো চৈত্র মাস জুড়েই সেখানে চলে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। চৈত্র সংক্রান্তি বা মহাবিষ্ণু সংক্রান্তির এই দিন পালিত হয় চড়কপ‚জা বা শিবের উপাসনা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে আয়োজিত হয় চড়ক মেলা। মেলায় অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন শারিরীক কসরৎ প্রদর্শন করে মানুষের মনোরঞ্জন করে থাকে। কলকাতা শহরে সকালে প্রভাত ফেরী হয়। বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা ভোর থেকে মানত নিয়ে প‚জা দিতে যান এবং হালখাতা আরম্ভ করেন।
আমাদের কুমিল্লা শহরে চৈত্রের শেষ দিনটিতে দেখেছি বাড়িতে হরেকরকম সবজি দিয়ে রান্না হতো পাঁচন, করলা ভাজি, সজনে ডাল, আমডালসহ আমিষ বর্জিত খাবার খাওয়া নিয়ম ছিল সেদিন। আগের দিন বিকেলে পাঁচনে দেওয়ার জন্য বিষকাটালির আগাসহ অন্যান্য ভেষজ লতাপাতা সংগ্রহের জন্য আমরা ছোট শিশুরা দলবেঁধে বনে বাদারে ঘুরে বেড়াতাম। আরও সংগ্রহ করতাম নিম পাতা আর কাঁচা হলুদ।
বৈশাখী মেলার আকর্ষণেই পহেলা বৈশাখের দিনটি এক অন্যরকম আনন্দে কাটত। সারাদিন টমটম গাড়ি আর দুই পাখাওলা ঠেলা গাড়ি চালাতাম। সকালে মা কাঁচা হলুদ আর নিমপাতা বাটা দিয়ে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে দিতেন। বাড়ির বুড়োকর্তা আমাদের বড়বাবা (দিদিমার বাবা) বাজারে গিয়ে বড় কাতল মাছ, চিতল মাছ, রুই মাছ কিনে আনতেন। আমরা ছোটরা সকাল সকাল বড়মাকে দেখতাম স্নান শেষে নতুন কাপড় পড়ে বাড়ির উঠানের আনাচে কানাচে খই ছিঁটাতেন। খই ছিঁটালে নাকি গৃহস্থের ঘরে সে বছর খুব আয় হয়। ফল-ফসলে গৃহস্থের বাড়ি পূর্ণ থাকে। খই ছাড়াও নোয়াখালি, চাঁদপুর সহ বাংলাদেশের কয়েকটি অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তিতে ‘ছাতু উড়ানি’ উৎসব হয়। সংক্রান্তির দিনে সকালে স্নান করে প্রত্যেক পুরুষ দু’মুঠো ছাতু নিয়ে রাস্তার তেমাথায় গিয়ে উপুর হয়ে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে ছাতু ছুড়ে দিতে দিতে বলে ‘ছাতু যায় উইড়া, দুষমন বাদী মরে পুইড়া’। কোথাও বলা হয়, ‘শত্রু উড়াইলাম, শত্রু উড়াইলাম’, কোথাও বলা হয় ‘শত্রুর মুখে ছাই, মিত্রের মুখে ছাতু’।
সেই সময়ে আমাদের লোকজ রেওয়াজের অনেক কিছু বোধগম্য না হলেও এখন ভাবলে চমকে উঠি। সর্বপ্রাণবাদী বাঙালি নতুন বছরের সূচনা করতেন পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার্থে অন্য প্রাণীদের টিকে থাকার লড়াইকে সম্মান জানিয়ে, সহযোগীতা করে। নতুন বছরে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় পাখিদের জন্য ছিঁটানো হতো খই, ছাতু। পশ্চিমবঙ্গের বীরভ‚মের কোথাও কোথাও নাকি একসময় পহেলা বৈশাখে বীজমেলা হতো। এই দিনে সবাই বীজ আদান প্রদান করতেন। আর বৈশাখের শুরু থেকে সারা বছর কখন কি চাষ করবেন সেটির পরিকল্পনা শুরু হতো প্রতিটি নববর্ষে।
নববর্ষের দুপুরে মেলায় যাওয়ার আগে দুপরে থালাভর্তি গরম ভাতের সঙ্গে থাকত মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট, পাঁচফোড়ন দিয়ে আলু-মাছের ঝোল, মাছের তেল দিয়ে চচ্চরি, মাছের ভর্তা, মাছের দোপেঁয়াজো, মাছ ভাজা। ছোটবেলায় দিদিমার মুখে শুনেছি, পুরো চৈত্রমাস নাকি তার বাবা-কাকা নদীতে মাছ ধরতেন না। কারণ চৈত্র মাস জুড়ে নদীতে মাছ ডিম দিতে থাকে। এ বিষয়ে অনেকেই একমত হতে পারেন, নদী কেন্দ্রিক জীবিকাধারণ ও জীবন ধারণ করা বাঙালি একসময় পুরো চৈত্রমাস জুড়েই নদীর মাছ না খেয়ে শাক-সবজি দিয়েই নিত্য দিনের আহার কার্য চালাতেন। আর ডিম দেওয়া শেষ হলে বৈশাখ মাস থেকে উৎসব করে প্রতিদিন মাছ ধরা চলত।
পৃথিবীর অনেক প্রাচীন সভ্যতা বিলীন হয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজ করলে দেখা যাবে প্রকৃতির অনুষঙ্গে নিজেদের টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মানুষ তার সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে পারে নি অথবা তাদের সামর্থ ছিল না। অন্যদিকে এই সময়ে আমাদের উদ্ভাবন কৌশল, যন্ত্রপ্রযুক্তি মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে যে অত্যাধুনিক ভাষা এবং যোগাযোগ নিত্য নতুন তৈরি করে দিচ্ছে সেটি প্রকৃতি এবং মানুষ ব্যতিত অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রাণ রক্ষার অনুষঙ্গে কাজে না লাগালে আমাদের মধ্যে থেকে একসময়ে হারিয়ে যাবে লোকজ কিংবা আঞ্চলিক সংস্কৃতির গুরুত্ব ও মানে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে আমাদের শিকড় বর্জিত হয়ে। তাই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে পহেলা বৈশাখের যে ঐতিহ্য শত বছর ধরে চলমান এবং আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই সনের আদি এবং আসল মানে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যেন হারিয়ে না যায় সেই চেষ্টা এবং উদযাপনের রীতি যেন আমরা পালন করতে সক্ষম হই।
তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট; বাংলার প্রাথমিক কৃষি / যোগেন্দ্রনাথ মৈত্র; মাছ আর বাঙালি / রাধাপ্রসাদ গুপ্ত; বাঙালির খাদ্যকোষ / মিলন দত্ত
লেখক: লেখক ও অনুবাদক