মুবিন খান
ভদ্রলোক একটা গালি দিলেন। খুব নোংরা গালি। গালি খেয়ে রাগ হওয়ার কথা। আমার রাগ হলো না। খুব অবাক লাগল। এই অবাক হওয়াকে বলে আকাশ থেকে পড়া। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অচেনা অজানা কেউ কেন শুধু শুধু গালাগাল করবে!
আমি বললাম, ‘ভাই গালি দিলেন!’
‘হ্যাঁ দিলাম। তুইও দে।’
তুই তোকারিও করছেন! নিতান্ত অপরিচিত লোকজনকে কোনো লিটলম্যাগ সাহিত্য করা লোক যে এভাবে তুই সম্বোধনে গালাগাল করতে পারেন আমার ধারণা ছিল না।
আমার অবাক হওয়ার মাত্রা বাড়ল। ধাক্কার মতো খেলাম। সেটা সামলে নিয়ে বললাম, ‘দিব না। নোংরামি করতে পারা অবশ্য যোগ্যতা বটে।’
‘হ, তুইও কর।’ ভদ্রলোক তার ভদ্রতা বজায় রাখলেন।
আমি বলি, ‘ধন্যবাদ দিব। আপনার মতো একটা লোক আমার বন্ধুতালিকায় সেটা জানানোর জন্য ধন্যবাদ দিব। ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন।’ বলে বিদায় নিলাম।
আমি যখন আমার ফোনের কিবোর্ডে টাইপ করে লিখি তখন কিবোর্ডে টুকটুক করে শব্দ হয়। শব্দটা আমার ভালো লাগে। কমিপউটারের কিবোর্ডে লিখলেও শব্দ হয়। তবে সেটা কিবোর্ড আক্ষরিক চাপাচাপিরই শব্দ। ফোনের কিবোর্ডের শব্দটা সেরকম নয়। এই শব্দটাকে ডিজিটালি কিবোর্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
কলম দিয়ে কাগজে লিখলেও একটা শব্দ পাওয়া যায়। সেটাকে খসখস শব্দ বলে। খসখস শব্দটা আমার বেশি ভালো লাগে। খসখস শব্দটা রাতে বেশি পাওয়া যায়, শুনতে সুবিধা। আমার ধারণা লেখালেখি করা লোকেরা এই খসখস শব্দ শুনতে পেতেই রাতে লেখালেখি করেন। আমার এখন আর খসখস শব্দ শুনতে পাওয়ার সুবিধা নাই। কাগজ কলম নিয়ে বসার অবসর নাই।
ফলে খসখস শব্দ শোনা হয় না। মাঝে মাঝে টুকটুক শব্দ শুনি। রাত গভীর হলে শব্দ অন্যর বিরক্তির উদ্রেক করবে ভেবে লেখার সময় হেডফোন লাগিয়ে নিই। ফোন সাইলেন্ট করি না। বর্ণর পর বর্ণ এসে সাদা স্ক্রিন ভরে উঠতে থাকে। আর আমার কানে বাজতে থাকে টুকটুক টুকটুক টুকটুক। আমি তন্ময় হয়ে শুনতে থাকি। বড় মধুময় পরিবেশ। কিন্তু এই মধুময়তায়ও হঠাৎ হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে।
সেদিন আরেক ভদ্রলোক এসে ইংরেজিতে জানালেন তিনি আমার লেখা পড়েছেন। আমার খুব ভালো লাগল। ভদ্রলোক পড়ার তথ্য জানিয়ে ইংরেজিতেই আমার লেখার পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া জানালেন।
বাংলায় লেখা রচনার প্রতিক্রিয়া ইংরেজিতে কেন বলতে হলো এটা আমার বোধগম্য হলো না। আমি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তার বঙ্গার্থ সাধ্যমত উদ্ধার করবার চেষ্টা করলাম। উদ্ধার করার পর ভদ্রলোকের বক্তব্যকে বাণী বাণী লাগছিল। বঙ্গার্থ অবশ্য উত্সাহব্যঞ্জক। ভদ্রলোক বলেছেন, ‘চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রবন্ধ লেখা ভালো। কিন্তু আমাদের সন্তানদের নীতিশাস্ত্র ও নৈতিকতা সম্বন্ধে শিক্ষা করা উত্তম।’
এই বলাবলিতে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিও রয়েছে। ভদ্রলোক কী আমাকে চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা নিয়ে না লিখে আপন সন্তানদের ‘চরিত্র, নীতিশাস্ত্র এবং নৈতিকতা’ শিক্ষা করার পরামর্শ দিচ্ছেন? তা দিন। উত্তম পরামর্শ বটে।
কিন্তু ওই যে ‘কিন্তু সন্তানদের শিক্ষা করা উত্তম’ কথাটা? কি বোঝালেন ওটা দিয়ে? লেখালেখি বন্ধ করে সন্তানের শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে? পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা কেন! লিখতে নিষেধ করছেন কি! কেন করছেন? লিখলে সমস্যা কি! চরিত্র তো চর্চার বিষয়। নিয়ম হলো আমরা নিজেদের জীবনে চর্চা করব এবং আমাদের সন্তানেরা সেই চর্চা দেখতে দেখতে বড় হবে। সেই দেখাদেখির মধ্যে সন্তানদের নিজের শিক্ষা এবং চর্চা, দুইই হয়ে যাবে। তাহলে লিখতে নিষেধ করছেন কেন!
এই যে চর্চার বিষয়টা, এটা কিন্তু আমাদের ছেলেবেলাতেই শেখানো করা হয়। পাঠ্য বইয়ে কবি গোলাম মোস্তফার ‘কিশোর’ কবিতার লাইন ‘শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সব শিশুরই অন্তরে’ দিয়ে বলা হয় ভাব সম্প্রসারণ কর। ছেলেমেয়েরা সেই কবিতার লাইনটার ভাব বুঝে নিয়ে সম্প্রসারণ করে। লেখে, পিতা যেমন, যে আদর্শে পিতা নিজেকে পরিচালন করেন, শিশু নিজেও সেই আদর্শ নিজের ভেতর ধারণ করে বাড়তে থাকে। বেড়ে বড় হয়ে সেও নিজেকে সেই আদর্শেই নিজেকে পরিচালন করে। তখন আমরা বলি, ‘যোগ্য পিতার যোগ্য পুত্র।’ যোগ্য মাতার পুত্র কিন্তু বলি না। যোগ্য মাতাপিতারও বলি না। শুধুই যোগ্য পিতার বলি। কেন বলি?
‘তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ নেপোলিয়ন বোনাপার্টের উচ্চারিত এই প্রবাদ আমরা সকলেই জানি। দমে দমে উচ্চারণও করি। তাহলে সন্তানের সফলতার সবটাই কেন অবলীলায় পিতাকে দিয়ে দেই? এটাও ওই চর্চারই কারণে। চর্চাগুলোই ধীরে ধীরে মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়। এই অভ্যাস ভালো কাজ মন্দ কাজ দুইয়েরই হয়। ভালো কাজের চর্চা করেন যারা তারা তখন মন্দ কাজ করতে পারেন না। আর মন্দ কাজ করাঅলারা চরিত্র থেকে অপরাধবোধ হারিয়ে ফেলেন। অজান্তেই। মজা না?
এক ভদ্রমহিলা সেদিন কাউকে যাবজ্জীবন আয়না দেখবার শাস্তি দিচ্ছিলেন। সম্ভবত তিনি ভাবছিলেন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি ভদ্রমহিলার সঙ্গে যে অন্যায় করেছেন সেটা তিনি যতবার আয়না দেখবেন ততবারই অপরাধীর নিজের অপরাধের কথা মনে পড়বে এবং সে অপরাধবোধ অনুভব করবে। কষ্ট পাবে। এই কষ্ট পাওয়ার শাস্তিটি অপরাধী যেন সারাজীবনই পায় ভদ্রমহিলা হয়ত সেটিই নিশ্চিত করতে চাইছিলেন। আয়না আসলে সবাই দেখে না। অতিরিক্ত আয়না দেখা একধরনের মানসিক সমস্যা। আত্মমুগ্ধ মানুষ অতিরিক্ত আয়না দেখে। এখন কথা হচ্ছে, আপনি যার প্রতিই মুগ্ধ হবেন তার সকলই আপনার ভালো লাগবে। এই যুক্তি নিজের বেলাতেও প্রয়োজ্য। নিজেকে নিয়ে মুগ্ধ মানুষ কেবল নিজের গুণটাই দেখে। নিজেকে ধীরে ধীরে সমালোচনার উর্দ্ধে ভাবতে থাকে। তো তাকে আয়না দেখার শাস্তি দিলে সেটি সত্যিই শাস্তি হলো কিনা ভেবে দেখা দরকার। আয়না দেখা লোকেরা আপন মুগ্ধতায়ই আয়না দেখবেন। যাবজ্জীবন দণ্ড তখন তার কাছে শাপে বর হয়ে ওঠার কথা। তাহলে দেখা যাচ্ছে যাবজ্জীবন দণ্ড যিনি দিলেন সেটি শুধুই দণ্ডদাতার আত্মতুষ্টি। সত্যিই তাই? অক্ষম বাসনার জ্বালা মোছা নয়?
তাহলে যিনি নোংরা গালাগাল করলেন কিংবা যিনি লেখালেখি বন্ধ করে সন্তানদের শিক্ষা প্রদানের পরামর্শ দিলেন, তারাও কি জ্বালা মুছলেন? রহস্যময় প্রশ্নবোধক। আরও বড় রহস্য হলো, কি তাদের অক্ষম বাসনা? আমাকে গালাগালে তাদের জ্বালা কি মুছল? নাকি চাগিয়ে উঠল? জানার উপায় নাই। দরকারও নাই।
বাংলা ভাষায় পরমতসহিষ্ণুতা বলে একটা শব্দ আছে। অভিধানে এর অর্থ দেওয়া আছে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা। ইংরেজি প্রতিশব্দ টলারেন্স যেন ঠিক সেভাবে বলতে পারে না যেভাবে ‘পরমতসহিষ্ণুতা’ শব্দটা বলছে।
পরমতসহিষ্ণুতাকে গণতন্ত্রের একটি প্রধানতম নিয়ামক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশ করতে দেয়ার জন্য আমি আমার জীবন দিতে পারি’। তো পরমতসহিষ্ণুতা শব্দকে আমরা স্কুল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত উপর্যপুরি ব্যবহার করছি। শিখছি। শেখাচ্ছি। ‘জাতীয় শব্দ’ বানিয়ে ফেলেছি। কিন্তু চর্চাটা কই? চর্চাটা করছি না। কেউ যখন আমার মতামতের বিরুদ্ধাচারণ করছে, তার মতামতকে যুক্তি দিয়ে খ–ন করছি না। তার বক্তব্য যে অন্তঃসারশূন্য সেটা প্রমাণ করতে নিজের কথাগুলো বলছি না। তার দিকে তেড়ে যাচ্ছি, তাকে গালাগাল করছি অথবা তাকে নিশ্চুপ করিয়ে দিতে উদ্যত হচ্ছি।
নাহ্, হচ্ছে না। কথাবার্তা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। গাম্ভীর্যতা ভালো লাগে না। তারচেয়ে একটা ঘটনা বলি।
ছেলেবেলায় আমাদের পাড়ায় পাড়ায় দেখেছি যারা রাগী যুবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের আড়ালে আবডালে গুন্ডাপান্ডা বললেও সম্মুখে সবাই খুব ভয় ও সমীহ করে। আমরা দেখেছি এসব রাগী রাগী যুবকেরা লেখাপড়ার বিষয়ে উদাসীন হয়। কিন্তু পরীক্ষায় ঠিকই উতরে যায়। তারা কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হয়েও গাড়ি ঘোড়াতেই চড়ে। পাড়ার চায়ের দোকানে পরিষ্কার কাপ-গ্লাসে চা-পানি আসে। লন্ড্রিতে দ্রুত কাপড় ইস্ত্রি করে দেয়। অথচ আমরা বিকেলে হোটেলে ডালপুরি খেতে বসে চাইলেও মাংস তরকারির ঝোল পাওয়া যায় না। তেল চিটচিটে কাপে-গ্লাসে চা-পানি খেতে দেয়। লন্ড্রিও কোনোদিন সঙ্গে সঙ্গে কাপড় ইস্ত্রি করে দেয় নাই। এসব বৈষম্য আমাদের নাড়া দিত।
তারপর কিশোর হতে হতে রাগী হয়ে উঠতে চাওয়াটা আমাদের অনেকের আদর্শ হয়ে উঠতে লাগল। আমাদের সঙ্গেরই কেউ কেউ রাগী হতে শুরুও করল। ধীরে ধীরে সেই রাগ প্রকাশ করতেও শুরু করল। অতঃপর তারা সঙ্গে থাকার ফলে, তাদের বন্ধু হওয়ার ফলে আমরাও পরিষ্কার কাপ-গ্লাসে চা খাই, পানি খাই, না চাইতে মাংসর ঝোলে চুবিয়ে ডালপুরি খাই। আর তাদের ক্ষমতায় মুগ্ধ হই। তারপর আমাদেরই কেউ কেউ লেখাপড়ার প্রতিও উদাসীন হয়। এদেরও দেখি পরীক্ষায় উতরে যেতে সমস্যা হয় না।
এই যে উদাসীনতার ধারা, এই ধারা কিন্তু প্রবহমান। তিন তিনটা প্রজন্ম ধরে প্রবহমান। এই উদাসীনতা কি এখন রাষ্ট্রর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে? অবকাঠামোয় ঢুকে গেছে?
‘নিজের কাজ সর্বোত্তমভাবে করে যাওয়াই সর্বোচ্চ দেশপ্রেম’ -সক্রেটিসের বাণী।
পুলিশ যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে এরা যতই রাগী হোক, রাগ দেখাত না। উকিল যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে অপরাধীরা শাস্তি পেত। শিক্ষক যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তবে লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনেরা পরীক্ষায় উতরে যেতে পারত না। রাজনীতিকরা যদি নিজের কাজটা সঠিকভাবে করত তাহলে যোগ্যতাহীনরা দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেত না এইভাবে বলতে থাকলে ফুরাবে না। বলতে থাকাই লাগবে।
তো সক্রেটিসের এই বাণী বগলদাবা করে এগুলে দেখি, হায় হায়! কেউই দেশকে ভালো তো বাসছেই না উল্টো গণতন্ত্রর প্রধান নিয়ামককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাষ্ট্রর সাধারণ নাগরিকের দিকে নখদন্ত বের করে খিঁচিয়ে তেড়ে আসছে।
সাধারণ নাগরিকের দায়িত্ব কি এখন? ভয় পাওয়া? সে নিষ্ঠার সঙ্গেই নিজেরই দায়িত্বটি পালন করছে। আর রাত জেগে জেগে কিবোর্ডের মিষ্টি মধুর টুকটুকটুক শব্দ শুনতে শুনতে সাদা স্ক্রিন ভরিয়ে ফেলছে। এই তার দৌড়। এই দৌড়টুকু দৌড়াতে তার বড় ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটুকু ছাড়া তার তো আর নেই কিছু।
সত্যিই নেই কিছু?
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।