কালের সাক্ষী হয়ে রইলাম। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন দেখেছি। কালের সাক্ষীই বটে। দেখে ফেললাম ২৫ জুন, ২০২২ তারিখে, দেখেছি পদ্মায় ছায়া ফেলে দেয়া বিশ্বের এক অপূর্ব যোগাযোগ স্থাপনার সৌন্দর্যের জনপ্রকাশ। ছোট্ট এক জীবনে প্রমত্তা পদ্মার কত শত রূপ যে দেখেছি। শান্ত নীরব পদ্মা থেকে শুরু করে উত্তাল পদ্মার সাথে আমার শিশুকালের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক এখন ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরে গেল। নদী পারাপারের বাতাস মেশানো জল হয়ত আর গায়ে লাগবে না, খরস্রোতা পদ্মার পাকে পড়ে জীবন অনিশ্চয়তায় আর হয়ত দোল খাবে না। হয়ত এরপর থেকে যতবারই পদ্মা পাড়ি দেব, স্মৃতির ঝুড়ি থেকে কিছু বের করতে করতেই ওপারে পৌঁছে যাব। কেননা এখন থেকে পদ্মা পেরুতে সময় লাগবে মাত্র সাত মিনিট।
অথচ এক সময় আগের দিন সন্ধ্যায় যাত্রা শুরু করে বাড়ির ঘাটে গিয়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে পরদিন সকাল দশটা বেজে গেছে। ছয়-সাত বছর বয়সের টুকরো কিছু স্মৃতি আমার বেশ মনে আছে। সদরঘাট থেকে লঞ্চে চড়তাম। সেকি প্রস্তুতি আমাদের! দুটা কম্বলে দুটা বালিশ মোড়ানো। চামড়ার লাগেজ আর একটা ব্যাগে পরিবারের সবার কাপড় চোপড়। তার সঙ্গে রাতের খাবার। লঞ্চের এক কামড়ায় আমরা তিন বোন আর আব্বা আম্মা। তো একবার হলো কি আমাদের লঞ্চে ওঠার পরপরই পাশের কামড়ায় এক নতুন দম্পতি এল। নতুন বউ, স্বাভাবিকভাবেই সে কি বিস্ময় আমার! অগোচরে জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বউটাকে দেখার কি আপ্রাণ চেষ্টা। বরটা খাবার আনতে নীচে যাবে। নতুন বউটাকে একা ফেলে যাবে কি করে? আম্মার সাথে পরিচিত হয়ে আমাদের কামড়ায় রেখে গেল। আমার সে কি আনন্দ! বউ দেখি আর বড় বোনের সাথে কথা কাটাকাটি করি। ছোট বোনটা তখন শিশু, কোলে কোলেই তার বসবাস। বেশ কাটছিল সময়। রাতের খাবার রুটি-হালুয়া। খাওয়ার পর ঘুমনোর সময় হলে ওপর নীচ করে ঘুমালাম আমরা।
সকালে ঘুম ভাঙল এলোমেলো হইচই কথাবার্তায়। কানে আসছিল হাঁ হুতাশ। আসলে হয়েছিল কি আগের রাতে সন্ধ্যায় লঞ্চ ছাড়ার পর ওটা আর এক কিলোমিটারের বেশি এগোয় নি। এগুবে কি করে! ঘন কুয়াশায় লঞ্চের কাপ্তেন তার সামনের বিশ হাতের বাইরে কিছুই দেখতে পান নি। লঞ্চ যে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেটাও তিনি বুঝে উঠতে পারেন নি। এখন যাত্রীদের হাঁ হুতাশের কারণ হলো, যদি অন্য কোনও লঞ্চের সাথে বাড়ি খেতো তাহলে আমাদের লঞ্চটার কি হতো! যদি ফেরির সাথে ধাক্কা লাগত? তাহলে? যদি এটার নীচে কোনও নৌকা ঢুকে যেত তাহলে ওই যাত্রীদের কি হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। তো এসব কিছুই হয় নি। কাপ্তেন যাত্রীদের মনে মোটামুটি একটা দুর্বল জায়গা তৈরি করে আবার যাত্রা শুরু করল। এই করে আমাদের যাত্রা পথটা আরও পুরো একটি দিন বেড়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে সেই নতুন বউটির সাথে আমাদের অনেক খাতির জমে গেছে। প্রতিবেশী বাড়ির মতো খাবার দেয়া নেয়া চলছে। অদ্ভুত লাগছিল যকজন লঞ্চ থেকে নামার আগে আম্মা যখন বউটাকে নিজ হাতে চুলের খোঁপা করে দিচ্ছিলেন। সাধারণ খোঁপা না, ওটার নাম আমি তখনই জেনেছিলাম, রিং খোঁপা। আম্মার কড়া নিষেধাজ্ঞায় বউ আন্টির সাজগোজ ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু তিনি নিজ হাতে একটা একটা দিচ্ছিলেন দেখার জন্য। ওই প্রথম চারতলা মেকাপ বক্স দেখে কি বিষ্ময় আমার! এখন ভাবি আমরা এজন্যই বাঙালি, এক আত্মায় বাঁধা। নয়ত এত অল্প পরিচয়ে এখনও মনে কি করে উঁকি দিয়ে যাচ্ছেন বউ আন্টিটা! ছোট্ট শিশুর প্রতি তার সেই মমত্ববোধ চল্লিশের কোঠায় দাঁড়িয়েও এই আমাকে এখনও ঠিক নাড়া দিয়ে যায়। বউ সাজানো শেষ। ব্যাগ বিছানাও গোছানো হয়ে গেছে। বিদায় নিলাম আমরা। বিল পদ্মার শেখপুর ঘাটে যখন পৌঁছলাম তখন চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের বউ আর নাতনীদের অভ্যর্থনায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভিড় ছিল । আমাদের বাড়ি পৌঁছুতে একদিন হওয়ার কারণে ভিড়টা ভারী হয়েছিল।
বাড়ি মানে জন্মস্থান। দাদাবাড়ি। প্রতি ঈদ তো বটেই আব্বা ছুটি নিয়েও কখনও কখনও বাড়ি যেতেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে। কি যে উচ্ছ্বাস থাকত আমাদের বাড়ি যাওয়া নিয়ে! উঠান ভর্তি ভাই বোনেরা। কত ধরনের খেলা, কত গল্প, মাটির চুলার পাশে দাদুর বানানো পিঠা খাওয়া, দাদুর হাতে বানানো ছোট মাটির চুলায় বনভোজন, শীতকালে চাচাত বোন মুক্তা আপুর খেজুর গাছে উঠে রস পাড়া, বিধবা নিঃসঙ্গ ছোট দাদুর খোঁয়াড় থেকে মুরগী চুরি, আরও কত কি! এতসব উচ্ছ্বাসের টান নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিতে যখন লঞ্চে উঠতাম তখন মনে হতো কখন নামব, কখন বাড়ি যাব।
একবার হলো কি ঢাকা থেকে দাদা, দাদু আর আমার তিন মাসের বড় চাচাত ভাই নোমানসহ আমরা পরিবারের সবাই একসাথে বাড়ি যাচ্ছিলাম। আমার বয়সটা তখন ওরকমই, সাত আট হবে। আমি আর নোমান পিঠাপিঠি বয়সী হওয়ায় অকাজে খুব মানিকজোড় ছিলাম আমরা। লঞ্চটা আমাদের ঘাটে আসার আগে দাদুকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কখন নামব। আমাদের ঠিক আগের ঘাটে লোকজন যখন নামবে, দাদুকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ও-ই তো আইসা পড়ছি। আমরা দু’জন মনে করেছি আমাদের ঘাট। লোকজনের সাথে দুজনেই দিব্যি নেমে পড়লাম। যাত্রী আর মালামাল নামানো শেষ হলে লঞ্চ ছেড়ে দিল। আমরা দুজন চেয়ে চেয়ে দেখলাম পরিবারের কেউই নামে নি আমরা দু’জন ছাড়া। লঞ্চ যত দূরে যেতে থাকল আমাদের কান্নার সুর ততই জোরে বাজতে থাকল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম লঞ্চটা আমাদের নিতে ফেরত এল। ওদের লোকজন আমাদের দু’জনকে হাত ধরে ওঠাল। উঠবার পর জানা গেল প্রথমে দাদু আমাদের অস্পষ্ট চোখে দেখে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমরা কিনা। তখনই আমাদের খোঁজ পড়েছিল। সারা লঞ্চ খুঁজে যখন দু’জনকে পাওয়া যায় নি তখন তারা নিশ্চিত হয়েছিলেন ওই শিশু দুটা আমরাই। উঠতেই দু’জনের কানের দখল দুই অভিভাবক নিজ দায়িত্বে হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কই হারানো ছেলেমেয়ে ফিরে পেয়ে আদর যত্ন করবেন তা না, মুখ আর হাত দুটাই আমাদের ওপর চলতে থাকল। দু’জনকে দূরে বসানো হলো। আমরাও সাইজ টাইজ হয়ে নামা পর্যন্ত ওপ্্ করে থাকলাম। তারপর আবার শুরু কিছু না কিছু।
কিন্তু যে স্মৃতিটা কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এবারে সেটা বলি, এটা আমার দশ এগার বছর বয়সের কথা। তখন আমরা পুরো পদ্মা লঞ্চে পার হই না। বাড়ির ঘাট থেকে লঞ্চ অথবা ফেরিতে মাওয়া ঘাটে নামি। তারপর লোকাল বাসে ঢাকা। আব্বা আমাদের তিন বোনকে বাসের সিটে বসিয়ে রেখে আম্মাকে কিছু খাওয়াতে নামলেন। কিছুক্ষণ পর বাস ছেড়ে দিল। আমরা ছোট দু’জন কান্না। আর বড় বোনটা লোকজনকে বলছে আব্বা আম্মা নীচে। আব্বা স্টপেজের পাশের দোকানেই ছিলেন। বাসটার গতি কম ছিল তবুও থামাচ্ছিল না। আব্বা আম্মা দুজনেই দৌড়াচ্ছেন। লোকজনের চেঁচামেচিতে বাস এক সময় থামল। আব্বা আম্মা উঠলেন। আম্মা তখন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ও বয়সে তো আমি জানি না মায়েদের এই কষ্টটা কেমন হয়। শুধু এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে আমার মাটা ওরকম ভারী শরীর নিয়ে কি কষ্ট করে দৌড়ে দৌড়ে আসলেন। আর বাসে উঠেই ভীষণ বমি করেছিলেন।
এই তো সেদিনের কথা। সরকারি চাকরির জীবনটাও শুরু হয়েছিল পদ্মার ওপারে। খরস্রোতা পদ্মা পাক দিয়ে আস্ত এটা লঞ্চ খেয়ে ফেলল। তার পরদিন অফিসে যাওয়ার জন্য বাসে করে মাওয়া ঘাটে নামলাম। ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে জীবনটা বাজি রেখে ফেরিতে সেই রাক্ষুসে পদ্মা পাড়ি দিয়েই অফিসে গিয়েছিলাম। নদী পার হওয়ার পর নিজেকে অতিমানব মনে হয়েছিল।
হয়ত হারিয়ে গিয়েছে কারো বুকের ধন, হয়ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কোনও মায়ের সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায় নি, হয়ত অসংখ্য রোগী ঘন্টার পর ঘন্টা অ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটালে যাওয়ার অপেক্ষায় মৃত্যুকেও বরণ করতে হয়েছে এই পদ্মার ওপরেই। পদ্মা নদীর ওপরে এখন সেতু হয়েছে। পদ্মা সেতু। আমার মায়ের মতো অমন করে আর কোনও অন্তঃসত্ত্বা মাকে আর বাসের পেছন পেছন ছুটতে হবে না। হারাতে বসতে হবে না চঞ্চল কোনও শিশুকে। অমানব হয়ে মানবিকতার আলো ছড়াতে যেতে হবে না কাউকে। যানজটমুক্ত পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ুক শতবর্ষে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, ঢাকা।