উন্নয়নে নারী বা নারী উন্নয়ন অভিধানে একটি অতি আধুনিক সংযোজন। এটি এমন একটি ধারণা যা বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা অবদানকে স্বীকার করে। অপরদিকে উন্নয়নে নারী ধারণাটি বলতে এও বোঝায় যে নারীরা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এবং উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের পরিবেশ অনুকূল করা অত্যাবশ্যক। নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দুটো বিষয়ই একে অন্যের পরিপূরক। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও নারী উন্নয়ন বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।
নারীর ক্ষমতায়ন বলতে যদি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যক্তি অধিকার এবং সামাজিক সর্বজনীনতা সংরক্ষণ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে ক্ষমতা সেটাকে বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন শাখায় নারীদের সম্মানজনক উপস্থিতি নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। কিন্তু তারপরও গত তিন দশকে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার নারী সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও নারী সমাজের এই অগ্রগতি কোনো অবস্থাতেই একই সময়ে পুরুষ সমাজ দ্বারা অর্জিত অগ্রগতির সমকক্ষ নয়। আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারী সমাজের অবস্থা তো এখনও রীতিমত আশংকাজনক। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্রসীমার নীচে রয়ে গেছে প্রায় ৬০ কোটি নারী। অপরদিকে ইতালি, নরওয়ে, ফ্রাঞ্চ বা সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলোতেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ নারী দারিদ্রসীমার নীচে বাস করে। বলাবাহুল্য এই হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বের অশিক্ষিত জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশই নারী এবং বিশ্বে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী।
নারী উন্নয়নে এত প্রতিকূল অবস্থা বিরাজমান থাকলেও আশার কথা হলো বর্তমান বিশ্বে প্রাচ্য, পাশ্চাত্য, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে নারীদের সরব উপস্থিতি। পৃথিবীর সবদেশেই আজ নারী বিপ্লব ঘটছে, ঘটছে নারী জাগরণ। বিজয় হচ্ছে নারীদের। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল পুরুষের সঙ্গে নারীও এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম। সেই ধারা অব্যাহত রেখে সবকিছুর পাশাপাশি প্রথমবারের মতো একজন মুসলমান নারী আইন প্রণেতা নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের আইনসভায়, চার তারকা বিশিষ্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান যুক্তরাষ্ট্রর এক নারী। ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রায় ১৬৫ বছরের ইতিহাসে প্রথম নারী নির্বাহী সম্পাদক পদে নিযুক্ত ছিলেন একজন নারী।
অতি সম্প্রতি ৩১ জানুয়ারি ২০২৩এ নিয়োগপ্রাপ্ত গিনির প্রধানমন্ত্রীর মতো বিভিন্ন দেশের নারী প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়া, লাটভিয়া, নেপাল ও হাঙ্গেরিতে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন নারী রাষ্ট্রপতি। নেপালে নারী প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হন নারী স্পিকার ও সেই সাথে নারী প্রধান বিচারপতি। জম্মু ও কাশ্মিরের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন একজন নারী। এভাবে প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাবিক, বৈমানিক, নভোচারী, গবেষক, পর্বতারোহী, সফল উপস্থাপক, পরমাণু বিজ্ঞানী, সাহিত্যাঙ্গন, ক্রীড়াঙ্গন এমন কি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে নারীদের অবাধ পদচারণা।
আরব বিশ্বও এখন আর নারীর ক্ষমতায়নে পিছিয়ে নেই। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল ন্যাশনাল কাউন্সিলের (এফএনসি) নির্বাচিত প্রথম নারী ডেপুটি স্পিকার, সফটওয়্যার ডিজাইনে ওমান ও কাতারের নারী দল, সৌদি আরবে ব্যাংকের শীর্ষ পদে প্রথম নারী, আফগানিস্তানে প্রথম নারী বৈমানিক, আমিরাতের প্রথম নারী ব্যান্ডদল এটাই প্রমাণ করে যে আরব বিশ্ব তথা বিশ্বের কোথাও নারী আজ আর ঘেরাটোপে অবগুন্ঠিত নয়। বিশ্বের সকল দেশের নারী উন্নয়নের চিত্র এখন প্রায় সমান। তাছাড়া ২০১৫ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দেশটির নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও ১৯ নারীর জয়লাভ এবং ইরানের দশম পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রথমবারের মতো নারীদের অংশগ্রহণ ও জয়লাভ আরব বিশ্বে নারী ক্ষমতায়নকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে নারীদের পদযাত্রায় বারবার হোঁচট খেতে হয় সেখানে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশের নারী হিসেবে বাঙালী নারীদের প্রতি পদক্ষেপে আরও বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। অশিক্ষা, কুসংস্কার ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, ইত্যাদিকে আমাদের দেশে নারী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে গণ্য করা হয়। সময়ের ধারায় সমাজ এগিয়ে চলছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অবস্থান ও মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটছে। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে রসুইঘর থেকে বিমানের ককপিট এমন কি পর্বতশৃঙ্গেও বাঙালী নারীদের পদচারণা লক্ষণীয়। নারীর এই সফলতা এসেছে নারীর দীর্ঘ আত্মবিশ্বাস ও সংগ্রামের ফলে। সব জায়গাতে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা এটাও নারীদের উল্লেখযোগ্য অর্জন। তাছাড়া সম্প্রতি আদালত কর্তৃক মায়ের অভিভাবকত্বের স্বীকৃতি দান নিঃসন্দেহে নারীদের অন্যতম একটি প্রাপ্তি। আশার কথা বর্তমানে নারী শিক্ষার হারও বৃদ্ধি পেয়ে ৪৯.১ ভাগে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে পুরুষের শিক্ষার হার জানা গেছে ৪৮.৬ ভাগ।
বর্তমানে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে বাঙালী নারীর মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি নেই। দেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, মহিলা আনসার থেকে শুরু করে জাহাজের নাবিক, বিশ্বের সর্ববৃহৎ মহিলা কন্টিনজেন্ট হিসেবে সেনাবাহিনীতে প্রথম ৮৭৯ জন নারী সৈনিকের অন্তর্ভুক্তি, সাহিত্যাঙ্গন, ক্রীড়াঙ্গন, বিমানের পাইলট, প্রথম নারী বক্সিং রেফারি, টিটিই, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দুজন সামরিক নারী পাইলট নিয়োগ এবং সম্প্রতি (২৮ ডিসেম্বর ২০২২) মেট্রোরেলে ট্রেন অপারেটর, ও স্টেশন কন্ট্রোলার পদে নিয়োগ পেয়ে ইতিহাসে নাম অন্তর্ভ‚ক্তি করেন দুই নারী। সকল ক্ষেত্রে বাঙালী নারীদের সরব উপস্থিতি একথাই প্রমাণ করে যে বাঙালী নারীদের কোমল হস্ত সকল ক্ষেত্রেই পারদর্শী, তাইত সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে তাদের উদ্যম পদচারণা।
অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করে ধাপে ধাপে এভাবে নারীদের উত্তরণ এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বায়নের যুগে বহির্বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাঙালী নারীরাও কোনো অংশে পশ্চাৎপদ নয়। কিন্তু তারপরও সমগ্র বিশ্বে নারীর অবস্থানে প্রত্যাশিত পরিবর্তন হয় নি। নারীর সমঅধিকার ও নারীমুক্তির কথা যতই জোর গলায় বলা হোক না কেন বস্তুত উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল নির্বিশেষে সকল দেশেই নারীরা কমবেশি সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার। সামাজিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও নারীর সহিংসতার চিত্র সর্বক্ষেত্রে প্রায় একই। সভ্য জাতি ও সভ্য দেশ হিসেবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রেও নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা কম খর্ব হয় না। পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার। শিক্ষিত হলেও নারীকে সহিংসতার শিকার হতেই হচ্ছে সেটা ঘরে কিংবা বাইরে। এ সম্পর্কে হলিউডের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী চলচ্চিত্র অভিনয় শিল্পী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতে, ‘বিশ্বে এখনও অনেক দেশে নারীর সহিংসতাকে কোনো অপরাধ বলেই মনে করা হয় না। আর এ বিষয়ে যেসব প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেগুলোও গুরুত্বহীনভাবে। নারীকে এখনও বিভাজনের মধ্য দিয়েই চলতে হচ্ছে’।
তবে উন্নত দেশ হিসেবে নারী পুরুষ বৈষম্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীতে লিঙ্গভিত্তিক সব ধরণের বাধা নিষেধ তুলে দিয়ে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। নতুন নিয়মের ফলে জানুয়ারি ২০১৬ থেকে সম্মুখযুদ্ধে পুরুষদের পাশাপাশি নারী সেনারাও অংশ গ্রহণ করতে পারবে।
বিশ্বব্যাপী নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করছে জাতিসংঘ। নারীর মর্যাদা ও অধিকারের বিষয়টিকে জাতিসংঘ সত্তরের দশক থেকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালকে ‘বিশ্ব নারী বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা এবং নারী উন্নয়ন, পরিবারে ও সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতা ও মর্যাদা বাড়ানো, বিশ্বব্যাপী নারীদের শিক্ষা স্বাস্থ্যসহ সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত নারী দশক পালন করা হয়। ডিএডবিøউ, ইন্সট্রা, ওসাজি ও ইউনিফেম- এই চারটি সংস্থাকে একত্র করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইউএন উইমেন। জাতিসংঘের ইউনিসেফ, ইউএনডিপি এবং ইউএনএফপিএ যারা জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছেন তাদের আরও সহযোগিতা করার লক্ষ্যে ১ জানুয়ারি ২০১১ ইউএন উইমেনের কার্যক্রম শুরু হয়।
হি ফর শি- নারীর জন্য পুরুষ। বিশ্বজুড়ে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জাতিসংঘের ইউএন উইমেন। ২০১৪ সালে ২০ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় হি ফর শি-এর যাত্রা।
দেশে দেশে নারীদের এত সাফল্য অর্জনের পরও নারীদের অবস্থান মোটেই আশাব্যঞ্জক ও সুখপ্রদ নয়। একটি দেশ কতখানি সভ্য ও উন্নত সেটা অনুধাবন করা যায় সেই দেশের নারীর মর্যাদা ও অবস্থান থেকে। নারীর প্রতি সহিংসতারোধ, মতপ্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নারী উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দায়ী সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও পারিপার্শ্বিক সমাজ ব্যবস্থা। তাই শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী দরিদ্র, নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার। সুতরাং, উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে মজুরি ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীভূত হয়ে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মাঝে ইতিবাচক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারীজাতির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক এই যেন হয় আমাদের সকলের প্রত্যাশা।