সেগুন বাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে ড. নাজমুন খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিশ্বজিত সাহা
বিশ্বজিত সাহা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। থাকেন নিউ ইয়র্কে। থাকছেন তিরিশ বছর ধরে। পরিচয়টি তাঁর- ‘বইয়ের মানুষ’। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকে বইকেই করে নিয়েছেন জীবিকার উৎস। জীবন শুরুও করেছেন বইয়ের সঙ্গেই। তারপর সাংবাদিকতা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯২ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
নিউ ইয়র্কে পৌঁছে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হলেন এক বাংলা ভাষার পত্রিকায়। এরই ফাঁকে গড়ে তুললেন বইয়ের দোকান ‘নিউ ইয়র্ক মুক্তধারা’। চলতে থাকল বই বিক্রি আর সাংবাদিকতা। কিন্তু শুধু এই-ই নয় বিশ্বজিত সাহার পরিচয়। নিজের পেশাগত পরিচয়টিকে ছাপিয়ে তিনি নিউ ইয়র্কের মাটিতে হয়ে উঠেছেন প্রতিনিধিত্বশীল এক বাংলদেশি নাগরিক।
এবারের একুশে বইমেলায় বিশ্বজিত সাহা এসেছিলেন বাংলাদেশে। এক দুপুরে সেগুন বাগিচার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে অনুস্বর প্রতিনিধি ড. নাজমুন খাতুন বিশ্বজিত সাহার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মুখোমুখি হয়েছিলেন। জানতে চেয়েছেন বিশ্বজিত সাহার কাজ সম্পর্কে। জানতে চেষ্টা করেছেন তাঁর প্রতিনিধিত্বশীলতার জায়গাটি সম্পর্কে। এখানে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির প্রথম কিস্তিটি প্রকাশিত হলো।
অনুস্বর: আমেরিকার বাংলা বইয়ের মুখ আপনি, কিংবা বলতে পারি বর্হিবিশ্বে সবচেয়ে বড় বাংলা বইয়ের যে মেলা, সেটার রূপকার আপনি। আমরা একটু পেছন থেকে শুরু করতে চাই। নিউ ইয়র্কে কবে গিয়েছিলেন?
বিশ্বজিত সাহা: ১৯৯১ সালের ২৮ আগস্ট আমি নিউ ইয়র্কে পৌঁছি। ২ সেপ্টেম্বর থেকে আমি বাংলা বই নিয়ে কাজ করা শুরু করি। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্কুলের মতো ছোট পরিসরে বাংলা বইয়ের সম্মেলন নামে একটা আয়োজন হলো। তখন বাংলাদেশের বাঙালির সংখ্যা খুবই কম। প্রথম যাওয়ার পরে রবীন্দ্র মেলায় গিয়েছিলাম। রবীন্দ্র মেলায় বাঙালিরা অনুষ্ঠান করে। সেখানে বিমল ধর নামে এক ভদ্রলোক কলকাতার কলেজ স্ট্রিট থেকে বই নিয়ে এসেছিলেন। সে বইগুলোর মধ্যে বাংলাদেশি লেখকদের দু’টা বই আমি পেয়েছি। আমি একটা বই কিনে নিয়েছি। আরো একটা বই কিনতে চেয়েছি, আরেকজন নিয়ে গেছেন। মাত্র দু’টা বই-ই ছিল।
তারপরে কয়েকদিন পরে জ্যামাইকার আমেরিকার একটা স্কুলে বাংলাদেশ সম্মেলন হবে। আমি নিউ ইয়র্কে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানকার প্রথম বাংলা সংবাদমাধ্যম ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করা শুরু করি। সেই মুহূর্তে আমার কাছে মনে হলো বাংলা বইটা খুব জরুরিভাবে দরকার। ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে ওই ভদ্রলোক বই নিয়ে এসেছে অথচ বাংলাদেশ সম্মেলন হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের কোনো বই নাই। এখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, বাংলা ভাষাটা জানা ওদের জন্যে জরুরি। কেননা দুই প্রজন্মের মধ্যে একটা মেলবন্ধন, একটা সেতুবন্ধন তৈরি করার জন্য বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। তখনই আমি তাৎক্ষণিকভাবে বৃটিশ এয়ারওয়েজের মাধ্যমে, আই থিঙ্ক ফোর হান্ড্রেড অ্যান্ড থারটি বই জরুরিভিত্তিতে এখানে নিয়ে আসি। সম্মেলনটা দুই দিন চলেছিল, শনিবার আর রোববার। কেননা এটা উইকেন্ড। শনিবার উইদিন থ্রি টু ফোর আওয়ার্সের মধ্যে সব বই বিক্রি হয়ে গেছে।
অনুস্বর: কিন্তু আপনার যাওয়ার উদ্দেশ্যটা কি ছিল?
বিশ্বজিত সাহা: আমি এখানে সাংবাদিকতা করতাম। ঢাকাতে মোস্তফা জব্বারের ‘আনন্দ’ পত্রিকার সিটি সম্পাদক ছিলাম। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতনের পর আমি প্রচুর লেখালেখি করতাম। আমি, সৈয়দ বোরহান কবীর, আসারুদ্দৌলা, মনজুরুল ইসলাম, অজয় বিশ্বাস- আমরা কতগুলো মুখ ছিলাম। আপনি যদি ইতিহাস দেখেন। দেখবেন শহীদ মিনারে যে ছাত্রনেতারা শপথ নিচ্ছে, স্বৈরাচারকে না হটিয়ে আমরা ঘরে ফিরব না, সেই শপথ অনুষ্ঠানে দেখবেন আমার ছবি আছে। আমরা একটা ব্যাপারে একমত, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রয়োগ হোক, এর কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু সাংবাদিকতা করেছি বা চিন্তা-চেতনা মননে ছিলাম বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে, সে কারণেই এই কাজটি যখন আমি শুরু করি। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আমার বন্ধুবান্ধবসহ আরো কয়েকজন ও সমমনা কিছু লোকের সাথে একত্রিত হয়ে আমরা চিন্তা করলাম, আন্তর্জাতিক বলয়ে একুশকে তুলে ধরা দরকার। তখন কিন্তু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয় নি। ১৯৯৯-এ হয়েছে। ১৯৯২ সালে আমার বয়স ছিল ২৫ বছর নয় মাস। আমি সিদ্ধান্ত নিই আমার বন্ধুদেরকে নিয়ে জাতিসংঘের সামনে শহীদ মিনার করব। রাত ১২টায় ফুল দিব এবং আপনি জানেন রেড অ্যালার্ট এরিয়া, সেখানে সাধারণত পারমিশন পাওয়া যায় না। সেই পারমিশন আমরা সংগ্রহ করেছি উইদিন ফাইভ শর্ট টাইম। ভালো করে ইংরেজি বলতে পারতাম না। কোথায় যাব জানতাম না, পাস ডিভিশন, কোন্ সেকশন থেকে পাস নিতে হয়, পুলিশ থেকে পাস পাওয়ার পরে সাইনের জন্য পারমিট নিতে হয়- এসব কিছুই জানতাম না। কিন্তু এ কাজগুলো আমাদেরকে করতে হয়েছে এবং বলা হয় যে নিজেরা স্বপ্নটা এভাবে দেখেছিলাম যে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ আমার কাছে একটা বিশেষ দিন কারণ যেমন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন বলেন, বাংলাদেশের রূপ, কিন্তু ওই দিনই হয়ে গেছে।
অনুস্বর: এটা তো আপনি কাজটা করলেন। আমরা আসলে জানতে চাইছি পেশাগত দিকটা। ওখানে গিয়ে আপনি একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করবেন, এটা তো পরিকল্পনায় ছিল না?
বিশ্বজিত সাহা: না। যেহেতু আমার সাংবাদিকতা ব্যাকগ্রাউন্ড, নাম্বার টু হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় অ্যাডভানটেজ ছিল মোস্তফা জব্বারের পত্রিকাতে যারাই চাকরি করতেন প্রত্যেকে বাংলা টাইপ করতে জানতেন। না হলে এটা অ্যালাও ছিল না। আমি ফার্স্ট গিয়েছি বাংলা টাইপ শিখেছি এবং জব্বার ভাইয়ের কম্পিউটারের যে বইটা আছে, দেখবেন তিনশ’ ইন্টারভিউ আছে তার ভিতরে প্রতিটা আমার করা। দেখবেন প্রত্যেকটার নামের পিছনে আমার নাম আছে। সাংবাদিককে বেতন দেয়ার মতো অবস্থা তখন নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্র-পত্রিকার ছিল না। তখন মাত্র তিনটি পত্রিকা ছিল। ‘প্রবাসী’, ‘ঠিকানা’ এবং ‘বাঙালি’। আর এখন ধরেন কুড়িটা পত্রিকা আছে। বাঙালি জনসংখ্যা এখন আছে ৫ লাখ, তখন ছিল ৫০ হাজার। ৩০ বছরের পার্থক্যটা আমি বলছি। তখন যেহেতু আমি বাংলা টাইপ জানি, এই কারণে ‘প্রবাসী’ পত্রিকাতে আমার চাকরিটা খুব দ্রুত হয়ে গেছে।
অনুস্বর: আপনি নিউ ইয়র্কে গিয়ে সেখানকার আমেরিকানদের সঙ্গে কিছু করার চেষ্টা করেন নি?
বিশ্বজিত সাহা: না।
অনুস্বর: ইচ্ছে ছিল না?
বিশ্বজিত সাহা: না। আমি একদিন কাজ করেছি। একদিন আমি একটা রেস্তোরাঁয় কাজ করেছি। সেই রেস্তোরাঁয় কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি একটা লেখাও লিখেছি। সেই রেস্তোরাঁয় সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ করার পর সেদিনের একটি বর্ণনা দিয়েছি। সেই বর্ণনাটা আমি এই মুহূর্তে আপনাকে বলতে পারব না। কিন্তু শুধু দুই লাইনে বলে দিই- ওখানে কাজ করার যে নিয়ম বা পদ্ধতি, ধরেন প্রথমে গিয়ে গ্লাসটা ক্লিন করা থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের ঠাণ্ডা জলের ভেতরে গ্লাভস পরে হাত ঢুকিয়ে চিকেন ধোয়া থেকে শুরু করে লাস্ট যখন আপনি কাজ ছেড়ে আসবেন, সেই মুহূর্তে আপনাকে ক্লিন করে আপনার ডিউটি পালন শেষ করবেন। এই একদিনে আমার জীবনের যে অভিজ্ঞতা, সেটি আমি মনে করি আমার জীবনকে গড়ার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমার শরীর, মন এবং আমার মেধার যে বিকাশের জায়গাটি ছিল, সে কাজের জন্য আমি তৈরি না। সে কাজের যোগ্য মানুষ না।
অনুস্বর: আপনার এই যে তাগিদগুলো বিশেষ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে কি?
বিশ্বজিত সাহা: এটা ভেরি সিম্পল। এটা হচ্ছে, আমি যে পরিবারের বড় হয়েছি এবং আমাদের পরিবারিকভাবে চিত্তদার সাথে আমার ছোটবেলার যে সম্পর্ক, ওনার সাথে কক্সবাজারে গিয়েছি যখন আমি মেট্রিক পাস করি। এসএসসি পাস করার পর ওঁর সাথে দেড় মাস ছিলাম। ঝাউতলা নামে একটা জায়গা আছে সেখানে আমরা থাকলাম দেড় মাস। সেই জায়গা থেকে প্রবালের দোকানের শেলফের মধ্যে আমরা বই দিয়ে দিয়েছি। সেটা কত সালে জানেন? ’৮০-’৮১ সালে। সমুদ্রে ভ্রমণে আসেন আপনি, অবসরে বাংলা বই পড়ুন, বই কিনুন, বই উপহার দিন। ঠিক আছে? এই শ্লোগানটা সবাই জানে। কেননা এটা মুক্তধারার একটা বড় স্লোগান ছিল। চিত্তরঞ্জন সাহা একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন ‘এই জীবন কর্মময়, মরিলে বিশ্রাম হয়।’ এই কথাটা তিনি ছোটবেলায় শিখেছেন। কোত্থেকে জানেন? ওনার বাবা ওনাকে চুল কাটাতে নিয়ে যেতেন। চুল কাটার সেলুনে একটা আয়নার ওপর লেখা ছিল। বিভিন্ন কথা লেখা থাকে না? খুব সুন্দর সুন্দর কথা। তেমন একটা লেখা ছিল ‘এ জীবন কর্মময়, মরিলে বিশ্রাম হয়’। চিত্তদা তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন ওই জায়গা থেকে তিনি কথাটা ক্যাচ করেছেন। আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে আমি যখন গ্রাজুয়েশন করে যখন মাস্টার্স করি তখন ঢাকাতে আমি চার বছর তাঁর সাথে কাজ করি। প্রতিদিন কাজের যে একটা কর্মতালিকা এটি ছিল আমার জীবনে শেখার অনেক কিছু। এই তাগিদটা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, জাতিসংঘের সামনে শহীদ মিনার ব্যাপারটা সত্যিই একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এই কারণে ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হয়েছে, পৃথিবীর সব লোক জানে ঘটনাটা। এটি আমাদের কাছেও নিঃসন্দেহে একটা অন্যতম ঘটনা।
অনুস্বর: জাতিসংঘের সামনে শহীদ মিনার- জাতিসংঘকে কেন বেছে নিলেন?
বিশ্বজিত সাহা: ঠিক, কিন্তু ১৯৯২ সালে কিছু তরুণ ছেলেরা আমেরিকার নিউ ইয়র্কের এত জায়গা থাকতে জাতিসংঘটাকে কেন বেছে নিয়েছে? এই প্রশ্নটি কিন্তু কেউ করে নি। এটি অনুভব করার ব্যাপার। এটি কতটুকু ইমপরটেন্ট বাংলা ভাষার জন্য সেটি যদি আপনি এখন আপনি যদি চিন্তা করেন, ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন জাতিসংঘে। আওয়ামী লীগ সরকার, বিএনপি সরকার, কত সরকার ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু এই দিনটার গুরুত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনো কি দিয়েছে? কখনো কি এই দিনটার কথা ভেবেছে? দেখেন, চার বছর আগে নিউ ইয়র্ক স্টেট সিনেটে আমি এটাকে পাস করিয়েছি। নাম হবে বাংলাদেশের ইমিগ্রান্টদের। আপনি এখনই নিউ ইয়র্ক সিনেটে গিয়ে দেখবেন, রেজুলেশন নাম্বার দেন, দেখতে পাবেন। এটি একটি অসাধারণ ঘটনা যেটা আমেরিকার ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে। আমি একটা সাধারণ মানুষ। নোয়াখালীর চৌমুহনী অজ পাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম। গ্রাজুয়েশন করেছি, ঢাকাতে এসেছি চাকরি করেছি। মাস্টার্স করেছি তারপর একটা সময় আমার নিউ ইয়র্ক যাওয়ার সুযোগ হলো। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, আমেরিকার আইন পরিষদ কর্তৃক এতগুলো অর্জন। আপনি যদি দেখেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। তারপর ২৬ মার্চকে ইনডিপেন্ডেন্ট ডে অব বাংলাদেশ ঘোষণা করানো। তারপর ১৭ মার্চকে বঙ্গবন্ধুর ১৩-৫২ ডে ঘোষণা করানো, ২৫ সেপ্টেম্বর এরকম। তারপর বাংলা সপ্তাহ, আন্তর্জাতিক বাংলা সপ্তাহটা ঘোষণা করিয়ে এনেছি। তাহলে কি বাংলা বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে বাংলার অনেকগুলো অর্জন। জানেন, আমেরিকার প্রায় নয়টা ইউনিভারসিটিতে বাংলা বিভাগ রয়েছে। আমরা যে ভোট দিই আমেরিকাতে, আমি তো আমেরিকার একজন বাঙালি ভোটার। সেই ব্যালটে আপনি দেখবেন বাংলায় লাইন রাখা আছে।
অনুস্বর: এ বিষয়ে আমাদের কয়েকটি প্রশ্ন আছে। আপনি ত্রিশ বছর ধরে বাংলা থেকে দূরে আছেন, তো এ বাংলাদেশকে কেমন দেখছেন? এই ব্যাপারগুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে…
বিশ্বজিত সাহা: আমি শেষ দিচ্ছি। আসলে কি, বাংলাদেশে আমি এত ঘন ঘন আসি, প্রতি বছর আমি দুইবার-তিনবার আসি। বাংলাদেশকে আমার কখনো অচেনা মনে হয় না। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত সাত বছর আমি বাংলাদেশে আসতে পারি নি। কেননা পারমিট পাওয়া হয় নি। সেই সাত বছর পর যখন আমি বাংলাদেশে এলাম সেই বাংলাদেশটা আমার কাছে অনেকটা অচেনা মনে হলো। কিন্তু ১৯৯৯-এর পরের বাংলাদেশটা আমার কাছে খুব চেনা।
অনুস্বর: কি মনে হয়? বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছে?
বিশ্বজিত সাহা: আমার কাছে যেটা মনে হয় বাংলাদেশে ট্রিমার.. ড্রাস্টিক চেঞ্জ এসেছে। বাংলাদেশ একটা অন্য পর্যায়ে চলে গেছে। এই অন্য পর্যায়টা আমি বোঝাতে চাচ্ছি স্ট্রাকচারের দিক দিয়ে। সততার কথা, মরালিটির কথা আমি বলব না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের যে চাহিদা বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বা যদি আপনি বলেন, যে প্রতিটা মানুষের ক্রয় ক্ষমতার যে বিস্তার ঘটেছে সেটা কিন্তু ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় নেই- আমি নেপালে যাই, আমি ভুটানে যাই শ্রীলঙ্কাতে যাই…
অনুস্বর: এখানে একটা বিষয় আছে।
বিশ্বজিত সাহা: প্লিজ।
অনুস্বর: ক্রয়ক্ষমতা যদি বলেন, সেটা হলো মানুষের যে আয়, আয়টা যখন আমরা দেখছি, হয়ত সেটা বাড়ছে, তার পাশাপাশি কিন্তু সমান্তরালভাবে দ্রব্যমূল্যের দামটাও বাড়ছে।
বিশ্বজিত সাহা: অনেক।
অনুস্বর: যার ফলে এটা যে খুব একটা পরিবর্তিত হচ্ছে, তা কিন্তু না।
বিশ্বজিত সাহা: পরিবর্তিত না হোক।
অনুস্বর: কিন্তু আপনি যদি মুদ্রাস্ফীতি লক্ষ্য করেন, আমরা আসলে এ দিকটায় যেতে চাই না, কিন্তু প্রসঙ্গটা এল বলে বলছি। মুদ্রাস্ফীতির কথাটা যদি আমরা বলি তাহলে কিন্তু দেখা যাবে, যেমন ধরুন, ১৯৯২ সালে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কি রকম ছিল? এখন ঠিক কি রকম আছে? আমি একটু উদাহরণ দেই। ধরুন কাতারের কথা যদি বলি, কাতার তো এখন সবচেয়ে ধনী দেশ…
বিশ্বজিত সাহা: রাইট।
অনুস্বর: তো ’৯০ সালে কাতারের যে রিয়াল, সেই রিয়ালের মান এক ডলারের বিপরীতে ৩.৬৫ এবং ত্রিশ বছর কেটে গেলেও এখনো ওদের ওইটাই আছে- ৩.৬৫। অপর দিকে বাংলাদেশের টাকা ডলারের বিপরীতে ষাট থেকে নব্বই হয়ে গেছে।
বিশ্বজিত সাহা: আমি বলছি। কাতার বা দুবাই এদের সাথে আমেরিকার একটা চুক্তি আছে। আপনি জানেন বোধহয় ১০০ বছরের বা ৫০ বছরের। এই চুক্তিটা হচ্ছে তুমি ওয়ান ডলার ইকুয়ালটু ৩.৫ বা ১ ডলার ইকুয়ালটু টেন, এটা তুমি চেঞ্জ করতে পারবা না। এটা হচ্ছে দু’টো দেশের সম্পর্ক। এটা তাদের লিখিত চুক্তি। এবার ডলারের দাম যতই বাড়ুক ইউরোতে ওরা এত বেশি বাড়াতে পারবে না।
অনুস্বর: না, আমাদের ওটা বিষয় না…
বিশ্বজিত সাহা: না, আমি বলছি বাংলাদেশের ব্যাপারটা। বাংলাদেশের সমন্বয়ের জায়গাটা হচ্ছে, আমার কাছে মনে হয়েছে, ধরেন মিটার দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে কিন্তু মিটার মানছে না। সে ভোক্তাকে বা যিনি চড়ছেন তাকে তিনি এক্সপ্লয়েড করছেন।
অনুস্বর: মানে আপনি সততার জায়গাটা বলছেন। তাহলে আমরা যে অবকাঠামোগত উন্নয়নটা দেখতে পাচ্ছি সেটি একটি চোখ ঝলসানো বিষয়। এটা কি তবে শুধুই আমাদের সান্ত্বনা?
বিশ্বজিত সাহা: না। এটা সান্ত্বনা না। একটা তরুণ সমাজ কর্মঠ এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যত কিছু হোক এখানে আমার মাতৃভূমি, এ জায়গাতে আমি উন্নয়ন করব। এ জায়গা থেকে আমি সোনার ফসল ফলাব। এই গ্রুপটার সংস্থা অনেক বেড়ে গেছে।
অনুস্বর: আপনি আশাবাদী?
বিশ্বজিত সাহা: ডেফিনিটলি ডেফিনিটলি।
অনুস্বর: আরেকটা বিষয় জানতে চাই। আপনার যে অর্জনটা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে আমেরিকার সিনেটে পাস করানো, এটি করতে যেয়ে প্রতিবন্ধকতাগুলো কেমন ছিল?
বিশ্বজিত সাহা: এটা অসম্ভব কঠিন প্রতিযোগিতা ছিল। প্রথম বছর, যখন আমি ২০০০ সালে উত্থাপন করি তখন নিউ ইয়র্কের স্টেটের সিনেটরা ছিল, তাদের মধ্যে প্রায় রিপাবলিকানরা হতে দেয় নি দু’বছর। দেখবেন, ২০১২ সালে প্রথম আমরা পাই। তার কারণ হচ্ছে কোনো কিছু করতে গেলে যদি কোনো বাধা আসে তাহলে কিন্তু সেটা সংসদে পাস হবে না।
অনুস্বর: কিন্তু আমরা যেটা দেখেছি সবাই একসঙ্গে সমর্থন দিয়েছে।
বিশ্বজিত সাহা: এটা তো আপনি সাকসেসটা দেখেছেন। সাকসেসটা কিন্তু আমরা সামনে হাত তালি দেই। কিন্তু ম্যাডাম আপনি দেখবেন এর…
অনুস্বর: আমি দেখেছি এবং আপনি আমার অনুভুতিটা দেখেছেন…
বিশ্বজিত সাহা: যেমন ধরেন, এই যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বা ২৫ সেপ্টেম্বর বা স্বাধীনতা দিবস বাংলাদেশের এসব রেজুলেশন যে পাস হয়েছে, সবই পাস হয়েছে ২০১৫-এর পরে। এর কারণ আমরা এখন পাঁচ লক্ষ লোক বাস করি নিউ ইয়র্ক শহরে। আমাদের ভোটের দরকার তাদের। আমরা অনেকগুলো সিনেটরকে আমি ইনভলভ করেছি। মুক্তধারা ফাউন্ডেশন একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে। এই প্রস্তাবনাটা মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের না, এটা অভিবাসী বাংলাদেশিদের। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কথা। যদি এই কাজটা যদি না করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে পরবর্তী ভোটে ভোটটা তারা সেভাবে পাবে না। মানে কি প্রত্যেকটা জায়গাতে একটা অর্থ আছে যেহেতু নাগরিক সমাজের নিজস্ব
একটা ভাবনা, তাদের চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে এই জিনিসগুলোতে। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন ২০০৯, ১০, ১১ আমরা কিন্তু পারি নি করতে। পারি নি কারণ হচ্ছে রিপাবলিকানরা বিরোধিতা করেছে। এখন ডেমোক্রেটিক পার্টি আছে যারা ক্ষমতায় তাদের সংখ্যায় বেশি, আমাদের প্রতিনিধিত্ব বেড়ে গেছে। আর ডেমোক্রেটরা সবসময়ই ইমিগ্রান্টদের জন্য। এবং আমি যখন এ ভাবনাটা ভেবেছি যে, ২৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন, আমেরিকার সমাজে এতে কিছু যায় আসে না। রাইট? এই প্রশ্নটা কিন্তু কেউ কোনোদিন আমাকে করে নি। আপনি দেখেন এটার সাথে কিন্তু অভিবাসী বাঙালি কিভাবে জড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি মাল্টিকালচারালের জায়গা হচ্ছে নিউ ইয়র্ক। পৃথিবীর এত ভাষাভাষীর মানুষ বাস করে যেটা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নাই। এখন আমার কাছে মনে হলো যে ইউনেসকোর একটা রেজুলেশন পাস আছে। জাতিসংঘের একটা রেজুলেশন পাস আছে, স্টেট রেজুলেশন পাস আছে। তো এই তিনটা আমার হাতে একটা অস্ত্র হিসেবে চলে আসলো। এটা আমরা করে ফেললাম। এখন আমরা করে দেখেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার বা এর পরেরগুলো ইন্ডিপেনডেন্ট ডে অব বাংলাদেশ। আপনি বলেন, যে রাষ্ট্রের প্রশাসন বাংলাদেশের জন্মলগ্নে বিরোধী ছিল সে দেশ এত বছর পরে ইন্ডিপেনডেন্ট ডে অব বাংলাদেশ ডিক্লেয়ার করার মাধ্যমে তাদের সিনেটে আইন পাস করেছে। আপনি কি বাংলাদেশে সংসদে আমেরিকান ডে পাস করাতে পারবেন? পারবেন না।
অনুস্বর: আপনি বলছেন যে তারা এটা করেছে, ব্যাপারটা আসলে ভিন্ন একটি বিষয়। ইতিহাসে তারা আমাদের সাথে ছিল না। তাহলে তাদের এই এখন বাংলাদেশের পক্ষে থাকার কোন্ বিষয়টি কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন? শুধুই ভোট? নাকি এর পেছনে আরো কিছু রয়েছে?
বিশ্বজিত সাহা: না, আসলে একটা বড় ধরনের একটা পরিবর্তন চলে আসছে। আমেরিকা একটি মাল্টিকালচারের দেশ। যেমন আপনি দেখেন, নিক্সন প্রশাসন যদি বাংলাদেশের বিরোধিতা করেও থাকে, সেসময় কিন্তু দেখেন আপনি জন এফ কেনেডি বা এডওয়ার্ড কেনেডি বা ধরুন লেয়ার লেভিন…
অনুস্বর: সেসময় আমেরিকার জনতা পক্ষে ছিল।
বিশ্বজিত সাহা: না, আমি জনতা বলব না, আমি বলব স্টেট ডিপার্টমেন্ট পক্ষে ছিল। আমেরিকার পলিটিকসের আনন্দময় জায়গাটা এটাই যে, আপনি ট্রাম্প প্রশাসন বাতিল করে দিন বা একটি আইন, ধরেন ছোট্ট একটি স্টেটের প্রোভিন্সের বিচারপতি ওটা ক্যানসেল করে দিচ্ছে। বলছে যে তুমি ওইটা করতে পার না। এটা নাগরিক সমাজের বিপক্ষে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে আমেরিকার গণতন্ত্রের বিউটি। একজন বাঙালি অভিবাসী নাগরিক সাধারণ মানুষ, আমি কোনো সিনেটরও না, আমি কি করেছি? কতগুলোটা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে ২০ জন সিনেটরকে পাঠিয়েছি। বাংলাদেশ সমাজের হয়ে আমি একটা জনমত তৈরি করেছি। তৈরি করে তাদেরকে বললাম, এটা আমাদের দরকার, তুমি চিন্তা করে দেখ।