পূর্ব প্রকাশিতের পর
লেখার কলেবরের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত কবিতার আলোচনার এখানেই রাশ টানতে হচ্ছে। তবে কিছু কবির নাম উল্লেখ না করে পারছি না, যাঁরা রাজনীতির এই মহান কবিকে নিয়ে লিখেছেন অসাধারণ সব কবিতা। এ তালিকায় আছেন কবি আবুল হোসেন, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, হাসান হাফিজুর রহমান, কায়সুল হক, দিলওয়ার, ফজলুল হক সরকার, হায়াৎ মামুদ, মনজুরে মওলা, সিকদার আমিনুল হক, রবিউল হুসাইন, মোহাম্মদ রফিক, মহাদেব সাহা, আবু কায়সার, মাহমুদ আল জামান, রুবী রহমান, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, হুমায়ুন আজাদ, অসীম সাহা, আবিদ আনোয়ার, ময়ুখ চৌধুরী, মুজিবুল হক কবীর, মাসুদুজ্জামান, ফারুক মাহমুদ, বিমল গুহ, হালিম আজাদ, মোহাম্মদ সাদিক, হাসান হাফিজ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ফরিদ আহমদ দুলাল, সোহরাব পাশা, মাহমুদ কামাল, আসাদ মান্নান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, আবু হাসান শাহরিয়ার, হারিসুল হক, কামরুল হাসান, ফেরদৌস নাহার, মারুফ রায়হান, খালেদ হোসাইন, তপন বাগচী, বায়তুল্লাহ কাদেরী, মিহির মুসাকী, শামীম রেজা, সাইমন জাকারিয়া, মাসুদ পথিক-সহ ষাট, সত্তর, আশি, নব্বই, প্রথম বা শূন্য দশক, এমনকি দ্বিতীয় দশকের কবিরাও। এসব কবিতায় বঙ্গবন্ধুর স্বভাববৈশিষ্ট্য অর্থাৎ চারিত্রিক দৃঢ়তা, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি নিঃশঙ্ক অবস্থান, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, অদম্য সাহস, জনমানুষের প্রতি গভীর আস্থা ও তীব্র ভালোবাসা ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষাসহ নানা ভাষার কবিরা আরও অজস্র কবিতা রচনা করবেন। কারণ বঙ্গবন্ধুর মতো মহান রাজনীতিকের জন্মের জন্যে কোনো জাতিকে হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়।
এবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত নিবেদিত ছড়ার দিকে। জন্মশতবর্ষে রচিত নিবেদিত ছড়া এবং আগে লিখিত এবং পরে সংকলিত ছড়া ও ছড়া সংকলনগুলোর কথাই এখানে উল্লেখ করছি। জন্মশতবর্ষে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়ার সংখ্যাও কবিতার চেয়ে কম নয়। এই সময়ে একাধিক নিবেদিত ছড়া সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সময় স্বল্পতা ও পরিসরের কথা মাথায় রেখে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই দুটি প্রতিনিধিত্বশীল সংকলনের মধ্যে। প্রথমটির শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া’ (২০২১)। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত এই সংকলনের সম্পাদক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। নির্বাহী সম্পাদক তপন বাগচী আর সম্পাদনা পর্ষদে রয়েছেন মোবারক হোসেন, রহীম শাহ ও আমীরুল ইসলাম। ১৫২ পৃষ্ঠার এই সংকলনে গ্রন্থিত হয়েছে ১৩৮ জনের ছড়া। ছড়া বিন্যাস করা হয়েছে ছড়াকারদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী।
আলোচ্য দ্বিতীয় সংকলনটির শিরোনাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত ছড়া ও কিশোর কবিতা’। সম্পাদক বিশ্বজিৎ ঘোষ। সম্পাদনা সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আখতার হুসেন, আসলাম সানী, সুজন বড়ুয়া, ফারুক হোসেন, আমীরুল ইসলাম ও আনজীর লিটন। এর প্রকাশক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি। প্রকাশনা সহযোগী সময় প্রকাশন, ঢাকা। এই সংকলনের উপদেষ্টা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও আবুল মাল আবদুল মুহিত আর সম্পাদনা উপদেষ্টা কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী (কামাল চৌধুরী)। ২৭২ পৃষ্ঠার এই সংকলনে গ্রন্থিত হয়েছেন ২২৬ জন ছড়াকার। প্রত্যেকের একটি করে ছড়া সংকলিত হয়েছে এবং ছড়া বিন্যাস করা হয়েছে ছড়াকারদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী। এই বিন্যাস পদ্ধতিটি সহজ হলেও একজন আলোচকের জন্য তা অনেকটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আলোচনার সময় অগ্রজ ছড়াকার থেকে অনুজ ছড়াকারÑএই ধারাক্রম বজায় রাখা কঠিন। তাই তাঁদের ছড়ার উদ্ধৃতি উপস্থাপন আগে-পরে হলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাই।
এছাড়াও বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষে আরও দুয়েকটি নিবেদিত ছড়া সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০০ ছড়া’ ও ব্রত রায় ও সুমন্ত বর্মণ সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০০ ছড়া’। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর কারাজীবনকে ছড়ায় তুলে এনেছেন ছড়াকার ফারুক হোসেন ‘ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন’ শীর্ষক গ্রন্থে।
জন্মশতবর্ষে রচিত ও সংকলিত বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়াকে মোটামুটি চারটি ভাগে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব, স্বাধীনতা-উত্তর, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে ১৯৯৬ সাল অব্দি এবং ১৯৯৬ সাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ছড়াচর্চায় উপস্থাপনা ও ভাষাগত পার্থক্য বিশেষভাবে চোখে পড়ে। ষাটের দশকের ছড়া ছিল পাকিস্তানি শাসক-শোসকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর। সে-সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত ছড়ায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর অমিত তেজ ও শৌর্য-বীর্যের প্রশস্তি। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে রচিত ছড়ায়ও বঙ্গবন্ধুর বীরত্ব ও গৌরবের কথা নিনাদিত। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে রচিত ছড়ায় রয়েছে একটা বড়ো বাঁক। সপরিবারে নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যা ছড়াকারদের গভীরভাবে শোকাভিভূত করে। ফলে শোকাঞ্জলির পাশাপাশি তাঁদের ছড়ায় জ¦লে ওঠে ক্ষোভের আগুনও। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর যশ-খ্যাতি আর শৌর্য-বীর্যের কথা দেশ ছাড়িয়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বপরিসরেও। তাই এই সময়-পরিসরে রচিত ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি হয়ে ওঠে বিশ্বজনীন। বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস, শৌর্য-বীর্য, স্বাজাত্যবোধ, স্বদেশপ্রেম, মহানুভবতা, নিবিড় জনসম্পৃক্তি ইত্যাদি ছড়ার বিষয় হয়ে ওঠে।
এবার প্রাসঙ্গিক কিছু উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়ার স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস চালাতে চাই।
শুরুতেই রয়েছে প্রখ্যাত ছড়াকার রোকনুজ্জামান খানের ছড়া। ‘মুজিব’২২ শিরোনামের ছড়ায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে একাকার করে তুলেছেন। ছড়াটির শুরুটা এরকম : ‘সবুজ শ্যামল বনভূমি মাঠ নদীতীর বালুচর/সবখানে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘর।’ তিনি ছড়াটি শেষ করেছেন এভাবে : ‘আমরা বাঙালি যতদিন বেঁচে রইব এ বাংলায়/স্বাধীন বাংলা ডাকবে : মুজিব, আয় ঘরে ফিরে আয়।’ রোকনুজ্জামান খানের এই প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ বঙ্গবন্ধুকে গণবাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে কী গভীর একাত্ম করে তোলে।
প্রবীণ ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া ‘ধন্য তুমি’২৩ শীর্ষক ছড়ায় নেতা হিসেবে শেখ মুজিবের সাহসী ও স্বতন্ত্র অবস্থানের প্রসঙ্গটি দারুণভাবে তুলে এনেছেন। তাঁর ভাষায় : ‘ধন্য মুজিব ধন্য/বাংলা মায়ের মুক্তি এলো/এমন ছেলের জন্য।/…হাজার নেতার ভিড়ের মাঝে/কণ্ঠে তোমার বজ্র বাজে/মৃত্যুমুখী বন্দি জাতি/বীরের দলে গণ্য।/সর্বকালের একটি মুজিব/হয় না তো আর অন্য/ধন্য মুজিব ধন্য।’
বিশিষ্ট ছড়াকার রফিকুল হক গভীর শ্রদ্ধায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা তুলে এনেছেন তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু’২৪ শীর্ষক ছড়ায়। তাঁর ভাষায় : ‘আকাশ-সমান/তাঁর অবদান/নেই শুরু, নেই শেষ,/লাল-সবুজের/প্রতীক তিনি/তিনিই বাংলাদেশ।’ ছড়াকারের এই উচ্চারণের মধ্যে নির্ণীত হয়ে আছে বাঙালির হৃদয়ে-মননে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যথাযথ অবস্থানটি।
আরেক প্রবীণ ছড়াকার আখতার হুসেন ‘সোনার বরন ছেলে’২৫ শীর্ষক ছড়ায় হারিয়ে ফেলা শেখ মুজিবকে খুঁজছেন গভীর সংবেদনের সঙ্গে : ‘আর কত আর/খেলবে কানামাছি/মুজিব তোমার আসন পেতে/আমরা জেগে আছি।’ এই জেগে থাকা কেবল একজন ছড়াকারের নয়, এ যেন সমগ্র বাঙালি জাতির দীর্ঘতর প্রতীক্ষা; মুজিবের জন্য যে আসন পাতা আছে, তা আর কাউকে দিয়েই পূরণ হবার নয়।
এনায়েত হোসেনের ছড়ায় যেন একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ আর শেখ মুজিব একাকার হয়ে ওঠে। ‘একাত্তরের লাল ইতিহাস/রক্তেভেজা মাটি,/অনন্তকাল শেখ মুজিবের/চিরস্থায়ী ঘাঁটি।’২৬
ছড়াকার খালেক বিন জয়েনউদদীন যখন লোকছড়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠেন : ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি কুতুর কুতুর ছা/টুঙ্গীপাড়া শেখের বাড়ি উইড়া সেথায় যা।/সেইখানেতে রাখাল রাজার ছোট্ট কবরখানি/সন্ধ্যা-সকাল ঝরায় কেবল লক্ষ চোখের পানি।’২৭ তখন ছন্দের দুলুনিতে আমরাও কেমন আনমনা আর ভারাক্রান্ত হয়ে উঠি।
জনপ্রিয় ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ’টুঙ্গীপাড়ার খোকা’২৮ শিরোনামের নিবেদিত ছড়ায় শব্দে-ছন্দে এঁকেছেন জাতির পিতার প্রতিবাদী এবং মানবিক অবয়ব। ছড়াটির একেবারে শেষে এসে তাঁর উচ্চারণ: ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু/টুঙ্গীপাড়ার খোকা,/সৌরভে তাঁর আলোর কুসুম/ফুটছে থোকা থোকা।’ সত্যিই তো, বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়ায় থোকা থোকা আলোর কুসুম ফুটেছে সারা বাংলায়Ñযাঁর সুবাস দেশ ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
ছড়াকার আলম তালুকদার ‘আমার কাছে বঙ্গবন্ধু’২৯ শীর্ষক ছড়ায় তাঁর নিজের কাছে বঙ্গবন্ধু ঠিক কী, তার স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস চালিয়েছেন। ছড়াটির শেষে এসে তিনি বলেন : “আমার কাছে বঙ্গবন্ধু নয় তো কেবল শোক/আকাশ ধরার সাহস জোগায় এমন মহান লোক!/আমার কাছে বঙ্গবন্ধুর নাই তুলনা শেষ/রক্ত দিয়ে নাম লিখেছেন ‘সোনার বাংলাদেশ’!” উদ্ধৃত পঙ্ক্তিতে শোকের সীমানা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন সাহসের আরেক নাম। তাঁর পবিত্র রক্তে রঞ্জিত ‘সোনার বাংলাদেশ’ যতদিন থাকবে ঠিক ততদিন তিনিও থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে ও মননে।
প্রবাসী ছড়াকার অজয় দাশগুপ্ত। বঙ্গবন্ধু-অন্তঃপ্রাণ এই ছড়াকার তাঁর ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর জন্মকালকে স্পর্শ করে বাঙালির আত্মপরিচয় উন্মোচনের প্রয়াস চালিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু’৩০ শীর্ষক ছড়ায়। তাঁর ভাষায় : ‘ধর্ম যেমন ধর্ম তো নয়, মঠ মন্দির চার্চকে ছাড়া/বাঙালি কি বাঙালি হয় সেই সতেরোই মার্চকে ছাড়া?’ বঙ্গবন্ধুর জন্ম তারিখটিকে ছড়াকার কী চমৎকার করে মেলালেন বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গে। একই ছড়ার শেষে গিয়ে তিনি যখন বলেন : ‘শান্তি স্থিতি কিংবা লড়াই জয় কি রণতুর্য ছাড়া?/বাংলাদেশও অসম্পূর্ণ মুজিব নামের সূর্য ছাড়া।’ তখন বঙ্গবন্ধুময় বাংলাদেশই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে আর ‘মুজিব’ নামক সূর্যটি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে প্রত্যাশিত আলো দিয়ে।
ছড়াকার আহমাদউল্লাহর ভাষায় : ‘ঘুমিয়ে আছেন/জাতির পিতা/টুঙ্গিপাড়ায়,/ওখান থেকেই/ভালোবাসার দুহাত বাড়ায়।/আন্দোলনের/ঝড়ো হাওয়া/বাংলা নাড়ায়,/বীর বাঙালি/স্বৈরতন্ত্র/রুখে দাঁড়ায়।’৩১
ছড়াকার আহসান মালেকের ছড়ায় উঠে এসেছে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্যবদ্ধ তীব্র গণ-আন্দোলন ও জানবাজি লড়াইয়ের কথা। তাঁর ‘তওবা’৩২ শীর্ষক ছড়া থেকে একটু উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘পাকিস্তানের টিক্কা খান/শেখের কাছে ভিক্ষা চান।/বলল, এবার ছাইড়া দ্যান,/স্বাধীনতা বুইঝা ন্যান।/…আচমকা সেই বিচ্ছুগুলা/সুযোগ পাইয়া ধুনায় তুলা!/মাইরা করে কুপোকাত, ভাঙে চোয়াল ভাঙে দাঁত!/তওবা করি থাকতে প্রাণ/চাইব না আর পাকিস্তান।’ লোকজ শব্দ ও অনুষঙ্গে ছড়াটি কী জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এতে উঠে এসেছে নিরাপস বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ‘বিচ্ছুগুলা’ অর্থাৎ তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য বীরত্বের কথা। উত্তম সেনের ছড়ায়ও সেই একাত্তরের উত্তাল দিনের চিত্র উঠে এসেছে। তাঁর ভাষায় : ‘বঙ্গপিতার চিৎকার/নাড়িয়ে দিল ভিত কার?/কেউ কি ঘরে থাকে?/শেখ মুজিবের ডাকে!’৩৩
ছড়াকার নাসের মাহমুদ যখন বলেন : ‘যাঁর হুকুমে যুদ্ধে গেছি/ভয় করিনি বোমার/তাঁর নামটি স্মরণ করা/আজ প্রয়োজন তোমার।’৩৪ তখন বঙ্গবন্ধুর সাহসী তর্জনী আর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী লড়াইয়ের চিত্রটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ফলে সমকাল তো বটেই উত্তর-প্রজন্মও বঙ্গবন্ধুকে চিনে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়।
ছড়াকার আসলাম সানী তাঁর ‘বাধ্য’৩৫ শিরোনামের ছড়ায় বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু কতটুকু প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য, তা উপস্থাপন করেছেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। তাঁর ভাষায় : ‘নিপীড়িত শোষিতের/হৃদয়ের নিশ্বাস/বাংলার নদী-জল/মাঠের সবুজ ঘাস/এ জাতির পতাকায়/তিনিই তো বারো মাস।/ভুলে যাওয়া মুছে দেওয়া/বড়ো দুঃসাধ্য/জাতির পিতার নাম/নিতে জাতি বাধ্য।’
ছড়াকার আহমাদ মাযহার তাঁর ‘মুজিব মানে’৩৬ শিরোনামের ছড়ায় বাংলাদেশ তথা বিশ্বপরিসরে শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ণময় অনিবার্য অবস্থিতির চিত্র এঁকেছেন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর ভাষায় : ‘মুজিব মানে সংগ্রাম আর/মুজিব মানে তো জয়,/মুজিব মানে তো নির্ভয় আর/না মানে যে পরাজয়।/…মুজিব মানে তো বিশে^র বুকে/গর্বিত মহাপ্রাণ,/মুজিব মানে তো সোনার বাংলা/মুক্ত মাটির ঘ্রাণ,/মুজিব মানে তো চিরভাস্বর/জীবনের জয়গান।’
শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম ছড়ার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আঁকলেন একটি কাক্সিক্ষত ছবি। কার সে ছবিটি? তাঁর ভাষায় : ‘এই ছবিটা কার?/সব মিলিয়ে তাঁর।/বাঙালিদের মহান পুরুষ/শেখ মুজিবের ছবি/এই ছবিতে মুগ্ধ হলেন/শিল্পী এবং কবি’৩৭। শিল্পী এবং কবিদের এই মুগ্ধতা যেন অনিঃশেষ।
ছড়াকার হাসনাত আমজাদের ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ যেন বাক্সময় হয়ে উঠেছে। তাঁর ভাষায় : ‘একাত্তরের মার্চ/জানতে হলে মাসটা লিখে গুগলে দাও সার্চ।/তারিখ মাসের সাত/পড়লে মনে ভেসে ওঠে বলিষ্ঠ এক হাত।’৩৮
শিশুসাহিত্যিক আশরাফুল আলম পিনটু ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর’৩৯ শীর্ষক ছড়ায় পাকিস্তানি শাসক ও শোষকের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর প্রদীপ্ত সাহস আর বীরত্বের ছবি আঁকলেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর ভাষায় : ‘দেশ-মাটি-মা বন্দি তখন দৈত্য-দানোর হাতে/দাপট দেখায় বর্বরতার খেলায় তারা মাতে/এমন সময় বীরের বেশে/একটি মানুষ সামনে এসে/বজ্রহাঁকে খুব শাসালেন ভয়ভীতি সব ভুলেÑ/একটি আঙুল তুলে।/দৈত্য-দানো সব করলেন দূর,/জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর।’ টুঙ্গিপাড়ায় শুয়ে থেকেও বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে নিরন্তর প্রেরণা জোগান, সকল আন্দোলন-সংগ্রামে হয়ে ওঠেন প্রেরণাসঞ্চারী-প্রাণ।
ছড়াকার আনজীর লিটন যখন বলেন : ‘এই যে আমরা আমাদের মতো/গেয়ে যাই গান সুখে অবিরত/এই যে ফসল উর্বরা মাটি/ফুল পাখি নদী অপরূপ খাঁটি/বিজয়ের উল্লাস/এখানে আমার বঙ্গবন্ধু মহানায়কের বাস।’৪০ তখন চির সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশ আমাদের সামনে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর বিজয়দীপ্ত অবয়ব নিয়ে হাজির হয়। প্রকৃতিমগ্ন সহজ-সরল নিরহংকার শেখ মুজিব আমাদের কাছে পরম আপনজন হয়ে ওঠেন।
ছড়াকার ধ্রুব এষ তাঁর ‘দেখি’৪১ শীর্ষক ছড়ায় কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ না করেও এক অসাধারণ প্রতীকী ছবি আঁকেন শিল্পীর অনন্য দক্ষতায়। তাঁর ভাষায় : ‘মেঘ দেখি/মেঘে দেখি তাঁকে/ঢেউ দেখি/ঢেউয়ে দেখি তাঁকে/…গাঁও দেখি/গাঁওয়ে দেখি তাঁকে/রং দেখি/রঙে দেখি তাঁকে/কাকে?’ আমাদের বুঝতে একটুও অসুবিধে হয় না ছড়াকারের কাছে কে এই ‘তিনি’?
কবি-ছড়াকার তপন বাগচীর কাছে বঙ্গবন্ধু চিরকালের অকৃত্রিম বন্ধু। তাঁর ভাষায় : ‘টুঙ্গীপাড়ার শ্যামল গাঁয়ের দস্যি ছেলে,/স্বাধীন দেশেও বুকের তাজা রক্ত ঢেলে/ভালোবাসায় আঁকলে সোনার বাংলাদেশ/যতই লিখি তোমার কথা হয় না শেষ।/তোমার ত্যাগে সতেজ হলো জন্মভূমি/বঙ্গবন্ধু, চিরকালের বন্ধু তুমি।’৪২
ছড়াকার উৎপলকান্তি বড়ুয়ার ছড়ায় তালাশ করা হয়েছে বাঙালির প্রধান পরিচয়সূত্র। তিনি যখন বলেন : ‘লুটিয়ে পড়ে সামনে সকল/ভুল অনিয়ম ভয়,/একটি মুজিব এই বাঙালির/শ্রেষ্ঠ পরিচয়।’৪৫ তখন বাঙালিরা তাদের মুক্তিদাতাকে সহজেই চিনে নেন।
ছড়াকার ওয়াসিফ-এ-খোদা তাঁর ছড়ায় আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুকে একাত্ম করে তোলেন। তাঁর উচ্চারণ : ‘যুদ্ধ চলে শহর-গ্রামে/শেখ মুজিবের নামে,/স্বাধীনতা পেলাম শেষে/লক্ষ প্রাণের দামে।/বিশে^ নিজের পরিচয়ে/বুক ফুলিয়ে চলি/শেখ মুজিবুর জাতির পিতা/গর্ব করে বলি।’৪৬
ছড়াকার রোমেন রায়হান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘পিতা’৪৭ শীর্ষক এক মমত্বমাখানো ছড়া লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা গ্রাম-বাংলায় এবং তাঁকে করে তুলেছেন চিরকালের প্রেরণা। ছড়াকার রোমেনের ভাষায় : ‘সাধারণ থেকে উঠে এসে তুমি মিশেছ সবুজে, লালে/হে আমার পিতা, তুমিই প্রেরণা যুগে-যুগে, কালে কালে।’ রোমেনের এই ভাবনার সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে সহজেই আমরা একাত্ম হয়ে পড়ি।
লেখাটির কলেবরের কথা ভেবে এই আলোচনাকে আর দীর্ঘায়িত করতে চাই না। তবে আরও যাঁরা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির নানা দিক নিয়ে অসাধারণ সব ছড়া লিখেছেন তাঁদের কিছু নাম অন্তত উল্লেখ করতে চাই। ছড়াকারদের পাশাপাশি আমাদের অনেক বরেণ্য কবিও তাঁদের নিবেদিত ছড়ায় বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন। যেমন সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, দিলওয়ার, ফজল-এ-খোদা, রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবিদ আনোয়ার, ফারুক মাহমুদ, আবিদ আনোয়ার, বিমল গুহ, কামাল চৌধুরী, গোলাম কিবরিয়া পিনু, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, খালেদ হোসাইন প্রমুখ।
এছাড়া স্থানাভাবে এ প্রবন্ধে সকল উল্লেখযোগ্য ছড়াকারের উদ্ধৃতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কিছু ছড়াকারের নাম উল্লেখ করে লেখাটির ইতি টানতে চাই। এঁদের মধ্যে রয়েছেন ফয়েজ আহ্মদ, মাহমুদউল্লাহ্, রফিকুল হক, ফারুক নওয়াজ, মাহবুবা হক কুমকুম, ফারুক হোসেন, রাশেদ রউফ, সুজন বড়ূয়া, খালেদ হোসাইন, সিকদার নাজমুল হক, হাসানআল আব্দুল্লাহ, সারওয়ার উল ইসলাম প্রমুখ।
পরিশেষে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত অজস্র ছড়া-কবিতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পত্রপত্রিকার পাতায় ও নিবেদিত ছড়া সংকলনগুলোতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক নেতা যাঁকে নিয়ে সমকাল তো বটেই উত্তর-প্রজন্মও নিবেদিত ছড়া-কবিতায় তাঁর অসামান্য অবদানের কথা তুলে আনবেন। কারণ এই মহান বাঙালির কোনো মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের কাছে এক মৃত্যুঞ্জয়ী অবিনাশী মানবসত্তা।
তথ্যসূত্র:
১. রোকনুজ্জামান খান, ‘মুজিব’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, (সম্পা.) হাবীবুল্লাহ সিরাজী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০২১, পৃ. ১১৮
২. সুকুমার বড়ুয়া, ‘ধন্য তুমি’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১৪১
৩. রফিকুল হক, ‘বঙ্গবন্ধু’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১১০
৪. আখতার হুসেন, ‘সোনার বরন ছেলে’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১৮
৫. এনায়েত হোসেন, ‘মুজিব মানে বাংলাদেশ’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৪০
৬. খালেক বিন জয়েনউদদীন, ‘রাখাল রাজার জন্য’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৪৮
৭. লুৎফর রহমান রিটন, ‘টুঙ্গীপাড়ার খোকা’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১২২
৮. আলম তালুকদার, ‘আমার কাছে বঙ্গবন্ধু’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ২৭
৯. অজয় দাশগুপ্ত, ‘বঙ্গবন্ধু’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১৩
১০. আহমাদউল্লাহ, ‘চিরদিনের মুজিব’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৩১
১১. আহসান মালেক, ‘তওবা’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৩৪
১২. উত্তম সেন, ‘ডাক ৭১’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৩৮
১৩. নাসের মাহমুদ, ‘জাতির জনক’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৭০
১৪. আসলাম সানী, ‘বাধ্য’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ২৯
১৫. আহমাদ মাযহার, ‘মুজিব মানে’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৩২
১৬. আমীরুল ইসলাম, ‘শেখ মুজিবের ছবি’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ২৫
১৭. হাসনাত আমজাদ, ‘নাম সে তো নয়, নদী যেন’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১৪৯
১৮. আশরাফুল আলম পিনটু, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ২৮
২০. আনজীর লিটন, ‘এখানে আমার বঙ্গবন্ধু’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১৯
২১. ধ্রুব এষ, ‘দেখি’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৬৮
২২. তপন বাগচী, ‘চিরকালের বন্ধু’, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত ছড়া ও কিশোর কবিতা, (সম্পা.) বিশ্বজিৎ ঘোষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি, ২০২২, পৃ. ১১৫
২৩. উৎপলকান্তি বড়ুয়া, ‘একটি মুজিব’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯
২৪. ওয়াসিফ-এ-খোদা, ‘বঙ্গবন্ধুর ছড়া’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ৪২
২৫. রোমেন রায়হান, ‘পিতা’, বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ছড়া, ঐ, পৃ. ১২১