অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস
অনুবাদ: জাহান আরা
[১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) যে নৃশংসতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার ওপর ‘জেনোসাইড’ শিরোনাম দিয়ে ১৬ কলামের (২ পৃষ্ঠার) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিজেদের পরিচালিত যুদ্ধের অপারেশন দেখাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ছিলেন এদের মধ্যে একজন। তাঁর এই উদঘাটনমূলক প্রতিবেদন সারাবিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ভয়াবহতা দেখে, অ্যান্থনি নিজের হতভম্ব দশা কাটিয়ে উঠে প্রথমে নিজের পরিবার এবং পরবর্তীতে নিজে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী স¤পাদক।
ঢাকা থেকে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে একাত্তরের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমস প্রকাশিত এই নিবন্ধের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন আর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে উঠে আসে।] ]
আব্দুল বারী’র দুর্ভাগ্য
পূর্ব বাংলার হাজার হাজার মানুষের মতো আব্দুল বারীও ভুল করে ফেলেছিল, মারাত্মক ভুল। পাকিস্তানি টহল বাহিনীর সামনে দিয়ে দৌড়ানোর মতো প্রাণঘাতী ভুল। চব্বিশ বছরের শীর্ণকায় আব্দুল বারীকে জওয়ানরা ঘিরে ধরেছিল। সে থরথর করে কাঁপছিল, কারণ একটু পরেই তাকে গুলি করা হবে।
আমরা তখন কুমিল্লা থেকে প্রায় ২০ মাইল দক্ষিণে মুদাফরগঞ্জের পাশের এক ছোট গ্রামের সীমান্তের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলাম। নবম ডিভিশনের জি-২ অপারেশনের দায়িত্বে থাকা মেজর রাঠোর গল্পচ্ছলে আমাকে জানিয়েছিলেন, ‘সাধারণত কেউ দৌড় শুরু করলেই আমরা তাকে মেরে ফেলি। কিন্তু আপনাকে দেখানোর জন্যই আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আপনি এখানে নতুন এসেছেন এবং দেখা যাচ্ছে যে বেশ অস্বস্তিতে ভুগছেন।’
আমি তীব্রভাবে বাড়তে থাকা উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘তাকে মারবেন কেন?’
‘কারণ, হতে পারে সে একজন হিন্দু অথবা একজন রাষ্ট্রদ্রোহী (মুক্তিবাহিনী), এমনকি সে একজন ছাত্র বা আওয়ামী লীগের লোকও হতে পারে। তারা জানে আমরা তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করছি। এজন্যই তারা দৌড় দিয়ে নিজেদের পরিচয় জানিয়ে দেয়।’
আমি জেদ ধরে বলে উঠলাম, ‘কিন্তু তাদেরকে মেরে ফেলতে হবে কেন? আর বেছে বেছে হিন্দুদেরকেই কেন?’
রাঠোর কঠোরভাবে বললেন, ‘আপনাকে কি আমার মনে করিয়ে দিতে হবে যে কিভাবে ওরা পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল? এখন যুদ্ধের খোলসে ওদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার একটা চমৎকার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’
রক্তাক্ত কলঙ্কের প্রথম আভাস
রাঠোর তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন, ‘আমরা হিন্দুদের মধ্যে শুধুমাত্র পুরুষদের হত্যা করি। আমরা সৈনিক। রাষ্ট্রদ্রোহীদের (মুক্তিবাহিনী) মতো কাপুরুষ নই। তারা আমাদের নারী ও শিশুদের হত্যা করছে।’
আমি পূর্ব বাংলার সবুজ মাটিতে ছড়িয়ে পড়া রক্তের দাগের প্রথম আভাস অনুভব করলাম। প্রথমে এটা ছিল ঘৃণামিশ্রিত বর্বর আক্রোশের ফলে অবাঙালিদের ওপর চালানো বাঙালিদের বেপরোয়া হত্যাকা-। আর, এখনকার এই হত্যাযজ্ঞ স¤পূর্ণরূপে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইচ্ছার ফসল।
পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশের জনগোষ্ঠী হিন্দুরাই যে কেবল এই সুসংগঠিত হত্যাসাধন ও লুন্ঠনের শিকার তা নয়, বরঞ্চ হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও এর শিকার। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র, শিক্ষক, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনৈতিক ক্যাডার এবং ২৬ মার্চ বিদ্রোহ করা ১ লক্ষ ৭৬ হাজার বাঙালি সৈন্য ও পুলিশের মধ্য থেকে যাদেরকে পাকিস্তানি সেনারা ধরতে পেরেছে। এঁরা সকলে মিলে সময়ের আগেই একটি প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে স্বাধীন করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
পূর্ব বাংলায় আমি মোট ১০ দিন ছিলাম। সময়টা, এপ্রিলের শেষের দিকে। সেই দশ দিনে আমি যেসব অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেছি এবং শুনেছি তাতে আশঙ্কাজনকভাবে বোঝা গেছে যে এইসব হত্যাকা- কোনো কমান্ডারের নিজস্ব সিদ্ধান্তমূলক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না।
পূর্ব বাংলায় যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরাই হত্যা করছিল এমন নয়। ২৫ মার্চ রাতে, পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি সৈন্য এবং আধাসামরিক বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল এবং নৃশংস বর্বরতার সাথে অবাঙালিদের ওপর আক্রমণ করেছিল। পাকিস্তানি সেন্সর আমাকে এই রিপোর্ট করার অনুমতি দিয়েছিল।
হাজার হাজার হতভাগ্য মুসলিম পরিবার, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ১৯৪৭-এর দেশভাগের দাঙ্গার সময় পাকিস্তান বেছে নেয়া বিহারী উদ্বাস্তু, তাদেরকে নির্মমভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল। তাদের নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, অথবা বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে তাদের স্তন ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। শিশুরাও সেই নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পায় নি। শিশুদের মধ্যে যারা ভাগ্যবান ছিল তারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গেই নিহত হয়েছিল। কিন্তু আরো হাজার হাজার শিশু ছিল যাদেরকে তাদের অবশিষ্ট জীবনটা কাটাতে হবে উপড়ে ফেলে দেয়া চোখের গর্ত এবং কর্কশভাবে বিচ্ছিন্ন করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিহীন শরীর নিয়ে। চট্টগ্রাম, খুলনা ও যশোরের মতো প্রধান প্রধান শহরগুলোতে ২০ হাজারেরও বেশি অবাঙালির লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পূর্ব বাংলার সবগুলো জায়গা থেকে আমাকে যা বলা হয়েছিল সে হিসেবে, প্রকৃত হিসাবটা সম্ভবত এক লক্ষের মতো। কারণ, হাজার হাজার অবাঙালি কোনো চিহ্ন ছাড়াই উধাও হয়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তান সরকার সেই প্রথম নৃশংসতার ঘটনা বিশ্বকে জানতে দিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার যেটা গোপন করেছে সেটা হলো প্রথম নৃশংসতার অনুকরণে করা দ্বিতীয় এবং আরও ভয়াবহ নৃশংসতা যার দায়িত্বে ছিল তার নিজস্ব সেনাবাহিনী। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে হিসাব করে দেখেছেন যে উভয় পক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। দুর্ভিক্ষ এবং রোগে মারা যাওয়া মানুষদের এই হিসাবের আওতায় নেয়া হচ্ছে না।
দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যার প্রদেশটির প্রায় সফলভাবে বিচ্ছিন্নকরণের প্রতিক্রিয়ায়, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার, পূর্ব বাংলা সমস্যায় নিজস্ব ‘চুড়ান্ত সমাধান’ পদ্ধতিতে এগিয়ে চলেছে।
‘আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, এমনকি এর জন্য যদি ২০ লাখ লোককে হত্যাও করতে হয় অথবা ৩০ বছর পর্যন্ত প্রদেশটিকে উপনিবেশ হিসেবে শাসনও করতে হয়’, ঢাকা ও কুমিল্লার উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বারবার আমাকে এই কথাগুলো বলেছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আতঙ্কজনক পুঙ্খানুপুঙ্খতার সাথে পূর্ব বাংলায় ঠিক এগুলোই করে চলেছে।
চাঁদপুর সফরের পর আমরা সূর্যাস্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছিলাম (পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার মাটিতে রাতের বেলায় বিচক্ষণতার সাথে বাড়ির ভিতরে অবস্থান করে) তখনই টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজারের পিছনে বসে থাকা একজন জওয়ান (প্রাইভেট) তীক্ষ্ম চিৎকার করে উঠল: ‘সাহেব, একটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে।’
মেজর রাঠোর আচমকা গাড়ি থামিয়ে আনলেন, একই সঙ্গে গাড়ির দরজার সামনে রাখা চাইনিজ হালকা মেশিনগানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ২০০ গজের কম দূরত্বে একজন লোককে হাঁটু সমান উঁচু ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে দৌড়াতে দেখা যাচ্ছিল।
‘ঈশ্বরের দোহাই লাগে, গুলি করবেন না,’ আমি চিৎকার করে উঠলাম। ‘লোকটা নিরস্ত্র। একজন সাধারণ গ্রামবাসী।’ রাঠোর আমার দিকে একটা নোংরা চাউনি দিয়ে সতর্কতামূলক গুলি করলেন।
লোকটা যখন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে গিয়ে সবুজের বিশাল গালিচায় ডুবে যাচ্ছিল, দুই জওয়ান তাকে ধরে নিয়ে আসতে ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গিয়েছিল। রাইফেলের বাট দিয়ে কাঁধ জুড়ে আঘাত করার ভোঁতা, ভারী শব্দটা জিজ্ঞাসাবাদের সূচনা করল।
‘কে তুই?’
‘দয়া করুন সাহেব! আমার নাম আব্দুল বারী। আমি ঢাকার নিউমার্কেটে দর্জির কাজ করি।’
‘আমার সঙ্গে মিথ্যা বলবি না। তুই একটা হিন্দু। দৌড়াচ্ছিলি কেন তুই?’
‘এখন প্রায় কারফিউর সময় হয়ে গেছে, সাহেব, আমি আমার গ্রামে যাচ্ছিলাম।’
‘সত্যি কথা বলো। দৌড়াচ্ছিলি কেন?’
লোকটা উত্তর দেওয়ার আগেই একজন জওয়ান দ্রুতবেগে তার শরীরে তল্লাশি চালায় এবং অন্য জওয়ান তার পরিহিত লুঙ্গিটি ছিনিয়ে নেয়। তার উন্মোচিত চর্মসার শরীরটি মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক খৎনার স্বতন্ত্র চিহ্ন বহন করছিল।
উপচে পড়া হত্যা তালিকা/ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ মানব তালিকা অন্তত এটা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছিল যে বারী হিন্দু ছিলেন না। জিজ্ঞাসাবাদ চলতে লাগল।
‘বল্্, কেন দৌড়াচ্ছিলি?’ বারীর তখন জন্তুর মতো ভয়ার্ত দৃষ্টি, সারা শরীর আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছিল। সে কথা বলতে পারছিল না। তার হাঁটু জোড়া লেগে গিয়েছিল। পড়ে যাওয়া বারীকে তুলে ধরে দাঁড় করাতে করাতে একজন জওয়ান বলল, ‘একে দেখতে ফৌজির মতো লাগে, স্যার।’ (ফৌজি হলো সৈনিকের উর্দু প্রতিশব্দ: সেনাবাহিনী শব্দটা বাঙালি মুক্তিবাহিনীর জন্য ব্যবহার করছিল।) আমি শুনতে পেলাম রাঠোর বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘হতে পারে।’
আব্দুল বারীকে রাইফেলের বাট দিয়ে বেশ কয়েকবার আঘাত করা হলো, তারপর অশুভ ইঙ্গিতের মতো তাকে একটা দেয়ালের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। তার আর্তচিৎকারের শব্দে আশীর্বাদের মতো পাশের কুঁড়েঘরের ছায়া থেকে এক যুবকের মাথা উঁকি দিল। বারী বাংলায় কিছু একটা চেঁচিয়ে বলল। মাথাটা উধাও হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে একজন দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ এসে উপস্থিত হলেন। কুঁড়েঘর থেকে একটু পরপর থেমে থেমে এগিয়ে এলেন। রাঠোর বৃদ্ধের ওপর হাঁক দিয়ে উঠলেন। ‘আপনি একে চেনেন?’
‘হাঁ সাহেব, ওর নাম আব্দুল বারী।’
‘ও কি ফৌজি?’
‘না সাহেব, ও ঢাকায় দর্জির কাজ করে।’
‘সত্যি করে বলুন।’
‘খোদার কসম (ঈশ্বরের শপথ) সাহেব, ও একজন দর্জি।’
হঠাৎ করেই যেন সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এরপরে আমি যখন বলে উঠলাম: ‘ঈশ্বরের দোহাই, তাকে ছেড়ে দিন। তার অপরাধশূন্যতার আর কী প্রমাণ চান আপনি?’ রাঠোরকে তখন লজ্জিত দেখাচ্ছিল।
কিন্তু জওয়ানরা ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিল না। তারা বারীর চারপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। আমি তার পক্ষে আরেকবার সুপারিশ করতেই রাঠোর বারীকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ততক্ষণে সে এক চূর্ণবিচূর্ণ, নির্বাক আতঙ্কের স্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।
বাকিরা এতটা সৌভাগ্যবান ছিল না
ছয় দিন ধরে কুমিল্লার নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়ে আমি খুব কাছ থেকে হত্যাকা-ের ব্যাপকতা দেখতে পেয়েছি। আমি দেখেছি, গ্রামের পর গ্রাম, ঘরে ঘরে গিয়ে তন্নতন্ন করে হিন্দুদের খুঁজে বের করে সরাসরি একটি ‘শর্ট-আর্ম ইন্সপেকশন’-এ খৎনা করা হয় নি দেখিয়ে দ্বিধাহীনভাবে গুলি করা হয়েছে।
আমি কুমিল্লার সার্কিট হাউসের (সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেডকোয়ার্টার) ক¤পাউন্ডে পিটিয়ে মেরে ফেলতে থাকা মানুষদের আর্তনাদ শুনেছি। আমি ট্রাক বোঝাই করা হিউম্যান টার্গেট দেখেছি। দেখেছি মানবতাস¤পন্ন মানুষেরা কিভাবে কারফিউ এবং অন্ধকারের আড়ালে তাদেরকে সরিয়ে নিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। সেনা ইউনিটগুলোর কোনো শহর বা গ্রাম থেকে রাষ্ট্রদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনী) নির্মূল করার পরে, সেখানে তাদের ‘কিল অ্যান্ড বার্ন মিশন’ নামক হত্যাযজ্ঞর নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছি আমি।
আমি ‘পিউনিটিভ অ্যাকশন’ প্রয়োগের মাধ্যমে পুরো গ্রামের পর গ্রাম বিধ্বস্ত হতে দেখেছি। এবং রাতের বেলা অফিসারদের মেসে অবিশ্বাস্য কানে শুনেছি সম্মানিত এবং সাহসী মানুষের বীরত্বগাথার মতো করে তাদের সারাদিনের হত্যার গর্বিত গল্পের বর্ণনা।
‘আজ কয়টাকে মারলে?’ উত্তরগুলো আমার মনে গেঁথে আছে।
এই যে এগুলো করা হচ্ছে, যে কোনো পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারই এর কারণ হিসেবে আপনাকে বলবে, ‘পাকিস্তানের ঐক্য, অখ-তা এবং আদর্শ সংরক্ষণের প্রয়োজনে।’ কিন্তু আসলে, এর জন্য অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। ভারতের ভূখণ্ড সীমানার কারণে এক হাজার মাইলের ব্যবধানে থাকা একটি দেশের দু’টি শাখাকে জুড়ে রাখবার জন্য যে সামরিক পদক্ষেপক গ্রহণ করা হয়েছিল, সেই পদক্ষেপ আজ আবেগ এবং আদর্শের ভাঙনকেই বরং নিশ্চিত করেছে।
একমাত্র ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের মধ্যে রাখা সম্ভবপর ছিল। আর সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবিদের আধিপত্য বেশি, যারা ঐতিহ্যগতভাবেই বাঙালিদেরকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে।
ভাঙনের পরিমাণটা এখন এতটাই পূর্ণ হয়েছে যে খুব কম বাঙালিকেই স্বেচ্ছায় কোনো পশ্চিম পাকিস্তানির সঙ্গে দেখতে পাওয়া যাবে। ঢাকা সফরের সময় এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার এই ধরনের বেদনাদায়ক এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মুখ ফিরিয়ে নেয়ার সময় বন্ধুটি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি দুঃখিত, পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। তুমি আর আমি যে পাকিস্তানকে চিনতাম সেটি এখন আর নেই। পেছনের কথা আলাপ করেও আর কোনো লাভ নেই।’
কয়েক ঘন্টা পরে, একজন পাঞ্জাবি সেনা অফিসার, সেনাবাহিনী প্রবেশের আগে অবাঙালিদের গণহত্যার বিষয়ে বলতে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন: ‘১৯৪৭-এর দেশভাগের দাঙ্গায় শিখরা আমাদের সাথে যে বর্বর আচরণ করেছিল, বাঙালিরা আমাদের সাথে তার থেকেও বেশি বর্বরোচিত আচরণ করেছে। আমরা কীভাবে কখনো এসব ভুলে যাব অথবা ক্ষমা করতে পারব?’
(চলবে)
লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক।