অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস
অনুবাদ: জাহান আরা
[অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। ১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে নৃশংসতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার ওপর ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিজেদের পরিচালিত যুদ্ধের অপারেশন দেখাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁদের একজন। তাঁর এই উদঘাটনমূলক প্রতিবেদন সারাবিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ভয়াবহতা দেখে, অ্যান্থনি নিজের হতভম্ব দশা কাটিয়ে উঠে প্রথমে নিজের পরিবার এবং পরবর্তীতে নিজে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘জেনোসাইড’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। ঢাকা থেকে লন্ডনে পালিয়ে একাত্তরের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমস প্রকাশিত এই নিবন্ধের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন আর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে উঠে আসে। প্রতিবেদনটির পূর্ণ বাংলা অনুবাদ অনুস্বরে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। এবারের সংখ্যায় দ্বিতীয় কিস্তি ছাপা হলো। ]
[পূর্ব প্রকাশের পর]
হিন্দু নির্মূল
ভয়াবহ এই সামরিক অভিযানটির দু’টি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যার মধ্যে একটি হলো কর্তৃপক্ষের ভাষায় ‘পরিচ্ছন্ন অভিযান’। গণহত্যার জন্য দেওয়া একটি শ্রুতিমধুর নাম। অপর নামটি হলো ‘পুনর্বাসন প্রচেষ্টা।’
এটা আসলে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনস্থ উপনিবেশে পরিণত করার জন্য গৃহীত সামরিক অভিযানগুলোকে বর্ণনা করার একটা বিশেষ পদ্ধতি। এভাবেই বিশ্বব্যাপী নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় ‘দুষ্কৃতিকারী’ এবং ‘অনুপ্রবেশকারী’র মতো সাধারণ এবং সচরাচর ব্যবহৃত শব্দগুলোকে হেঁয়ালির মতো অফিসিয়াল তথ্যসূত্রে পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহার করে আসা হয়েছে। এই পক্ষপাতিত্ব মূলক প্রোপাগা-া সরিয়ে নিলেই সামনে যে প্রকৃত সত্যটা এসে পড়ে সেটা হলো, উপনিবেশ স্থাপন- এবং হত্যাযজ্ঞ।
আঠারো এপ্রিল এক রেডিও সম্প্রচারে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান হিন্দু নির্মূলীকরণের ন্যায্যতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমেরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। তারা এটিকে টিকিয়ে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদিও একটি প্রচ- সরব, হিংসাত্মক এবং আগ্রাসী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বিশিষ্ট এই কণ্ঠকে জীবন ও সম্পদের হুমকির মাধ্যমে জোরজবরদস্তি করে দাবিয়ে রেখেছিল, যে কারণে আওয়ামী লীগ ধ্বংসাত্মক পথ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।’
ন্যায্যতা প্রসঙ্গে বাকিদের ব্যক্তিগত মতামত আরও বেশি পরিমাণে স্থূল ছিল।
নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টার্সের কর্নেল নাইম কুমিল্লার অফিসার্স মেসে বসে আমাকে বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা তাদের অর্থ দিয়ে মুসলিম জনসাধারণকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসসাধনের চেষ্টা করছিল। প্রদেশটাকে নিংড়ে নিঃস্ব করে ফেলছিল ওরা। সমস্ত অর্থ, খাদ্য ও পণ্যসামগ্রী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। কোথাও কোথাও তারা স্কুল ও কলেজের অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষকের আসন দখল করে থাকছে অথচ নিজেদের সন্তানদের পড়ালেখা করাতে তারা কলকাতায় পাঠিয়ে দিচ্ছিল। এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, বাঙালি সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে ছিল হিন্দু সংস্কৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তান কার্যত কলকাতার মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জনগণের জমিজমা তাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবং জনগণকে আবার তাদের প্রকৃত বিশ্বাসের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হলে ওদেরকে (হিন্দুদের) আমাদের সরিয়ে দিতেই হবে।’
অথবা মেজর বশিরের কথাই ধরুন। তিনি পদমর্যাদার অনেক নিচুতলা থেকে উঠে এসেছেন। তিনি কুমিল্লার নবম ডিভিশনের এসএসও। তিনি নিজ হাতে ২৮টি হত্যাকা- সংঘটিত করেছেন যা নিয়ে তিনি গর্ব এবং আত্মতুষ্টি বোধ করেন। ঘটমান পরিস্থিতি নিয়ে তার নিজস্ব একটা মতামত ছিল।
গ্রিন টি দিয়ে আপ্যায়ন করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘এটা সত্য এবং অসত্যর লড়াই। এখানকার মানুষের নামগুলো মুসলিম হতে পারে এবং নিজেদেরকে তারা মুসলিম বলে পরিচয়ও দিতে পারে। কিন্তু তারা মানসিকভাবে আসলে হিন্দু। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না যে এখানকার ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের মৌলভী (মোল্লা) জুমার নামাজের সময় এক ফতোয়া (আদেশ) জারি করেছেন যে, কেউ যদি পশ্চিম পাকিস্তানিদের হত্যা করে তাহলে তারা জান্নাত (স্বর্গ) লাভ করবে। আমরা এই জারজগুলোকে হত্যা করেছি এবং এখন বাকিগুলোকেও শেষ করছি। সবশেষে যারা বেঁচে থাকবে তারাই হলো প্রকৃত মুসলমান। আমরা তাদেরকে উর্দুও শেখাব।’
সর্বত্রই আমি সবাইকে তাদের নিজস্ব কুসংস্কারের বুননে তৈরি ন্যায্যতার কল্পিত পোশাকে নিজেদেরকে সাজাতে দেখেছি। প্রকৃতপক্ষে, বাঙালিদের নির্বাচনে জয়লাভ করে, শাসন করতে চাওয়ার মতো রাজনৈতিক সমস্যাটির একটি ভয়ঙ্কর ‘সমাধান’ এর প্রয়োজন ছিল। তাই নিজেদের বিবেকের জন্য, ব্যাপারটাকে বৈধ করতে, তাদেরকে বলির পাঁঠা খুঁজে বের করতে হয়েছিল।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে যাদের উচ্চাকাক্সক্ষা এবং স্বার্থ সরকারি নীতিমালায় আধিপত্য বিস্তার করে ছিল সেই পাঞ্জাবিদের ক্ষমতায় কোথাও কোনো আঁচ পড়বে না। সেনাবাহিনী তাদেরকেই সমর্থন করছিল ।
সেনা প্রবেশের আগে, অবাঙালিদের গণহত্যার প্রতিশোধ হিসেবে যা করা হয়েছিল, কর্মকর্তারা সেটিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ঘটনার পরম্পরা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে এই গণহত্যা মূলত কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া বা বিশৃঙ্খল প্রতিক্রিয়ার ফলাফল ছিল না। এটা ছিল পরিকল্পিত।
জেনারেল টিক্কা খানের দায়িত্ব গ্রহণ
ভদ্র, বিনয়ী অ্যাডমিরাল আহসানের কাছ থেকে পূর্ব বাংলার গভর্নরশিপ এবং সামরিক কমান্ড গ্রহণ করেন পা-িত্যপূর্ণ লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা খান। পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এই দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। এতেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে তখন থেকেই এই ‘সমাধান’ পরিকল্পনার সূত্রপাত হয়েছিল।
মার্চের শুরুতে যখন বাঙালিদের অনেক আশার অ্যাসেমব্লি মিটিং স্থগিত করা হয়েছিল এবং শেখ মুজিবুর রহমানের আইন অমান্য আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল, এটা সে সময়কার কথা। বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি ক্রমশ বাড়তে থাকা অপমানের কারণে, সামরিক বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভে মৌন সম্মতি প্রদান করেছিলেন।
ঢাকার পাঞ্জাবি ইস্টার্ন কমান্ড, কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিমালায় আধিপত্য জারি রেখেছিল।
[সম্ভবত উল্লেখ করা উচিত যে, খানেরা এর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়: খান হলো পাকিস্তানিদের একটি সাধারণ বংশ পদবি।]
সম্ভাব্য বিদ্রোহের বিরুদ্ধে প্রাক প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ২৫ মার্চ মাঝরাতের পরে সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলি যখন ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল, তখন তাদের অনেকের কাছেই খরচ যোগ্য মানুষের নামের তালিকা ছিল।
এই তালিকায় ছিল হিন্দু এবং বিপুল সংখ্যক মুসলমান; ছাত্র, আওয়ামী লীগার, অধ্যাপক, সাংবাদিক এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের নাম। অভিযোগ আনা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হল থেকে সেনাবাহিনীর ওপর মর্টার আক্রমণ করা হয়েছিল। তারপরেও, রমনা রেসকোর্স মন্দিরের পাশের দু’টি হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা এবং পুরনো ঢাকার কেন্দ্রস্থল শাখারিপট্টিকে (ঝযধশৎবঢ়ধঃর) নির্মূল করে ফেলাকে কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত করা যায় না।
কিংবা, ২৬ ও ২৭ মার্চের চব্বিশ ঘণ্টার কারফিউ চলাকালীন ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জের বিশাল সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠীর পক্ষে কিভাবে হঠাৎ করে সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সম্ভব সেটিও ব্যাখ্যা করে না। একইভাবে কারফিউয়ের সময়ে আটককৃত মুসলমানদেরও কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় নি। এইসব মানুষদের একটি পরিকল্পিত অপারেশনে নির্মূল করা হয়েছিল: কোনো সহসাকৃত প্রতিক্রিয়ার ফলে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া হিন্দু আক্রমণের ফলাফল একেবারেই ভিন্ন রকম হতে পারত।
১৫ এপ্রিল ঢাকা পরিদর্শনের সময় ইকবাল হল হোস্টেলের ছাদে পচনধরা চারটি মাথা পাওয়া যায়। কেয়ারটেকার জানান, ২৫ মার্চ রাতে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। দু’টি সিঁড়ি এবং চারটি কক্ষে ছিল ভারি রক্তের দাগ। ইকবাল হলের পেছনে একটি বড় আবাসিক ভবনকে সম্ভবত সেনাবাহিনীর নজরদারিতে রাখা হয়েছিল। ভবনের দেয়ালগুলো বুলেটের আঘাতে ছোট গর্তে পরিপূর্ণ ছিল এবং সিঁড়িতে তখনো একটা বিশ্রী গন্ধ লেগে ছিল, যদিও সেখানে প্রচুর পরিমাণে ডিডিটি পাউডার ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রতিবেশীরা জানান, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই সেখান থেকে ২৩ জন নারী ও শিশুর মৃতদেহ সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
পঁচিশ মার্চ থেকে মৃতদেহগুলো ছাদে ছিল। অনেক প্রশ্ন করার পরেই আমি নিশ্চিত হলাম যে, নিহতরা ছিলেন নিকটবর্তী হিন্দু বস্তির বাসিন্দা। সেনাবাহিনীর আক্রমণের সময় এই ভবনটিতে তারা আশ্রয় নিয়েছিল।
অদ্ভুত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পরিচালিত এই গণহত্যা। ১৯ এপ্রিল সকালে কুমিল্লা শহরের সামরিক আইন প্রশাসক মেজর আগার অফিসে বসে দেখেছি কতটা নিঃস্পৃহ ক্রূরতার সাথে সাজার আদেশগুলো দেওয়া হতো।
একজন বিহারী সাব ইন্সপেক্টর পুলিশ লকআপে বন্দিদের তালিকা নিয়ে এসেছিল। আগা তালিকা দেখলেন। তারপর খুব স্বাভাবিকভাবে পেন্সিলের খোঁচায় তালিকার চারটি নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন।
‘সন্ধ্যায় এই চারজনকে নিয়ে আসো’, তিনি বললেন। তালিকার দিকে আরেকবার তাকালেন। পেন্সিলের আরেকটা খোঁচা। ‘… সঙ্গে এই চোরটাকেও নিয়ে এসো।’
কোমল পানীয়ের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড
এক গ্লাস নারকেল দুধের সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়েছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, বন্দিদের মধ্যে দুইজন হিন্দু, তৃতীয়জন ‘ছাত্র’ এবং চতুর্থজন ছিল আওয়ামী লীগের সংগঠক। ‘চোর’টি হলো, সেবাস্তিয়ান নামের একটি ছেলে যে তার হিন্দু বন্ধুর বাড়ির জিনিসপত্তর তার নিজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়েছিল।
সেই সন্ধ্যার পরে আমি তাদেরকে স্বচক্ষে দেখতে পেলাম। মাত্র একটি দড়ি দিয়ে আলগা করে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তাদেরকে সার্কিট হাউস কম্পাউন্ডের রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ৬টার দিকে, কারফিউয়ের খানিক পরে। এক ঝাঁক ময়না পাখি তাদের খেলাধুলার মধ্যে হঠাৎ হাড়-মাংসের সঙ্গে ভারি কাঠের লাঠির (wooden clubs) মিলনের বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
বেলুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমত মেসের আড্ডায় দু’টি বিশেষ কারণে সুপরিচিত ছিলেন। একটি কারণ ছিল, নবম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার, মেজর জেনারেল শওকত রাজার এডিসি হিসেবে তার চাকরি। এবং অন্যটি ছিল সহকর্মীদের র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া। সবাই জানত, দলের ভেতরে আজমতই ছিলেন একমাত্র অফিসার যিনি একটাও ‘হত্যা’ করেন নি। মেজর বশির তাকে নির্দয়ভাবে খোঁচাতেন।
এক রাতে বশির তাকে বললেন, ‘আজমত, এবার তোমাকে সত্যিকারের পুরুষ মানুষ বানিয়েই ছাড়ব। আগামীকাল দেখা যাবে তুমি কিভাবে ওদের হত্যা করো। এটা খুব সহজ একটা কাজ।’
বিষয়টাকে হালকা করতে বশির একটা লম্বা গল্প ফেঁদে বসলেন। এসএসও হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও, বশির ছিলেন হেডকোয়ার্টারের ‘শিক্ষা কর্মকর্তা’। পাঞ্জাবি অফিসারদের মধ্যে একমাত্র তিনিই স্পষ্ট বাংলা বলতে পারতেন। স্বাভাবিক ভাবেই বশিরের নিজের বিরক্তিকর গলার আওয়াজ নিয়ে বেশ গর্ববোধ ছিল।
আমরা শুনেছিলাম, সেদিন সকালে একজন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি তার ভাইয়ের খোঁজ করতে বশিরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। লোকটির ভাই, কুমিল্লার একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ সংগঠক, কয়েকদিন আগেই সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল। বশির তাকে বলেছে: দোওড় গ্যায়া, ‘সে পালিয়ে গেছে।’ বৃদ্ধ লোকটা বুঝতে পারছিল না তার ভাইয়ের পক্ষে কীভাবে ওই ভাঙা পা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমিও বুঝতে পারছিলাম না। মেজর বশির তখন চোখ টিপ্পনী দিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। রেকর্ডে দেখাবে দোওড় গ্যায়া: ‘পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ।’
ক্যাপ্টেন আজমত তার ‘হত্যা’টা করতে পেরেছিলেন কিনা, আমি জানি না।
চট্টগ্রামের ৭০ মাইল উত্তরে কুমিল্লা মহাসড়কে যে বিদ্রোহী বাঙালি বাহিনী (মুক্তি বাহিনী) ফেনীতে ঢুকে পড়েছিল, তারা ওই এলাকার সকল ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে নবম ডিভিশনকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। জেনারেল রাজা ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ডের কাছ থেকে চরম অপদস্থ হয়ে, বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনীর) পালিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত সিল করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে এসে স্তূপ হয়ে থাকা প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতে উত্তরের একমাত্র স্থলপথটি খুলে দেওয়াও অত্যন্ত জরুরি ছিল।
জেনারেল রাজা স্বাভাবিকভাবেই বেশ ধুরন্ধর লোক ছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি ওই এলাকায় উড়ে যেতেন। ফেনীতে আটকে পড়া ব্রিগেডকে তিনি ঘণ্টা ধরে বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতা শোনাতেন। ক্যাপ্টেন আজমত বরাবরের মতোই জেনারেলের সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতেন। তার সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয় নি।
তবে অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করা যায়, আজমতকে আরও তিনটি সপ্তাহ ‘হত্যা’ এবং র্যাগিংয়ের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল ।
৮ মে, নবম ডিভিশন ফেনী ও আশপাশের এলাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বাঙালি বিদ্রোহীরা (মুক্তি বাহিনী), অবিরাম বোমাবর্ষণ এবং আর্টিলারি ব্যারেজের তাড়া খেয়ে নিকটস্থ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অস্ত্রসহ পালিয়ে যায়।
বাঙালী বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনীর) মধ্যে এত বিপুল পরিমাণ সশস্ত্র, সক্রিয়, সুগঠিত যোদ্ধাদের পালিয়ে যাওয়ায় নবম ডিভিশন হেডকোয়ার্টারের জি-১, লে. কর্নেল আসলাম বেগ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতীয়রা নিশ্চয়ই এদেরকে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেবে না। সেটি খুবই বিপজ্জনক হবে। তাই যতক্ষণ এরা সীমান্তের ওপারে ছুটছে, ছুটতে থাকুক। ভুগতে থাকুক। ওদের সবাইকে হত্যা করতে না পারলে, আমাদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য গুরুতর সমস্যায় পড়তে হবে।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ একজন জনপ্রিয় আর্টিলারি অফিসার ছিলেন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে, পাকিস্তান সেনা ইউনিটগুলো যখন চৈনিক সরঞ্জামে সজ্জিত হচ্ছিল তখন তিনি চীনকে স্বল্পপরিমাণ বিনিময় প্রদান করেছিলেন। জানা গেছে, তিনি একজন গর্বিত পারিবারিক মানুষ ছিলেন। তিনি সুস্পষ্ট গর্বের সাথে বলেছিলেন, কুমিল্লায় পূর্ববর্তী পোস্টিংয়ের সময় চীন থেকে তিনি বিশালাকৃতির টকটকে লাল জলপদ্ম নিয়ে এসেছিলেন। হেডকোয়ার্টারের বিপরীত পাশের পুকুরে সেগুলো শোভিত ছিল। মেজর বশির তাকে খুবই পছন্দ করতেন। একজন অফিসার হিসেবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার প্রশংসা করে বশির আমাকে বলেছিলেন, একবার একজন বিদ্রোহী (মুক্তিযোদ্ধা) অফিসার ধরা পড়েছিল। তাকে নিয়ে কী করা উচিত এটা নিয়ে তখন বেশ হট্টগোল শুরু হয়েছিল।
বশির বলেছিলেন, ‘অন্যরা যখন নির্দেশের জন্য টেলিফোন নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তিনি ততক্ষণে সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিলেন। দোওড় গ্যায়া। লোকটির পা’টা কেবল খাদের বাইরে আটকে ছিল।’
বিপুল এই সৌন্দর্যের মাঝে এতটা বর্বরতা কল্পনা করাও কঠিন। এপ্রিলের শেষ দিকে যখন ওখানে গিয়েছিলাম, তখন কুমিল্লা ফুলে ফুলে শোভিত ছিল। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানের গালিচা। হঠাৎ উজ্জ্বল টকটকে লাল রঙের ছিটানো দাগে যেন ভেঙে ভেঙে গেছে। এটা হলো গোল মোহর (কৃষ্ণচূড়া), যাকে যথাযথভাবেই ‘বনের শিখা’ বলা হয়, তখন পরিপূর্ণভাবে ফুটতে শুরু করেছিল। গ্রামাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আম ও নারকেল ফলে ভারি ছিল গাছগুলো। এমনকি ছোট আকৃতির ছাগলগুলোর রাস্তা পেরিয়ে যাওয়াটাও বাংলার প্রাকৃতিক প্রাচুর্যেরই প্রমাণ ছিল। তারা বলেছিল, ‘এগুলোর মাদি এবং মর্দা বোঝার একমাত্র উপায় হলো, সবগুলো মাদি ছাগলই গর্ভবতী।’ (চলবে)
অনুবাদক: লেখক ও সাংবাদিক।