অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস
অনুবাদ: জাহান আরা
[অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। ১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে নৃশংসতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার ওপর ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিজেদের পরিচালিত যুদ্ধের অপারেশন দেখাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁদের একজন। তাঁর এই উদঘাটনমূলক প্রতিবেদন সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ভয়াবহতা দেখে, অ্যান্থনি নিজের হতভম্ব দশা কাটিয়ে উঠে প্রথমে নিজের পরিবার এবং পরবর্তীতে নিজে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘জেনোসাইড’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। ঢাকা থেকে লন্ডনে পালিয়ে একাত্তরের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমস প্রকাশিত এই নিবন্ধের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন আর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে উঠে আসে। প্রতিবেদনটির পূর্ণ বাংলা অনুবাদ অনুস্বরে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। এবারের সংখ্যায় পঞ্চম কিস্তি ছাপা হলো। ]
তাদেরকে অনাহারে মরতে দিন
দিন কয়েক আগে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান, মি. কার্নি তার করাচির বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস কক্ষে বসে এই (সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ) সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘এই দুর্ভিক্ষ এদের (বাঙালিদের) নিজেদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের ফলাফল। এদেরকে মরতে দিন। এরপরে হয়ত তাদের আক্কেল বুদ্ধির উদয় হবে।’
সামরিক সরকারের এই পূর্ব বাংলা নীতি আপাতদৃষ্টিতে এতটাই পরস্পরবিরোধী এবং আত্মপরাজয়মূলক যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে ধারণা করা যেতেই পারে যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না। এ পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে, শক্তি প্রয়োগ করার মতো প্রাথমিক ভুল করার পরে, (পাকিস্তানি) সরকার এখন একগুঁয়েমী এবং নির্বুদ্ধিতা দিয়েই পরিস্থিতি সামলে নিতে চাইছে।
এই ধারণার পেছনে আবছা ধরণের কিছু যুক্তি রয়েছে।
একদিকে এটা সত্যি যে, সন্ত্রাসের রাজত্বে তীব্রতার কোনও ঘাটতি তৈরি হয় নি। পূর্ববাংলাকে অধীনস্থ করার নীতি বেশ জোরালোভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে করে সরকারের বিপক্ষে প্রতিনিয়ত সহস্রাধিক নিত্যনতুন শত্রু তৈরি হচ্ছে এবং পাকিস্তানের দুই শাখার বিচ্ছেদকে আরও সুনিশ্চিত করে তুলছে।
অন্যদিকে, এই নীতির অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতা সম্পর্কে কোনও সরকারের পক্ষেই অজ্ঞ থাকা সম্ভব নয়। (সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে রাখার মতো যথেষ্ট পরিমাণ পশ্চিম পাকিস্তানি জনবল নেই।)
কঠোর প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কারণে, এবং বাইরের দেশসমূহ, বিশেষত আমেরিকা থেকে পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগিতার কথা বিবেচনা করে হলেও, যত দ্রুত সম্ভব এই রাজনৈতিক (সমস্যার) একটি নিষ্পত্তি অর্জন করা প্রয়োজন। ২৫ মে’র প্রেস কনফারেন্স থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত আছেন। তিনি বলেন, জুনের মধ্যভাগের মধ্যেই তিনি প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার বিষয়ে তার পরিকল্পনার ঘোষণা করবেন।
এই সমস্ত কিছুই দিকনির্দেশ করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের ২৪ বছর বয়সের ইতিহাসে ঘটা সবচেয়ে গুরুতর সংকটকে আরও জটিল করার জন্য, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিভ্রান্তিকরভাবে (সমাধানের পথ ছেড়ে) উল্টো পথে এগিয়ে চলেছে।
আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান ঘটনার চেহারাটা মোটামুটি এরকমই। এবং যথেষ্ট পরিমাণে যৌক্তিক দেখা গেলেও এটা কি আদৌ সত্য?
আমার নিজস্ব মতামত হলো, এটা সত্য নয়। আমার দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানি নেতারা পশ্চিমে কী বলে আর প্রাচ্যে কী ঘটায়, সবটাই ব্যক্তিগতভাবে দেখার অভিজ্ঞতা আমার আছে।
আমার ধারণা, বাস্তবে (পাকিস্তান) সরকারের পূর্ববাংলা নীতি বিষয়ে কোনও দ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধ নেই। পূর্ব বাংলাকে (পাকিস্তানের) উপনিবেশ বানানো হচ্ছে।
এটা আমার নিজস্ব খামখেয়ালিপনামূলক কোনও মতামত নয়। ঘটমান ঘটনাবলী থেকেই সবকিছু প্রকাশ পেয়েছে। সেনাবাহিনীর সর্বপ্রথম উদ্দেশ্য, যেটা আগেও প্রথম ছিল এবং এখনও প্রথম হিসেবেই বহাল রয়েছে সেটি হলো, পূর্ব বাংলা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রত্যেক ছিটেফোঁটা চিহ্নকে নিশ্চিহ্ন করা। ২৫ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া ক্রমাগত হত্যাকাণ্ড এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে (পাকিস্তান) সরকার এখন পর্যন্ত যা যা করেছে, তার সবটাই এই উদ্দেশ্যকে বহাল রাখার জন্য। সামরিক নেতৃবৃন্দ ঠাণ্ডা মাথায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, এবং তারা এই (সিদ্ধান্ত) বহাল রেখেই এগিয়ে চলেছেন- সবটাই খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
হত্যাকাণ্ড কি বন্ধ হবে?
সুসংগঠিত হত্যা এবং লুটপাট চলতে থাকা অবস্থায় পূর্ব বাংলায় কোনও অর্থবহ বা কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান করা সম্ভব নয়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: হত্যা কি আদৌ বন্ধ হবে?
১৬ এপ্রিল কুমিল্লায়, নবম ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা প্রথমবার সাক্ষাতের সময় আমাকে সেনাবাহিনীর উত্তরটি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, এমন একটি কঠোর এবং ব্যয়বহুল অপারেশনের দায়িত্ব আমরা এমনি এমনি নেই নি। অর্থ এবং জনবল উভয় ক্ষেত্রেই এটি ব্যয়বহুল। আমরা একটি কাজের দায়িত্ব হাতে নিয়েছি। আমরা কাজটা পুরোপুরি শেষ করব, অর্ধ সমাপ্ত অবস্থায় এটাকে রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দেব না যাতে করে তারা আবার এটাকে এলোমেলো করতে পারে। সেনাবাহিনী প্রতি তিন চার বছর পরপর এখানে এভাবে আসতে পারবে না। তাদের (সেনাবাহিনীর) আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমরা সেখানে (পূর্ব বাংলায়) যেটি করছি সেটি করা হয়ে গেলে পরে আর কখনও এই ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন পড়বে না।’
ফিল্ডের তিনজন বিভাগীয় কমান্ডারের মধ্যকার একজন এই মেজর জেনারেল শওকত রাজা। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে আছেন। না জেনে তিনি কোনও মতামত প্রকাশ করবেন না।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, পূর্ব বাংলায় অবস্থানের দশ দিনে যে ক’জন সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, তাদের সবার কণ্ঠে জেনারেল শওকত রাজার কথাগুলোই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। আর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানেন, সৈন্যদের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিত্বরাই পাকিস্তানের ভাগ্যের মূল নিয়ন্তা (ডি ফ্যাক্টো আর্বিটার)।
সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই সেনাদলের ঐক্যবদ্ধ মানসিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান উপকরণ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যে কোনও নিরিখে, এটি একটি প্রধান উপাদান। কোনও গুরুতর পরিণতি ছাড়াই এটিকে চালু করে আবার বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে, এটি তেমন কোনও হালকা বিষয় নয়।
সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই মৃত এবং আহতের একটি ভীতিজনক সংখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। গোপনে বলা হয়েছিল, ঢাকায় সাধারণ মানুষের তুলনায় অধিক সংখ্যক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন এবং পূর্ব বাংলার হতাহতের তালিকা ইতিমধ্যেই ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে।
সেনাবাহিনী অবশ্যই এই ‘ত্যাগ’কে অলীক রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য ফেলে রাখবে না। যে রাজনৈতিক বিবেচনা কিছুকাল আগেই অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সামরিকভাবে- এবং এখন সৈন্যরাই সিদ্ধান্ত নেবে- (যদিও) এই পর্যায়ে এসে অপারেশন বন্ধ করার ঘোষণা আদৌ প্রতিরক্ষাযোগ্য হবে না। এর অর্থ হবে বাঙালি বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনীর) সাথে আরও সংঘর্ষ। দুই পক্ষ থেকেই অপর পক্ষের প্রতি সম্পূর্ণ ঘৃণার প্রকাশ করা হয়ে গেছে। (এখন আর) কোনও যুদ্ধবিরতি বা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া সম্ভবপর নয়; (এখন) শুধুমাত্র জয় অথবা পরাজয়।
সময় এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে। বিচ্ছিন্ন, সমন্বয়হীন এবং (প্রায়) অস্ত্র-বিহীন বিদ্রোহী দলের (মুক্তি বাহিনীর) পক্ষে নয়। অন্য পরিস্থিতিতে, যখন কোনও দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব থেকে ক্ষমতায় যাওয়া হয়, সেটি অবশ্যই পট পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি যেমনটা দেখা যাচ্ছে তাতে করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য অর্জনে সফলতা লাভের বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এ কারণে হতাহতের বিষয়টি ভাবলেশহীনভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে।
পূর্ব বাংলার অপারেশনে ব্যয় করা বিশাল অংকের টাকা এবং চলমান বিপুল খরচ থেকেও সরকারের দৃঢ় সংকল্পের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন বেপরোয়া ভঙ্গিতে তহবিলে অর্থ ঢেলে দেওয়া হয়েছে এতে করে স্পষ্ট দেখা যায় যে, সামরিক হায়ারার্কি, শক্তি প্রয়োগ করার একটি পূর্ণ পরিকল্পনা মাফিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পরে, এই আর্থিক ব্যয়কে একটি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হিসাবে গ্রহণ করেছে।
বিনা কারণে ২৫ হাজার সৈন্যকে এয়ারলিফট করে পূর্ব বঙ্গে পাঠানো হয় নি। এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়বহুল কাজ। নবম এবং ষষ্ঠদশতম ডিভিশন দুটি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক রিজার্ভ গঠন করেছিল। এখন সেখানে ব্যয়বহুল নতুন রিক্রুটমেন্ট প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
চীনারা সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেছে, যেগুলো কারাকোরাম হাইওয়েতে বন্যা বইয়ে দিয়েছে। এই বন্যা কমে যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে: সম্ভবত চীনারা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে তাদের প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে অন্যভাবে ভাবছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, ইউরোপীয় অস্ত্র সরবরাহকারী দলকে এক মিলিয়নেরও বেশি ডলার মূল্যের গোলাবারুদের মূল্য হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার ঝুলির তলানিতে থাকা নগদ টাকা দিতেও দ্বিধা করে নি।
ঢাকা, রাওয়ালপিন্ডি এবং করাচির ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসারদের সাথে কথোপকথন থেকে জানা যায়, ইস্ট বেঙ্গল অপারেশনের দ্রুত সমাপ্তির মধ্যেই তারা এই সমস্যার সমাধান দেখছেন। (অপারেশন) প্রত্যাহার করার শর্তে (সমাধান) চাইছেন না। সুতরাং এই (অপারেশনের) জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এখন অন্যান্য সকল সরকারি ব্যয়ের তুলনায় অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। উন্নয়ন কার্যত থেমে রয়েছে।
এক বাক্যে, সরকার সামরিকভাবে এতখানি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, তার পক্ষে ইস্ট বেঙ্গল অপারেশন পরিত্যাগ করা সম্ভব নয়। (অথচ) আন্তরিকভাবে রাজনৈতিক সমাধান চাওয়া হলে, সেটিই (অপারেশন পরিত্যাগ) করতে হতো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঘের পিঠে সওয়ারি হয়েছেন। (এমন কিছু করা যা ছেড়ে দেওয়ার চেয়ে চালিয়ে যাওয়া নিরাপদ)। কিন্তু সেখানে তিনি হিসাব করে সিদ্ধান্ত নিয়েই চড়ে বসেছেন। সুতরাং সেনা প্রত্যাহার করা হবে না। ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারে পূর্ব বাংলার (পাকিস্তান) জন্য সরকারের (গৃহীত) নীতি আমাকে বিস্তারিতসহ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। [চলবে।]
অনুবাদক: লেখক ও সাংবাদিক।