অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস
অনুবাদ: জাহান আরা
[অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। ১৩ জুন, ১৯৭১ লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে নৃশংসতম গণহত্যা চালানো হয়েছিল তার ওপর ‘জেনোসাইড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিজেদের পরিচালিত যুদ্ধের অপারেশন দেখাতে কয়েকজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তাঁদের একজন। তাঁর এই উদঘাটনমূলক প্রতিবেদন সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে চলমান ভয়াবহতা দেখে, অ্যান্থনি নিজের হতভম্ব দশা কাটিয়ে উঠে প্রথমে নিজের পরিবার এবং পরবর্তীতে নিজে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ‘জেনোসাইড’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন। ঢাকা থেকে লন্ডনে পালিয়ে একাত্তরের ১৩ জুন লন্ডনের সানডে টাইমস প্রকাশিত এই নিবন্ধের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন আর নিষ্ঠুরতার বিষয়টি বিশ্বের সামনে উঠে আসে। প্রতিবেদনটির পূর্ণ বাংলা অনুবাদ অনুস্বরে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। এবারের সংখ্যায় চতুর্থ কিস্তি ছাপা হলো। ]
[পূর্ব প্রকাশের পর]
তিন রাউন্ড গুলিতে একটা খুন
এই ঢ্যাঙা লম্বা পাঞ্জাবি অফিসার নিজের কাজের বিষয়ে কথা বলতে পছন্দ করতেন। অন্য একটা আয়োজন উপলক্ষে কুমিল্লার সার্কিট হাউসে যাওয়ার পথে ইফতেখার তার শেষ কাজটা নিয়ে কথা বলছিলেন।
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা একটা বুড়োকে পেয়েছিলাম। জারজটা নিজের দাড়ি বড় করে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে নিজেকে জাহির করছিল। এমনকি নিজের নাম বলেছিল, আব্দুল মনান। পরে, আমরা শারীরিক পরীক্ষা নিতেই তার সব জারিজুরি বের হয়ে যায়।’
ইফতেখার বলছিলেন, ‘আমি তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমার লোকেরা বলল, এমন একটা জারজকে তিনটা গুলি করে মারা উচিত। তখন আমি প্রথমে তার অণ্ডকোষে একটা, তারপর তার পেটে একটা গুলি করি। সবশেষে, তার মাথায় একটা গুলি করে ভবলীলা সাঙ্গ করি।’
আমি ফিরে আসার পরে মেজর ইফতেখার উত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা করলেন। তার পরবর্তী মিশন: আরেকটি হত্যা এবং অগ্নিসংযোগের উদ্দেশ্যে।
আতঙ্কিত বাঙালিদের মধ্যে দুটি ধরণ ছিল। এরমধ্যে একটা দল, যারা পালিয়ে যেতে পারে, তারা হঠাৎ করে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনীর উপস্থিতির খবর পেলেই সমস্ত শহর পরিত্যক্ত হয়ে যেত। অপরদিকে, যারা পালাতে পারত না তাদেরকে এমন একটি অবমাননাকর দাসত্ব মেনে নিতে হতো যেখানে তাদেরকে এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থাতেও প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হতে হতো। চাঁদপুর ছিল এর প্রথম উদাহরণ।
অতীতে মেঘনার এই প্রধান নদী বন্দরটি, সমৃদ্ধশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বর্ণিল জীবনযাত্রার জন্য বিখ্যাত ছিল। রাতের বেলায় নদীর কিনারে নোঙর করা হাজার হাজার ছোট দেশী নৌকা দেখে মনে হতো যেন এক আলোকোজ্জ্বল রূপকথার রাজ্য। ১৮ এপ্রিলে চাঁদপুর জনমানবশূন্য হয়ে যায়। কোথাও কোনো মানুষ নেই, নৌকা নেই। মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ সেখানে অবশিষ্ট ছিল। বাকিরা, বিশেষত মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধাংশের সমান হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পালিয়ে গিয়েছিল।
রহস্যজনকভাবে সবগুলো বাড়ি, দোকান এবং ছাদে হাজার হাজার পাকিস্তানি পতাকা টাঙিয়ে রেখে তারা চলে গিয়েছিল। যেন জনমানবহীন কোনো জাতীয় দিবস উদযাপন চলছিল। দৃশ্যটা কেমন যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। পতাকাগুলো মনে হচ্ছিল ক্ষয়ক্ষতির জন্য বীমা (ইনস্যুরেন্স) পলিসির মতো।
সৈন্যরা পাকিস্তানি পতাকাবিহীন যে কোনো কাঠামোকে শত্রুসম্পত্তি মনে করে এবং ধ্বংস করে ফেলে, এমন একটা কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। যতক্ষণ পতাকায় চাঁদ এবং তারা দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ এই পতাকাগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল সেটা বিবেচ্য বিষয় ছিল না। সুতরাং পতাকাগুলো ছিল বিভিন্ন আকার, আকৃতি এবং নানা রকমের ও রঙ বেরঙের । কোনো কোনো পতাকায় সবুজ জমিনের পরিবর্তে উজ্জ্বল নীল রঙের জমিন ছিল। স্পষ্টতই বাংলাদেশের পতাকা তৈরির সব সরঞ্জাম দিয়েই তাড়াহুড়ো করে এগুলোকে তৈরি করা হয়েছিল। তবে, সবুজের চেয়ে নীলরঙা পাকিস্তানি পতাকাই বেশি চোখে পড়ছিল। হাজীগঞ্জ, মাদারফরগঞ্জ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও চাঁদপুরের এই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ছিল; পতাকায় বর্ণিল হওয়া ভৌতিক সব শহর।
লাকসাম, এক ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার উদাহরণ: ধামাধরা
বিদ্রোহীদের (মুক্তিবাহিনী) দখল থেকে মুক্ত করার পরে, সকালবেলায় শহরে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, শহরজুড়ে শুধু সৈনিক আর আক্ষরিক অর্থেই হাজার হাজার পাকিস্তানি পতাকা। ওখানকার মেজর ইনচার্জ স্থানীয় থানায় ক্যাম্প করেছিল, এবং মেজর রাঠোর আমাদের সেখানেই নিয়ে গেলেন। আমার সহকর্মী ছিলেন একজন পাকিস্তানি টিভি ক্যামেরাম্যান। তাকে তখন অনন্তকাল ধরে চলতে থাকা একটি প্রতিদিনের সিরিজ অনুষ্ঠান, যেটাতে কেবল স্বাগত কুচকাওয়াজ এবং ‘শান্তি সম্মেলন’ সম্প্রচার করা হতো, (সেই সিরিজের জন্য) লাকসামের ‘স্বাভাবিকতায় ফিরে আসা’ সম্পর্কে একটি প্রচারমূলক ফিল্ম তৈরি করতে হবে।
একটি ‘কুচকাওয়াজ’ এবং চোখ টিপ্পনী
এটা (সিরিজের জন্য প্রচারণামূলক ফিল্ম তৈরি) কীভাবে সম্ভব হতে পারে ভেবে আমার অবাক লাগছিল কিন্তু মেজর বললেন চিন্তার কোনও কারণ নেই। ‘একটা ভালো অনুষ্ঠান তোলার মতো যথেষ্ট পরিমাণে হারামি লোকজন এখানে উপস্থিত আছে। আমাকে ২০ মিনিট সময় দিন।’
৩৯তম বেলুচ রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট জাভেদকে ভিড় জমায়েত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। জাভেদ একজন বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোককে ডাকলেন। স্পষ্টতই বয়স্ক ব্যক্তিটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল। ব্যক্তিটি, যিনি পরবর্তীতে নিজের নাম মাওলানা সাইদ মোহাম্মদ সাইদুল হক বলে জানিয়ে ছিলেন, জোর দিয়ে বলছিলেন যে তিনি একজন ‘কট্টর মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ নন’ (মুসলিম লীগ ১৯৪৭ সালে একটি স্বাধীন পাকিস্তানের দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল)। লোকটা যে কোনো ভাবে (জাভেদকে) সন্তুষ্ট করতে প্রস্তুত ছিলেন। তিনি জাভেদকে বললেন, ‘আমি ২০ মিনিটের মধ্যে কমপক্ষে ৬০ জনকে উপস্থিত করতে পারব। কিন্তু, আপনি যদি আমাকে দুইটা ঘন্টা সময় দেন তাহলে আমি ২০০ জনকে হাজির করে ফেলব।’
মাওলানা সাইদুল হক তার কথার মতোই কাজের মানুষ ছিলেন। আমাদের কথা মনে করে মেজর আমাদের জন্য নারকেলের দুধ সরবরাহ করেছিলেন। এত সুস্বাদু পানীয় পান করার সুযোগ আমরা খুব কমই পেয়েছি। পানীয় পান করতে করতে আমরা দূর থেকে উচ্চকিত শব্দ শুনতে পেলাম। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ!’ ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ!’ ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ!’ তারা স্তব করে যাচ্ছিল। (জিন্দাবাদ হলো ‘দীর্ঘজীবী’ শব্দের উর্দু ভাষান্তর।)
কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল, প্রায় ৫০ জনের একটি বৃদ্ধ, অথর্ব পুরুষ এবং হাঁটু সমান বাচ্চা মানুষের বিচিত্র দল, সবাই পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ওড়াতে, তাদের গলার সমস্ত জোর দিয়ে চিৎকার করছিল। লেফটেন্যান্ট জাভেদ আমাকে একটা চোখ টিপ্পনী দিলেন।
একটি নব্য গঠিত পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম এবং সম্ভাব্য বক্তাদের সাহায্যে কয়েক মিনিটের মধ্যেই কুচকাওয়াজটি একটি ‘জন সম্মেলন’-এ পরিণত হয়ে গেল।
জনাব মাহবুব-উর-রহমানকে সেনাবাহিনীকে স্বাগত ভাষণ দেওয়ার জন্য এগিয়ে দেওয়া হলো। তিনি এভাবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, ‘এন.এফ. কলেজের ইংরেজি এবং আরবি বিষয়ের অধ্যাপক। যিনি ইতিহাস বিষয়েও অধ্যাপনা লাভের চেষ্টা করেছিলেন এবং মহান মুসলিম লীগ পার্টির আজীবন সদস্য।’
পরিচিতি শেষে মাহবুব-উর-রহমান হঠাৎ করেই দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘পাঞ্জাবি ও বাঙালিরা পাকিস্তান গঠনের জন্য এক জোট হয়েছিল এবং আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু আমরা হিন্দু ও আওয়ামী লীগারদের কারণে আতঙ্কিত হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়েছিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে পাঞ্জাবি সৈন্যরা আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। তারা বিশ্বের সেরা সৈনিক এবং মানবতার মহানায়ক। হৃদয়ের গভীর থেকে আমরা তাদের ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা জানাই।’ তিনি বিরামহীনভাবে, একই কথা, বারংবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে যেতেই থাকলেন। ‘সম্মেলন’-এর পরে আমি মেজরের কাছে তার (মাহবুব-উর-রহমান) এই বক্তৃতা সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, কিন্তু আমি এই হারামিটাকে একটুও বিশ্বাস করি না। আমি ওটাকে আমার তালিকায় রাখব।’
পূর্ব বাংলার ভোগান্তির তখনও শেষ হয় নি। সম্ভবত তুলনামূলক চরম পরিস্থিতির তখনও কিছুটা বাকি ছিল। সেনাবাহিনী, ‘পরিচ্ছন্ন অভিযান’ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিল। তখন পর্যন্ত কেবল অর্ধেকটা কাজ শেষ হয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নবম এবং ষষ্ঠদশতম ডিভিশন দুটোকে বাঙালি বিদ্রোহী (মুক্তিবাহিনীর) এবং হিন্দুদের ‘ছাঁটাই (পড়ুন নির্মূল) করার’ জন্যই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সম্পদের মূল উৎস দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে এটা ছিল যথেষ্ট যৌক্তিক পদক্ষেপ। ২৫,০০০-এরও বেশি মানুষকে পশ্চিম থেকে পূর্বে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। মার্চের ২৮ তারিখে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিশে দুই ডিভিশন সৈন্যকে স্থানান্তরিত হতে বলা হয়েছিল। (প্রথমে) ট্রেনে করে তাদেরকে খারিয়ান ও মুলতান থেকে করাচিতে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে শুধুমাত্র হালকা বেড রোল এবং যুদ্ধের ব্যাগ (তাদের অন্যান্য সরঞ্জাম সমুদ্রপথে বহন করা হচ্ছিল) নিয়ে, (পরবর্তীতে) জাতীয় বিমান সংস্থা পিআইএর (পাকিস্তান বিমান বাহিনী) মাধ্যমে সৈন্যদের ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। সাতটি বোয়িংয়ের এই বিশাল বহরকে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট রুট থেকে সরিয়ে নিয়ে দীর্ঘ যাত্রাপথে (সিলন হয়ে) টানা ১৪ দিন ধরে উড়িয়ে আনা হয়েছিল। বিমান বাহিনীর মাত্র কয়েকটি পরিবহণ বিমান এই কাজে সহযোগিতা করেছিল।
ইস্টার্ন কমান্ড গঠনকারী ১৪তম ডিভিশন থেকে সরঞ্জাম সংগ্রহ করে সৈন্যদল অবিলম্বে অ্যাকশনে নেমে পড়ে। বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনীর) চলাচল এবং সরবরাহর জোগান বন্ধ করতে, কুমিল্লা থেকে পরিচালিত ৯ম ডিভিশনকে পূর্বের সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
১৬তম ডিভিশন, যশোর সদর দপ্তরে, (এবং) প্রদেশের পশ্চিম সেক্টরেও অনুরূপ কাজ করেছিল। তারা মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নির্ধারিত কাজগুলো সম্পন্ন করে। দুইটি ডিভিশনের সৈন্যরা (দুই দিক থেকে) নিরলস চিরুনি অভিযান করে কাছাকাছি হতে শুরু করেছিল। বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনীর) মধ্যে যারা ভারত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় নি তাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছিল। এর অর্থ হলো, সীমান্ত এলাকার সন্ত্রাস এখন জেলা, দেশের সর্বত্র এবং মধ্যভাগেও ছড়িয়ে পড়বে। এটা আরও বেশি যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। তালিকাভুক্ত মানুষগুলোর পালানোর কোনও উপায় থাকবে না।
নবম ডিভিশনের ফুলপ্রেমী লেফটেন্যান্ট কর্নেল বেগ এপ্রিলের ২০ তারিখে ভেবেছিলেন যে, চিরুনি অভিযান দুই মাসের মতো সময়ে শেষ করে ফেলা যাবে, জুনের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু মনে হচ্ছে, তার এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেনাবাহিনী যত সহজে বিদ্রোহী বাহিনীকে (মুক্তিবাহিনী) দমন করা যাবে বলে আশা করেছিল, গেরিলা কৌশল অবলম্বন করার কারণে তাদেরকে তত সহজে দমন করা যায় নি। সেনাবাহিনীর চলাচলের জন্য রাস্তা এবং রেলপথ অত্যাবশ্যকীয় ছিল। বিচ্ছিন্ন এবং স্পষ্টত সমন্বয়হীন বিদ্রোহীরা (মুক্তি বাহিনী), বহু রাস্তা ও রেলপথের পরিকল্পিত ধ্বংসের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আটকে রেখেছিল। যাদের মধ্যে এই নবম ডিভিশনটি নিদারুণভাবে নির্দিষ্ট সময়সীমা থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। বর্ষাকালও এখন বৃষ্টি দিয়ে তিন মাসের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে।
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, বর্ষা মৌসুমের জন্য পাকিস্তান সরকার, চীনের কাছ থেকে নদীতে চলাচল উপযোগী নয়টি শ্যালো ড্রট গানবোট পেয়েছে। পরে আরো পাওয়া যাবে।
ভয়াবহ গুলি বর্ষণকারী এই ৮০ টনি গানবোটগুলো, বিমান বাহিনী এবং আর্টিলারির কিছু দায়িত্ব সামলাবে, যা বৃষ্টি নামলে খুব একটা কার্যকরী হবে না। এগুলোকে সাহায্য করার জন্য কয়েক শতাধিক দেশী নৌযান ব্যবহারের অনুরোধ ওপর মহলে পেশ করা হয়েছে এবং গানবোটগুলোয় আউটবোর্ড মোটর যুক্ত করে সামরিক ব্যবহারের উপযোগী করে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সৈন্যরা পানিতে তাড়া করে হলেও, বিদ্রোহীদের (মুক্তি বাহিনী) ধরতে চায়।
বিলিবণ্টন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে সেখানে এখন দুর্ভিক্ষ হওয়ারও একটা স্পষ্ট সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ২৩টি জেলার মধ্যে সতেরোটিতে সাধারণত সবসময়ই খাদ্যের অভাব থাকে এবং ব্যাপক পরিমাণে চাল ও গম আমদানি করে সেখানে সরবরাহ করতে হয়। গৃহযুদ্ধের কারণে এ বছর সেটা করা সম্ভব হবে না। রাস্তাঘাট চলাচলের অনুপযোগী করার প্রয়োজনে ছয়টি প্রধান সেতু এবং হাজার হাজার ছোট সেতু ধ্বংস করা হয়েছিল। রেল ব্যবস্থাকেও একইভাবে ব্যাহত করা হয়েছিল। যদিও সরকার এটিকে ‘প্রায় স্বাভাবিক’ পরিস্থিতি বলে দাবি করছে।
মে মাসের ৭ তারিখ পর্যন্ত, প্রধান সড়ক ও রেল জংশন, ফেনী দখল করে রাখা বিদ্রোহীরা (মুক্তি বাহিনী) চট্টগ্রাম বন্দর ও উত্তরাঞ্চলের মধ্যবর্তী সড়ক ও রেলপথ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে ফেলেছিল। এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণে খাদ্য মজুত স্থানান্তর করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মাত্র ১৫% খাদ্য নৌকায় করে স্থানান্তরিত করা হতো। বাকি ৮৫% খাদ্য সড়ক ও রেলপথে স্থানান্তরিত করা হতো। এখন যদি নদীপথে চলাচলের মাত্রা ১০০%ও বৃদ্ধি করা হয়, তাহলেও ৭০% খাদ্য চট্টগ্রামের গুদামে মজুত থেকে যাবে।
এখানে অন্যান্য দুটো কারণ যোগ করা প্রয়োজনে। একটি হলো, দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পেতে শুরু করেছে এমন লোকেদের বড় আকারের শস্য মজুত করণ। এতে যে কোনও শক্ত অবস্থানও ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যটি হলো, পাকিস্তান সরকার দুর্ভিক্ষের খবর প্রচার করে বিপদে পড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পূর্ব বাংলার সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, ১৮ এপ্রিল একটি রেডিও সম্প্রচার অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি খাদ্য সরবরাহ নিয়ে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
তখন থেকেই খাদ্য ঘাটতির এই বাস্তবতাকে চেপে রাখার জন্য সমস্ত সরকারি কলকব্জা (পদক্ষেপ) ব্যবহার করা হচ্ছিল। কারণ হলো, এই দুর্ভিক্ষে, কিছুকাল আগে ঘটে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মতোই (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) এর কারণে, প্রচুর পরিমাণে বিদেশী সাহায্য আসার সম্ভাবনা রয়েছে, এবং এই বিদেশী সাহায্যের সাথে বিতরণ পদ্ধতি পরিদর্শনের সম্ভাবনাও প্রচুর। এতে করে বিশ্ববাসীর কাছ থেকে গণহত্যার মাত্রা লুকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। সুতরাং, পরিচ্ছন্নতা অভিযান সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুধার্তদেরকে মরতে হবে। [চলবে]
অনুবাদক: লেখক ও সাংবাদিক।