এক সময় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ছিল মসজিদের নগরী। ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টেছে। দেশটাই হয়ে গেছে এখন মসজিদের। রাজশাহী নগরীতে আমার বাড়ীর চারপাশে ৫/৬ টা মসজিদ। ঘুমাতে যত রাতই হোক সকালে আজানে ঘুম ভাঙবেই। করোনাকালে এর সাথে যুক্ত হয়েছে শোক সংবাদ। এমন দিন কমই আছে যেদিন শোক সংবাদে পরিচিত-অপরিচিত ব্যক্তির মৃত্যুর কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা মাসে ৪শ’ ছাড়িয়ে গেছে। হাসপাতালের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে রোগী বেশি হওয়ায় গুরুতর না হলে করোনা আক্রান্তদেরও ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে! ফলে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া অবাধ হয়ে গেছে।
করোনা রোগীদের বিচ্ছিন্ন রেখে সুচিকিৎসার সুযোগ খুব কম বাসাবাড়িতেই আছে। আক্রান্তদের দেখভাল ও সহানুভূতি জানাতে আমাদের কাছ থেকে সাবধানতা ও সচেতনতার আশা কে-ই বা করে। আর গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের রুজি-রোজগারের প্রশ্নটা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে পরীক্ষা করাতেও চায় না অনেকে। চিকিত্সা তো সাধ্যের বাইরে। হাসপাতালেও ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগীদের মেঝে বারান্দায় রাখা এবং দেখা শোনায় স্বজনদের ভিড়ও স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চিকিত্সক, সেবিকা ও সহায়তাকারীদের সংখ্যাল্পতায় এছাড়া বিকল্পই বা কি!
শুরুতে করোনা আক্রান্তরা ছিল রাজধানী ও শহরকেন্দ্রীক। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলেও। বিশেষ করে ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রাদুর্ভাব সীমান্ত জেলাগুলির অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে বেশ দ্রুত। করোনা উপসর্গ এখনও উপেক্ষিত হওয়ায় গুরুতর না হলে রোগীকে হাসপাতালে আনাই হয় না। তারপর হাসপাতালে আনার পরও আইসিইউ বেড ও অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু বেড়েছে। হৃদয়বিদারক মৃত্যুর ঘটনায় পত্রিকার পাতা ভরা থাকে প্রায়ই।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এখন কষ্টসাধ্য হলেও শুরুতে সহজই ছিল। অতিমারি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গোড়াতেই গলদ থাকার কথা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও। করোনা পরীক্ষার অবাধ ব্যবস্থা, আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন রেখে সুচিকিৎসা যাতে সংক্রমণ না ঘটে এবং মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করা যায়নি। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে এমন ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যে ধরনের সক্ষমতা, পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার তার কিছুরই দেখা মেলে নি। দেড় বছরেও এমন অবস্থা হতাশাজনক ছাড়া আর কি!
সীমান্ত জেলা হলেও রাজশাহীকে পদ্মা নদী কিছুটা রক্ষা করেছে। পাশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার দীর্ঘ সীমান্ত চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য হওয়ায় ভারতীয় অতি সংক্রমণপ্রবণ ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রকোপ বেড়েছে। সোনামসজিদ স্থল বন্দরের কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দ্রুত। গত এপ্রিল- মে মাসে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন আরোপ করা হয় জেলা জুড়েই। রাজশাহীতে বসবাসকারী চাঁপাই অধিবাসী ও রামেক হাসপাতালের কারণে করোনা রোগীদের সাথে তাদের স্বজনদের আগমনও বেড়ে যায়। বিপদ আঁচ করে রাজশাহীতেও লকডাউন ঘোষণার দাবি উপেক্ষা করে স্থানীয় প্রশাসন আম ব্যবসার অজুহাতে। ফলে রাজশাহীতেও ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রকোপ ভয়াবহ হয়ে ওঠা ঠেকানো যায় নি। যা এখনও অব্যাহত আছে। কিন্তু চাঁপাইয়ের পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। কারণ সেখানে ব্যতিক্রমধর্মী পদক্ষেপ নেয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী উপজেলা শিবগঞ্জ ছিল করোনার হটস্পট। সেখানকার চিকিৎসক সংসদ সদস্য পরিস্থিতি বুঝে ফিল্ড হাসপাতালের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় ছাত্র ও অন্যান্য সমাজশক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামে গ্রামে অভিযান চালায়। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টার ফল পেতে দেরি হয় নি। সীমাবদ্ধতার কারণে যখন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খায় তখন এ ধরনের যুদ্ধকালীন পদক্ষেপই যে ফলদায়ক সেটা চাঁপাইয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে। দেশের আরও কয়েক স্থানে এমন পদক্ষেপে সুফল পাওয়া গেলেও কেন সর্বত্র নেয়া হলো না সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ফলে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতেই রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণ ছাড়িয়েছে ৭০ হাজার এবং প্রাণহানি ছাড়িয়েছে ১ হাজারের বেশি।
অভিজ্ঞতা গুরুত্ব না দেয়ার পাশাপাশি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়েও উপেক্ষার নজির সৃষ্টি হয়েছে। দিন আনে দিন খায় এমন গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষদের ঘরে থাকার জন্য ন্যূনতম সহায়তা নিশ্চিত না করেই একের পর এক লকডাউন আর কঠোর বিধি নিষেধের ঘোষণা তাদের কাছে মোটেই গুরুত্ব পায় নি। প্রশাসনিক ও দলীয়ভাবে সহায়তা দেয়া হলেও তা যে যথাযথভাবে বিতরণ হয়েছে সেটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও জনপ্রতিনিধিদের কাজে লাগানোর প্রয়োজন বোধই করেনি কেন্দ্রীয় প্রশাসন। করোনা নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে প্রশাসন নির্ভর হয়ে পড়ায় তার প্রতি মানুষের আস্থা থাকেনি। এই আস্থাহীনতা যে শাসকদের প্রতিই সেটাও এখন আর গোপন থাকছে না। শুধু শাসকদেরই নয়, সরকার ব্যবস্থার প্রতিটি মানুষ হতাশ হয়ে পড়েছে।
ফলে সরকারের করোনা মোকাবিলার পদক্ষেপ অন্যান্য অনেক কিছুর মতই অকার্যকর হয়ে উঠেছে। কঠোর লকডাউনেও বিধিনিষেধ উপেক্ষার যে চিত্র সংবাদ মাধ্যমে ফলাও প্রচার হচ্ছে তাকে এক কথায় গণঅবাধ্যতা বলা যায়। এই অবাধ্যতা কি শুধু প্রশাসন বা বর্তমান শাসকদের প্রতি? মনে হয় না। বিদ্যমান সরকার ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কাঠামোই আজ হতাশার বিষয় হয়ে উঠেছে যা গণমানুষের প্রয়োজনকে অস্বীকার করে। উল্টো তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করে। এই বাস্তবতা বুঝতে না চাওয়াতেই মানুষের ‘অসচেতনতাকে’ দায়ী করে নিজেদের দায় এড়াতে কেউই পিছিয়ে থাকছে না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখন পরীক্ষা ও টিকা দান গুরুত্ব পেলেও ঈদের শিথিলতা সামাল দেয়া কতটা সম্ভব হবে তা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছেন না। মানুষের অবাধ্যতাই বা কোন পর্যায়ে যাবে তারও নিশ্চয়তা নেই। অনিশ্চয়তাই এখন বাংলাদেশে স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে!
রাজশাহী, ২০.০৭.২০২১
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সোনালী সংবাদ