ঠিক এগারো বছর আগে মে মাসের ২ তারিখ। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। সেদিন দুপুরে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা হোয়াইট হাউজে আসতে শুরু করলেন। এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও। হিলারি ক্লিনটনের গাড়িটা সবসময় ওয়েস্ট উইংয়ে পার্ক করে রাখা হতো। সবার নজর এড়াতে সেদিন সেখানে না রেখে আড়ালে রাখা হলো।
অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেন তখন আফগানিস্তানের জালালাবাদ শহরে ছিলেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি টিম হোয়াইট হাউজেই একটা যোগাযোগ কেন্দ্র তৈরি করেছিল। তার মাধ্যমে অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল। ওই যোগাযোগ কেন্দ্রটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘সিচুয়েশন রুম’। সিচুয়েশন রুমের সঙ্গে সিআইএর সদর দপ্তর আর পেন্টাগনের অপারেশনস্ সেন্টারের ভিডিও সংযোগ করা হয়েছিল। সিচুয়েশন রুমে জেনারেল জেমস কার্টরাইট সকল ভিডিওর ওপর নজর রাখছিলেন।
পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে সেসময় রাত এগারোটা বেজেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সময় দুপুর ১টা ২২ মিনিটে সিআইএর প্রধান লিওন প্যানেটা অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেনকে আদেশ দিলেন, ‘গো ইন দেয়ার অ্যান্ড গেট বিন লাদেন’।
পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৩০ মিনিট। জালালাবাদ শহরে তখন বাজছে রাত সাড়ে ১০টা। ওসামা বিন লাদেনের পুরো পরিবার তখন শুয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর সীল দলের ২৩ জন সদস্য দুটা ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারে চড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। নৌবাহিনীর এই দলে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক দোভাষীও ছিলেন। দলে একটা কুকুরও ছিল। কুকুরটিকেও সীল টিমের মতো করে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পড়ানো হলো।
আধঘণ্টা পর আফগানিস্তান সময় রাত ১১টায় দুটা ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার জালালাবাদ বিমানঘাঁটি থেকে পূর্ব দিকে পাকিস্তানের সীমানার দিকে রওনা হলো।
ওসামা বিন লাদেনের ওপরে লেখা বই ‘ম্যানহান্ট: দ্য টেন-ইয়ার সার্চ ফর বিন লাদেন ফ্রম ৯/১১ টু অ্যাবোটাবাদ’-এর লেখক পিটার এল. ব্যার্গেন লিখেছেন, ‘ওই দুটা হেলিকপ্টার থেকে খুব কম মাত্রায় তাপ বেরুচ্ছিল, আর ওই দুটোর লেজে যে ব্লেড ছিল সেগুলোও এমনভাবে তৈরি যাতে খুব কম শব্দ হয়। পাকিস্তানি রাডার যেন হেলিকপ্টার দুটার অবস্থান ধরতে না পারে, সেজন্যই ওই সতর্কতা।’
‘ন্যাপ অব দ্য আর্থ’ ফরমেশনে, অর্থাৎ মাটির থেকে সামান্য কয়েক ফিট ওপর দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে হেলিকপ্টার দুটো উড়ছিল। পাকিস্তানের সীমানা পেরুনোর পর হেলিকপ্টার দুটা পেশোয়ার থেকে উত্তর দিকে ঘুরে যায়। অ্যাবোটাবাদে পৌঁছতে সময় লেগেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা।
‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ ২০১১ সালের ৮ আগস্ট বিন লাদেনের ওপরে ‘গেটিং বিন লাদেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে নিকোলস শিমিডল লিখেছেন, ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার দুটো উড়ে যাওয়ার ৪৫ মিনিট পরে ওই রানওয়ে থেকেই চারটে চিনুক হেলিকপ্টার উড়েছিল। দুটো হেলিকপ্টার পাকিস্তানের সীমানা পার হয়ে গিয়েছিল। বাকি দুটো সীমানার পাশেই অবতরণ করেছিল।
এই চারটি হেলিকপ্টার পাঠানোর সিদ্ধান্তটা একেবারে শেষ মুহূর্তে নেওয়া হয়েছিল। কেননা প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চেয়েছিলেন গোটা অপারেশনটা যদি তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী না হয়, তবুও যেন আমেরিকান সৈনিকরা লড়াই করতে করতে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়তে পারে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যদি অপারেশনটা বড় কোনও ঝামেলায় পড়ে যায় তাহলে এই চারটি হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হবে।
নিকোলস শিমিডল লিখেছেন, পাকিস্তানে নামার পরও হেলিকপ্টারগুলোর ইঞ্জিন বন্ধ করা হয় নি। অপেক্ষা করার সময়ও সেগুলোর ব্লেডগুলো ঘুরছিল যেন প্রয়োজন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেগুলো আকাশে উড়তে পারে।
উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারগুলো অ্যাবোটাবাদে ঢুকে পড়ে। কিন্তু যখনই পাইলট বিন লাদেনের বাসভবনের সামনে অবতরণ করার চেষ্টা করছিলেন, তখনই নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন তিনি। খুব দ্রুত নীচের দিকে নেমে আসছিল হেলিকপ্টারটা।
আসলে, সীল টিম যখন আমেরিকায় এই মিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ক¤পাউন্ডের চারদিকের দেয়াল লোহা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু বিন লাদেনের আসল বাড়ির চারদিকের দেয়ালটা ছিল কংক্রিটের। সেকারণে হেলিকপ্টারের লেজটা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ঘুরন্ত ব্লেডটা ভেঙে যায়। পাইলট অভিজ্ঞ ছিলেন বলে বেশ কায়দা করে হেলিকপ্টারটাকে নীচে নামিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা আর ওড়বার মতো অবস্থায় ছিল না। যদিও কোনও প্রাণহানি ঘটে নি।
ওদিকে অপারেশনের পুরো দৃশ্য তখন হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে বসে দেখছিলেন সবাই। বিন লাদেনের বাসভবনের ওপরে ঘুরতে থাকা একটা ড্রোন পুরো ঘটনার ভিডিও চিত্র হোয়াইট হাউজে পাঠাচ্ছিল।
অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেন খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে সিআইএ প্রধান প্যানেটাকে বললেন, ‘ডিরেক্টর, আপনি যেমনটা দেখছেন, আমাদের একটা হেলিকপ্টার ওই বাড়ির উঠানে ভেঙে পড়েছে। সেকারণে মিশনে সামান্য পরিবর্তন করতে হচ্ছে। আমার ছেলেরা এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই তৈরি। ওরা জানে ওদের কী করতে হবে।’
অন্য ব্ল্যাক হকের পাইলট ওপর থেকেই একটা হেলিকপ্টার ভেঙে পড়তে দেখেছিলেন। অনুযায়ী দ্বিতীয় হেলিকপ্টারটি লাদেনের শোয়ার ঘরের ছাদের ওপরে ঘোরার কথা ছিল। সেখান থেকে দড়ি বেয়ে কয়েকজন সীল নীচে নেমে ঘুমিয়ে থাকা বিন লাদেনকে আচমকা ধরে ফেলতে পারবে। কিন্তু নীচের অবস্থা দেখে পাইলট হেলিকপ্টারটিকে তিনি উঠানের বাইরে ক্ষেতের মধ্যে নামালেন। উঠানের চারদিকে নজর রাখার জন্য সীল সদস্যদের একটা ছোট দল, দোভাষী আর কুকুরটি ছিল পাহারায়। কুকুরটিকে এই অপারেশনে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল বেশিরভাগ মুসলমান কুকুরকে অপবিত্র বলে মনে করে এর থেকে দূরে থাকেন।
ওদিকে বাড়ির দোতলায় বিন লাদেন নিজের শোবার ঘরেরই নিরাপত্তা ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। ঘরের ভেতরটা বাইরে থেকে যেন কোনও ভাবেই না দেখা যায়, সেজন্য জানালা রাখা হয় নি বললেই চলে। কিন্তু এই ব্যবস্থা করতে গিয়ে বাইরে কী ঘটছে সেটা তিনি নিজেও দেখতে পেতেন না।
দোতলায় ওঠার সময় সীল টিমের সদস্যরা লাদেনের ২৩ বছর বয়সি ছেলে খালিদকে দেখতে পায়। তাকে সিঁড়িতেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
পিটার ব্যার্গেন লিখছেন, ‘লাদেনের শোওয়ার ঘরে একটা তাকের ওপরে কয়েকটা একে-ফরটি সেভেন ও ম্যাকারোভ পিস্তল রাখা ছিল। কিন্তু বিন লাদেন সেদিকে না গিয়ে আগে লোহার দরজা খুলে দেখতে চেষ্টা করেছিলেন বাইরে কীসের শোরগোল হচ্ছে। একজন সীল সদস্য লাদেনকে দেখে ফেলেন। তিনি সিঁড়ি দিয়ে উঠে লাদেনের দিকে ধাওয়া করেন। মুহূর্তের মধ্যেই লাদেন ঘুরে গেলেন এবং তখনই বড় ভুলটি করলেন। লোহার দরজাটি বন্ধ করলেন না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওই সীল সদস্য ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। লাদেনের স্ত্রী আমাল আরবি ভাষায় চিৎকার করে কিছু একটা বলে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
আরেকজন সীল সদস্য আমালের গোড়ালিতে গুলি করলেন। ওসামা বিন লাদেন কোনও প্রতিরোধ করেন নি। একজন সীল সদস্য তার ওপরে ডাবল ট্যাপ শট চালান। বিন লাদেনের বুক আর বাঁ চোখে গুলি লাগে।
নিকোলাস শিমিডল লিখেছেন, ‘একজন স্পেশাল অপারেশনস অফিসার আমাকে বলেছিলেন, বিন লাদেনকে জীবন্ত ধরা অথবা নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই তাদের ছিল না। লাদেনকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্তটা ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে নেওয়া হয় নি। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে আমেরিকান প্রশাসন ভেবে রেখেছিল যদি লাদেন প্রথমেই আত্মসমর্পণ করতেন, তাহলে তার ওপরে গুলি চালানো হতো না।’
ওদিকে ঘটনাস্থল থেকে আসা অডিও ফিডে শুনলেন অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেন সীল দলের সদস্যরা বলছে ‘জেরোনিমো’। এই কোড অপারেশন সফল হলে ব্যবহার করার কথা ছিল। অ্যাডমিরাল সঙ্গে সঙ্গে হোয়াইট হাউজকে জানালেন। কিন্তু তখনও বোঝা যাচ্ছিল না যে বিন লাদেন জীবিত না মৃত। ম্যাকরাভেন সীল দলের প্রধানের কাছে জানতে চাইলেন, ‘ইজ হি এ-কি-য়া (এনেমি কিল্ড ইন অ্যাকশন)?’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উত্তর এল ‘রজার। জেরোনিমো এ-কি-য়া।’ অ্যাডমিরাল সঙ্গে সঙ্গেই হোয়াইট হাউজকে সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
শুনে প্রেসিডেন্ট ওবামা বললেন, ‘উই গট হিম … উই গট হিম!’
ওদিকে সীল টিমের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তখনও বাকি ছিল। ভেঙে পড়া হেলিকপ্টারটাকে নষ্ট করে দিতে হবে যেন পাকিস্তানিরা ওটাতে ব্যবহার করা প্রযুক্তি ধরতে না পারে। একই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখোমুখি না হয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় সে দেশের সীমানা পার হওয়াটাও জরুরি।
পাকিস্তান অবশ্য দুটো এফ-১৬ বিমান পাঠিয়েছিল হেলিকপ্টারগুলোকে ধাওয়া করতে। কিন্তু মাইকেল লিটর জানতেন সেগুলো কিছু করতে পারবে না। পাকিস্তানের পাইলটদের রাতে বিমান চালানোর অভ্যাস খুব একটা নেই।
পিটার এল. ব্যার্গেন তার বইয়ে লিখেছেন, ‘সীল টিমের সদস্যরা বিন লাদেনের মৃতদেহ সিঁড়ি দিয়ে টেনেহিঁচড়ে নীচে নামিয়ে আনেন। পুরো সিঁড়ি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাকি সীল কমান্ডোরা বিন লাদেনের বাসভবনের ক¤িপউটার, মোবাইল ফোন আর হার্ড ডিস্কগুলো একত্র করছিল যেন সেগুলো পরীক্ষা করে আল কায়েদার কার্যপ্রণালী, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা – এসব জানা যায়।’
লাদেনের মৃতদেহটা হেলিকপ্টারে শুইয়ে রাখা হলো। একজন সীল সদস্য লাদেনের ছবি তুলে পাঠালেন। চেহারা শনাক্ত করতে দুজন বিশেষজ্ঞ তখন ওয়াশিংটনে অপেক্ষা করছিলেন। তারা পুরনো ছবির সঙ্গে বিন লাদেনের চেহারা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা পরে বলেছিলেন, বিন লাদেনের ঘরে যে সময়টুকু সীল কমান্ডোরা ছিল সেটিই তাঁর জীবনের দীর্ঘতম ৪০ মিনিট।
স্থানীয় সময় রাত দুটায় অর্থাৎ আমেরিকার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় জালালাবাদ বিমানঘাঁটিতে হেলিকপ্টারগুলো ফিরে আসে। সম্পূর্ণ অপারেশনটা চালাতে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। ফেরার পর আফগানিস্তানে সিআইএর স্টেশন চিফ এবং অ্যাডমিরাল ম্যাকরাভেন লাদেনের মৃতদেহটা পরীক্ষা করলেন।
তাদের কাছে তখন উচ্চতা মাপার কোনও ফিতে ছিল না বলে দেহের উচ্চতা মাপা যাচ্ছিল না। তখন উচ্চতা মেপে নিশ্চিত হতে লাদেনের ছয় ফুট চার ইঞ্চি শরীরের সমান লম্বা এক আমেরিকান সৈন্যকে মৃতদেহের পাশে শোয়ানো হলো। উচ্চতা মিলে যাওয়ার পরই সকলে নিশ্চিত হলেন, এই মৃতদেহটা ওসামা বিন লাদেনেরই। এরপর হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে উপস্থিত সকলকে লাদেনের ছবি দেখানো হলো।
পরে জেনারেল ক্লিপার বলেছিলেন, ‘ছবিটা খুবই বীভৎস ছিল। কিন্তু আমাদের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না যে ওটা ওসামা বিন লাদেনই ছিল।’
লেখক: সাংবাদিক।