১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। আর আমি তখন ঢাকায় থাকতাম না। আমি তখন পাবনায় থাকি। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলতে যা বোঝায়, সেটা কিন্তু আমার নেই। কিন্তু একটা ঘটনা, যেটা এখনো আমাকে রীতিমতো চমকে দেয় মাঝেমধ্যেই। সেটা হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির সম্ভবত বিকেলের দিকে সোনারগাঁ ঢাকায় গোলাগুলি হয়েছে। ছাত্ররা মারা গেছে। কেন? কোন বিষয়ে তারা মারা গেছে? রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই— এ দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্ররা মারা গেছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের কথা শুনেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কথা শুনি নি। তারা মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল, এ সময় গুলি করা হয়েছে। তখন ছাত্ররা মারা গেছে। ঘটনাটা হচ্ছে আমার ক্লাস ফাইভে পড়া অবস্থায়, তখন আমার বয়স হচ্ছে ১১। সে সময় তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি আমার। কিন্তু যে প্রতিক্রিয়া আমার মায়ের মধ্যে দেখেছিলাম, সেটা আমার পরবর্তীকালে শুধু ভাবায়ই নি, আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করেছিল। কারণ, আমার মা গ্রামের মেয়ে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিলেন। অথচ ওই মানুষটার ভেতরে এই প্রতিক্রিয়া কেন হলো, সেটি পরবর্তীকালে আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এটাই তো একুশের চেতনা।
ঘটনাটি যখন মা শুনলেন যে একটা ছেলের মাথায় গুলি লেগে খুলি উড়ে গিয়ে ঘিলু রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে; ছেলেটির নাম মোহাম্মদ রফিক, তারই মাথায় গুলি লেগেছিল— এ কথাটা যখন মা শুনলেন তখন মা আমাদের বাড়িতে কলপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘটনাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তারপরে নুরুল আমিনকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছেন আর উঠানের ওপরে দমাদম লাথি মারছেন। লাথি মারছেন গালাগাল করছেন, গালাগাল করছেন লাথি মারছেন। এর পরে ওই অবস্থায় অজু করে ওই মৃত ছেলেটির জন্য তিনি নফল নামাজ পড়তে বসলেন। পরবর্তীকালে আমার কাছে যে জিনিসটা মনে হয়েছে যে ওই ছেলেটি মায়ের কে হয়? কোথাকার কে? আমরা কেউই জানি না, অচেনা-অজানা একটি ছেলে মারা গেছে, তার জন্য মায়ের ওই প্রতিক্রিয়া। যেটা নিয়ে আমি পরে একটা গল্পও লিখেছি গর্ভধারণী নামে।
পরবর্তীকালে আমি বুঝতে পারলাম এবং আমার এই বিশ্বাসটাই জন্মাল যে এইটাই ‘একুশের চেতনা’। এই এক একটা ঘটনাই সমস্ত মানুষকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। একুশের ওই মৃত্যুতে যেসব প্রতিক্রিয়া হয় মানুষের মধ্যে, তা প্রতিটি চেতনার বিষয়। যেখানে বোঝা যাচ্ছে, আমার মুখের ভাষাটা আমাকে আর ব্যবহার করতে দেবে না। আমাদের কোনো কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকবে না। সেখানে এ প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং এটার জন্যই এই প্রতিক্রিয়া তীব্র থেকে তীব্র হলো।
এর পর আমাদের দেশের যেসব সংগ্রামী আন্দোলন হলো, প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই। ঘটনার ধারাবাহিকতা তো তাই বলে। একুশে ফেব্র“য়ারির ওই ঘটনার পর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রতিবাদ এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ, এটার সবই কিন্তু একুশের ধারাবাহিকতাতেই হয়েছে। তোমাদের (পাকিস্তান) অধীনে থাকা মানেই আমাদের মৃত্যুবরণ করাÑ এটাই গ্রামের মেয়ে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া আমার মা তাঁর ভেতরে যে ঐকিক বোধটা কাজ করেছিল, যে আমার ভাষা আর আমার থাকবে না। তার পরে আমার ভাষার জন্য একটা সন্তান মারা গেল। সে নিজের সন্তান কি অন্যের সন্তান, সেটা বড় কথা নয়। সন্তানতুল্য যে একজন মারা গেল, সেইটাই আমার মায়ের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। যেটা আমার ছেলেবেলার অভিজ্ঞতায় এখনো মনে জ্বলজ্বল করছে যে কোথাকার কে একজন মারা গেল, তার জন্য মায়ের এই প্রতিক্রিয়া হলো। এটাই আমার কাছে একুশের বিশাল চেতনা বলে মনে হয়।❐
বর্তমান রচনাটি প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দারের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রকাশ করা হলো।