একাত্তরের পহেলা মার্চ, সোমবার।
দৌলতপুর বিএল কলেজে অনার্স পরীক্ষা চলছে। তখন বেলা ১টা। অধ্যক্ষ এমবি চৌধুরী পরীক্ষা চলাকালীন ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি স.ম. বাবর আলীকে অবহিত করেন, প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদে ঢাকা অধিবেশন স্থগিত করেছেন। অপ্রত্যাশিত একথা শুনে ছাত্ররা কেউ কেউ পরীক্ষার উত্তরপত্র ছিঁড়ে ফেলেন। পরীক্ষার হল ত্যাগ করে তারা জঙ্গি মিছিল নিয়ে শহরে চলে আসেন। মিছিলকারীদের কণ্ঠে শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তখনকার দিনে দক্ষিণাঞ্চলের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিএল কলেজ। ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার। ছাত্ররা একে একে ছাত্রবাস ত্যাগ করে। ছাত্রনেতৃবৃন্দের আনাগোনা ছিল কলেজ অঙ্গনে। ২৩ মার্চ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে খুলনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পাবলা গ্রামের ইউনুস আলী ইনু কলেজ চত্বরে লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। শিরোমণি টেইলার্স মাস্টার মতিয়ার রহমান এ পতাকা তৈরি করেন। একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ছাত্র সংসদের সহ সভাপতি স.ম. বাবর আলী ও সাধারণ স¤পাদক ফ.ম. সিরাজ (১৯৬৯-৭১)। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হলে বিএল কলেজের ছাত্রইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে কাজী ওয়াহিদুজ্জামান ও সৈয়দ ঈসা বন্দুকের দোকান লুট করে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেন।
২৫ মার্চ গণহত্যা, বৈকালী ও দৌলতপুর যুদ্ধের পর এ কলেজের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৬ ও ২৭ মার্চ বৈকালী, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, রেলিগেট ও দৌলতপুরে ছাত্ররা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। বিএল কলেজের ছাত্র দৌলতপুরের সন্তান ইসতিয়াক হোসেন হিডি দৌলতপুরে পাকবাহিনীর কনভয়ের ওপর গুলিবর্ষণ করে। পাবলা গ্রামের ইউনুস আলী ইনুসহ এ প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্র ৪ এপ্রিল রেডিও পাকিস্তান, খুলনা কেন্দ্র দখলের যুদ্ধে অংশ নেয়। এপ্রিলের শেষ দিক থেকে ছাত্ররা দেশত্যাগ করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যায়। বেশিরভাগই দেরাদুনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। অধিকংশই মুজিববাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট হন। তারা পাইকগাছা, বড়দল, তালা, আশাশুনি, দেবহাটা, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর, পারুলিয়া, কপিলমুনি, বারআড়িয়া ও গল্লমারি যুদ্ধে অংশ নেয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রাক্তন ছাত্র জাতীয় সংসদ সদস্য শেখ আব্দুল আজিজ, সালাউদ্দিন ইউসুফ, লুৎফর রহমান মনি, এম. এ গফুর, সৈয়দ কামাল বখত সাকি, যশোরের খন্দকার আব্দুল হাফিজ, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এ্যাড. মোমিনউদ্দিন আহম্মেদ, স.ম. আলাউদ্দিন (যুদ্ধক্ষেত্রে সশরীরে অংশগ্রহণ), এ্যাড. মো. এনায়েত আলী, ডা. মুনসুর আলী ও যশোরের নওয়াপাড়ার পিরজাদা মো. শাহ হাদিউজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া দর্শন বিভাগের শিক্ষক লুৎফর রহমান সরদার, মোহাম্মদ আলী, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক মো. নিযাম উদ্দিন সরদার, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক এসএম মকফুর রহমান, পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক মো. নিযাম উদ্দিন, বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মো. নুরুল ইসলাম, অর্থনীতির অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মজুমদার ও প্রফেসর আ. রশিদ খান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। শিক্ষক কুদরত-ই-এলাহী শহীদ হন।
এ কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে ৪নং সেক্টর কমান্ডার প্রয়াত মেজর জেনারেল সি. আর দত্ত (বীর উত্তম), লে. কর্ণেল এইচএম এ গফফার (বীর উত্তম), গাজী রহমতুল্লাহ দাদু (বীর প্রতীক), মে. জে. মো. আব্দুস সালাম, লোহাগড়ার লে. কর্নেল শেখ আবু বকর, এডি. ডিআইজি এএইচএম নুরুল উদ্দিন, কালিয়ার অধিবাসী মেজর মুন্সি মনিরুজ্জামান, উইং কমান্ডার গওসল হোসেন মির্জা, বিমান বাহিনীর শেখ আবু সাইদ, শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান, ৭৩ এর সংসদ সদস্য এমএ বারী, বয়রার মির্জা খয়বার হোসেন, ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস সৈয়দ দিদার বক্স, উপ সচিব মো. সাইফুল ইসলাম, সাবেক ভিপি আলী তারেক, পাবলার ইউনুস আলী ইনু, ’৭১-এর পড়ূয়া ছাত্র স.ম. বাবর আলী, এ এফএম জামিরুল ইসলাম (সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধে অংশ নেন), আলী নেওয়াজ, পাবলার অজয় কুমার দত্ত, দেয়াড়ার শেখ মোশাররফ হোসেন, মহেশ্বরপাশার আবদার হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, আশাশুনির তৌফিক হোসেন, পাইকগাছার শাহাদাত হোসেন বাচ্চু, শহরের এম ফিরোজ আহম্মেদ, আ ব ম নুরুল আলম, মকবুল হোসেন মিন্টু, বটিয়াঘাটার বিনয় কৃষ্ণ সরকার, দাকোপের শেখ আব্দুল আজিজ, সেনহাটির সাত্তারুজ্জামান, শরীফুল হোসেন, দৌলতপুরে রওনাকুল ইসলাম দুলাল, বয়রার জামাল উদ্দিন আহম্মেদ, শ্যামনগরের শেখ আব্দুর রহমান, গোয়ালখালীর মো. খায়রুল ইসলাম, কালিয়ার জিয়াউদ্দিন আহমেদ, কয়রার রেজাউল করিম, লোহাগড়ার গাজি আব্দুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে পাকবাহিনী রসায়ন বিভগের অধ্যাপক শেখ আব্দুর রহমানকে অত্যাচার, প্রধান অফিস সহকারি রবীন্দ্রনাথ দাশকে গুলি করতে উদ্যত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় আগস্ট মাসের দিকে কলেজে এসে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন মাসুদ রাজা শিক্ষকদের গালাগালি করেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কলেজে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। ১৭ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মিত্র বাহিনীর ২০জন অফিসার পাঁচশ’ সৈন্যবাহী ২০টি ট্রাক বিএল কলেজে প্রবেশ করে। ছাত্ররা এখানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ ক্যাম্পে তারা দু’সপ্তাহ অবস্থান করেছিল। ১৭ ডিসেম্বর সকালে আইডব্লিউটিএ ভবনে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর অপরাধে থানার ওসি ও বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি (১৯৪৯) এটিএম আমিনুল ইসলাম শহীদ হন। তিনি খুলনার সর্বশেষ শহীদ। মুক্তিযুদ্ধে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য।
লেখক: স্থায়ী সদস্য, খুলনা প্রেসক্লাব।