পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের শুরু। আবার এই বৈশাখেই স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছে। আবহমানকাল ধরে বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতিকে নতুন করে সামনে হাজির করেছে। বাঙালির আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে বৈশাখের প্রভাব নানাভাবে দৃশ্যমান। পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল। এপ্রিল মাসও বাঙালির জাতি রাষ্ট্র গঠনে স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১০ এপ্রিল যা গঠিত হয়েছিল কলকাতা শহরে। এর আগে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা বলা হয়। সেখানে বজ্রকণ্ঠে ঘোষিত হয়েছিল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হবার কথাও বলা হয়েছিল।
পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সমঝোতার নাটক জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্নকে টলাতে পারে নি। অবিরাম সংগ্রামের ধারা যতই বেগবান হয়েছে পরিস্থিতি ততই বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছে। অবশেষে ২৫ মার্চের কালরাতের গণহত্যা স্বাধীনতার স্বপ্নকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চাইলেও তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছে। হাতের কাছে পাওয়া অস্ত্র নিয়েই মুক্তিকামী জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রতিরোধ যুদ্ধে। সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এখানে নিস্প্রয়োজন।
আত্মরক্ষার্থে বিশেষ করে আওয়ামী লীগেরসহ রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের বেশিরভাগ সীমান্ত অতিক্রম করলেও প্রতিরোধ যুদ্ধ স্তিমিত হয়নি। নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাই জন্ম দিয়েছে নতুন নতুন প্রতিরোধের। বিশাল গ্রাম বাংলা হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘাঁটি। পাশাপাশি নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের মধ্যেও প্রতিরোধ যুদ্ধকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিতে নানাভাবে প্রচেষ্টা- পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসার অভাব হয় নি। ঘরে-বাইরের চাপ, দ্বিধা-সংশয় মোকাবিলা করে প্রবাসী সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বড় হয়ে ওঠে সীমান্তের ওপারে।
কলকাতায় জড়ো হওয়া এখানকার নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ তৎকালীন ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন ১০ এপ্রিল ১৯৭১। তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামানসহ উপস্থিত এমএনএ ও এমপিএদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে একটি প্রবাসী আইন পরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের খসড়া প্রণয়ন করা হয় বৈশাখেই।
১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার ঘোষণার পরদিন তাজউদ্দিন আহমদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেতার ভাষণ দেন। ১২ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৬ সদস্য বিশিষ্ট অস্থায়ী সরকার গঠনের সংবাদ প্রচারিত হয়। ১৩ এপ্রিল আগরতলায় আশ্রয় গ্রহণকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। ১৭ এপ্রিল অপরাহ্ন দেড় ঘটিকায় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথপুর (বর্তমান মুজিবনগর) আম্রকুঞ্জে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।
সেই অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন গণপরিষদ সদস্য দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউসুফ আলী। সেই ঘোষণায় বলা হয়, ‘…যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি…।’
পরবর্তী ৯ মাসে এই ঘোষণা বাস্তবায়নেই মুক্তিযুদ্ধে আত্মদান, আত্মত্যাগ করেছে মুক্তিযোদ্ধা জনগণ। এর ভিত্তিতেই স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মিত হবে এটাই ছিল শহীদদের পবিত্র রক্তের সঙ্গে আমাদের সম্পাদিত চুক্তি। এই তিন আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা। কারণ, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার ছাড়া প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা হয় না। হয় শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন। ভাগ্যবঞ্চিত নিপীড়িত জাতি অন্তরাত্মার গভীরতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিল নতুন রাষ্ট্রে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে কোনো আদর্শ হবে বাংলাদেশের নৈতিক ভিত্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ের পরে কোন পথে জনগণের মুক্তি অর্জিত হবে তার সর্বজনীন দিকদর্শন দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে।
সেখানে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার শব্দ ত্রয়ের মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। এ প্রতিফলন ৫২, ৬৯ ও ৭০ এর গণআন্দোলন- গণসংগ্রাম-অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতারই চুড়ান্ত রূপ। যা অস্বীকার করে চলার অর্থ মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলা, বিপথগামী হওয়া।
দার্শনিক জন লকের দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রয়েছে, সমান মর্যাদার ভিত্তিতেই সব মানুষের সৃষ্টি। আর সাম্য অর্থ আইনগত সাম্য, রাজনীতির সাম্য, সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্য অর্থাৎ সব মানুষের জন্য একই আইন প্রণয়ন ও নেতৃত্ব নির্বাচনের সমান অধিকার এবং জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর প্রতি সমান অধিকার।
১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাতেও বলা হয়েছে, সব মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সমান। জার্মানির সংবিধানে মৌলিক অধিকারের শীর্ষে রয়েছে মানবিক মর্যাদা। এতে বলা হয়েছে, মানবিক মর্যাদা অলংঘনীয়। একে রক্ষা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। আর সামাজিক ন্যায়বিচার হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা, যা ব্যক্তি জীবনে পূর্ণতা আনে, সমাজ থেকে তার প্রাপ্য নিশ্চিত করে এবং সমাজে সক্রিয় অবদান রাখতে সহায়তা করে। সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানব উন্নয়নের লক্ষ্য অভিন্ন। সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার প্রচলন ১৮৪০ সাল থেকে। আইএলও’র মুখবন্ধে বলা হয়েছে, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার। এসব আদর্শ ছাড়া রাষ্ট্র হয়ে ওঠে চূড়ান্তভাবেই নিপীড়ক। বাস্তবতার আলোকে এ সব ভেবে দেখার সময় এসেছে।
আজকের বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখের মতো বিভিন্ন দিবস আমরা নানা আনুষ্ঠানিকতায় পালন করি। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সম্প্রদায়ভিত্তিক সব অনুষ্ঠানই অনেকটাই শহরকেন্দ্রীক শিক্ষিতদের অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। আগের মতো পহেলা বৈশাখও আর কৃষিভিত্তিক, ফসলভিত্তিক নয়। কৃষকের নবান্ন, হাট বাজারের হালখাতাও হারিয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাও কি তেমনই অনুষ্ঠান সর্বস্ব হয়ে উঠবে? এমন সর্বনাশা আশঙ্কা এড়াতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। উৎসেই ফিরে যেতে হবে। সব কিছু ঢেলে সাজাতে হবে। এছাড়া দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ যে সম্ভব নয়, সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে? এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রই আমাদের ভরসা। তার ভিত্তিতেই সব কিছুর পরিবর্তন এখন সময়ের প্রধান চাহিদা হয়ে উঠেছে। এটা অস্বীকার করে চলা কঠিন।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক।