বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় মহামারী আকারে কোভিড ভাইরাসের ব্যাপক ও ধ্বংসাত্মক ব্যাপ্তি। সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা দেখতে পাই একটি ভাইরাসের প্রভাব, যার কারণে আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ থেকে এশিয়া সর্বত্র এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। ইতিহাসে সমগ্র পৃথিবী একই সঙ্গে স্তব্ধ হওয়ার ঘটনা শুধুমাত্র এই মহামারী। সকলের মনেই একটি প্রশ্ন কবে ও কি উপায়ে শেষ হবে এই মহামারী?
SARC-CoV-2 নামক এই আরএনএ ভাইরাস গোটা পৃথিবীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। আজ সভ্যতার এমন এক পর্যায়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ চিন্তা করছে অন্য গ্রহ উপগ্রহের বসবাসের পরিকল্পনা, ঠিক সেই মুহূর্তেই করোনা নামক একটি অতি ক্ষুদ্র জীবাণু গোটা মানবজাতির সভ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সামান্য জ্বর ও সাধারণ মাত্রার সর্দি কাশি দিয়ে যে জীবাণুর যাত্রা শুরু, তা নিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত মৃত্যুর দিকে। জীবিত সকলেই তাকিয়ে আছে মৃত্যু পথযাত্রীদের দিকে। যে ভাইরোলজি (ভাইরাস সম্পর্কে জ্ঞান) মানুষের নিরাপত্তার দিয়েছে, তার প্রতিটি পাতায় পাতায় নতুন করে সংগৃহীত হচ্ছে নতুন ধারণা, সংযোজন করতে হচ্ছে নতুন অধ্যায়। ভাইরাসের জীবনচক্র, রোগ তৈরি করার ক্ষমতা, নিজেকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াসহ প্রায় প্রতিটি ধারণাতে নতুন করে জ্ঞানের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে করোনা ভাইরাস।
সময়টা ২০১৯ সাল, শেষ ডিসেম্বরের পড়ন্ত সন্ধ্যা। উহান স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের কাছে এক অজানা ভাইরাস ঘটিত নিউমোনিয়ার নমুনা আসলো। প্রাথমিক অবস্থায় ধারণা করা হয় সম্পূর্ণ নতুন এই ভাইরাস উহান অঞ্চলের কোনো মাছের বাজার থেকে ছড়িয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিয়ে সেই ভাইরাস তীব্রভাবে বাড়তে থাকল। ধীরে ধীরে করোনা ভাইরাস সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করতে শুরু করল। অতিক্ষুদ্র এক জীবাণু নতুন করে শুরু করল মহামারী। পৃথিবীর ইতিহাসে গত প্রায় একশ’ বছরে এমন কোনো মহামারী কেউ দেখে নাই। শুরু হলো এক গ্রহণের কাল। এক ভয়ঙ্কর আঁধারে ছেয়ে গেল সমগ্র পৃথিবী।
এই মহামারীর শেষ কোথায় সে প্রশ্ন সকলের। টিকা কি নতুন মিউট্যান্ট ভাইরাসের ভেরিয়েন্ট থেকে নিরাপত্তা দিতে পারবে? সামনের দিনগুলো করোনা ভাইরাস তার রোগ তৈরি হওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে আনবে নাকি পৃথিবীর ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে কালো ও মৃত্যু উপত্যকায় দিকে। এ সবই এখন পর্যন্ত অজানা। যে ধারণাগুলো আমরা মুভিতে দেখি, তা আজ দৃশ্যমান। পার্থক্য হলো মুভিতে দেখা যায় সর্বশেষ কোনো একটি সমাধান বা আশার আলো। কিন্তু করোনায় ক্ষেত্রে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া যায়, এখন পর্যন্ত করোনা সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ও সর্বজনীন ধারণা হলো, করোনা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানার আছে। যারা গতকালও বলেছিল ভ্যাকসিন ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে যথাযথ কার্যকারিতা প্রকাশ করবে, তারাই আবার আজ বলছে ওমিক্রন ভেরিয়েন্টের ওপর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এখনো পর্যন্ত অজানা। এই যখন অবস্থা বিশ্বের বড় বড় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের, ঠিক তখনই সাধারণ লোকের চিন্তা ও চেতনা খুব সহজেই অনুমান করা যায় ।
মহামারীর কালচক্র বুঝতে হলে প্রথমেই করোনা ভাইরাসে মিউটেশন সম্পর্ক গবেষণা দরকার। ভাইরাসের মিউটেশন একটি নির্বাচিত, প্রথাগত, প্রাকৃতিক ব্যবস্থা যার সাহায্যে ভাইরাস বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থেকে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। ভাইরাসের বৃদ্ধির জন্য প্রাণী কোষ, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু কোষ দরকার হয় । ভাইরাসের বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রাণীদেহের সেই কোষের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাইরাসের মিউটেশন ও মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পর¯পর সম্পর্কিত। যে কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে মানবদেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই ধ্বংস করে আক্রমণকারী জীবাণু যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস। শুধুমাত্র ধ্বংস করেই শেষ হয় না, বরং সেই ভাইরাসের স্মৃতি ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে রাখে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায়। সংরক্ষিত স্মৃতিই ভবিষ্যৎ মানবজাতিকে একই রকমের ভাইরাস আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। যে কোনো অজানা ভাইরাস দেহের জন্য শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়। এই শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ও সেই ব্যবস্থার স্মৃতি সংরক্ষণ করাই প্রচলিত রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বিভিন্ন রকমের ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া অথবা অন্য কোনো জীবাণুর আক্রমণ থেকে এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাই মানুষকে যুগ যুগ ধরে নিরাপদ রেখেছে। মানুষের জন্য ভাইরাসের মিউটেশন সবসময় ক্ষতিকর নয়। অতীতে বহু ভাইরাস নিজেকে পরিবর্তন করে, ধীরে ধীরে রোগ তৈরি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। একটি অত্যন্ত কার্যকরী ও প্রচলিত ধারণা ভাইরাসের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় এবং সেই সঙ্গে পোষক দেহে সহাবস্থান করা।
কিন্তু যখনই প্রচলিত ধারণার কোনো ব্যতিক্রম হয়, তখনই শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল। সম্পূর্ণ নতুন কোনো ভাইরাস, যা নিজে থেকেই নিজেকে সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রবণতা খুব বেশি, যার সম্পর্কে কোনো পূর্বস্মৃতি অবশিষ্ট নেই, তার দ্বারা আক্রান্ত হলে দেহের অভ্যন্তরে ঘটতে থাকে নানা রকমের ঘটনা। দেহের রোগ প্রতিরোধ হয়ত খুব বেশি সংবেদনশীল হয়, অথবা কোনো সংবেদনশীলতাই প্রকাশ করে না। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে, করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে মুক্তি অথবা রোগির মৃত্যু নিয়ে যাওয়া নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক এবং একই সঙ্গে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না মেনেই করোনা ভাইরাস তার তাণ্ডব এবং প্রচণ্ডতা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা যখন কোনো ভাইরাস নিয়ে কথা বলি তখন একটি দুটি অথবা নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক ভাইরাস নিয়ে কথা বলি না, বরং একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভাইরাস, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় তার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। একটি একক অথবা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভাইরাসের তেমন কোনো বিবেচনা বিষয় নয়। ভাইরাসটি যখন খুব দ্রুততার সঙ্গে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে তখনই ভাইরাসের বিষয়ে আলোচনা করা হয়। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে মানবদেহ তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা যথার্থ হলে করোনা পরাজিত হয়। কিন্তু যদি প্রতিরোধব্যবস্থা যথাযথ না হয়, তখন করোনা মানবদেহের কোষগুলোকে, বিশেষ করে শ্বসনতন্ত্রের কোষগুলোকে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির স্থান বলে বিবেচনা করতে শুরু করে। মানবদেহের শ্বসনতন্ত্রের কোষগুলো মূলত শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাস ছাড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। শ্বসনতন্ত্রের করোনা ভাইরাস আক্রমণ হওয়ার পর সেই কার্যক্রম ব্যাহত হতে শুরু করে।
সাধারণত মিউটেশন বলতে কোনো ভাইরাসের পরিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝায়। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাস নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। মিউটেশনের ফলে ধীরে ধীরে ভাইরাসটি অন্যরকম বা অন্য প্রকারের পরিবর্তিত হতে থাকে। এই বৈশিষ্ট্য হারানো এবং অন্য প্রকারের পরিবর্তন হওয়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক । এখানে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ওষুধ তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। নির্দিষ্ট সময় নিয়ে দীর্ঘকালব্যাপী মিউটেশন হয়ে থাকে। মিউটেশনেই কারণে ভাইরাসের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই পরিবর্তিত হয় না। অনেকগুলো মিউটেশন থেকে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি মিউটেশন সক্রিয়তা প্রমাণ করতে পারে।
শুরুতে কোভিডের মিউটেশন ছিল প্রথাগত ও সংক্ষিপ্ত। সেই মিউটেশনের হার সাধারণ ইনফুলেঞ্জার প্রায় অর্ধেক ও অন্যান্য ভাইরাস যেমন এইচআইভি ভাইরাসের এক-তৃতীয়াংশ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যত সময় অতিক্রান্ত হচ্ছিল, ততই কোভিডের প্রচণ্ডতা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পেতে লাগল। বিজ্ঞানীদের চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দেয় করোনা ভাইরাসের পুরো পথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া । ২০২০ সালের শেষে ও ২০২১ সালের শুরুতেই একটি নতুন ভেরিয়েন্ট দেখা দেয়, যা পূর্ববর্তী ভেরিয়েন্ট থেকে বেশি ভয়াবহ ও খুব দ্রুত রোগ তৈরি করতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিকভাবে পাওয়া ভেরিয়েন্টটি আলফা ভেরিয়েন্ট নামে চিহ্নিত করা হয়।
পূর্ববর্তী থেকে প্রায় অনেক গুণ দ্রুত রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা নিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় আলফা ভেরিয়েন্ট আÍপ্রকাশ করে। কোভিড ভাইরাস প্রথাগত কোনো মিউটেশনের নিয়ম যে পুরোপুরি মেনে চলছে না, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাটি বিজ্ঞানীরা অনুধাবন করতে শুরু করেন । এ ভাইরাসটি সম্পূর্ণ নতুন ও দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছিল। প্রাথমিক আলফা ভেরিয়েন্ট, তারপর বেটা ভেরিয়েন্ট। বেটা ভেরিয়েন্টের রোগ তৈরি করার ক্ষমতা ও রোগের তীব্রতা পূর্ববর্তী আলফা ভেরিয়েন্টের চাইতেও বেশি ছিল। ইতিমধ্যে কোনো কোনো দেশে কোভিডের দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ শুরু হয়ে যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের সেই সংক্রমণে বেটা ভেরিয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ব্রাজিলের অ্যামাজন অংশে একই সময়ে দেখা দেয় গামা ভেরিয়েন্ট।
আলফা, বেটা ও গামা তিনটি ভেরিয়েন্টই ছিল একটি থেকে অন্যটি বেশি শক্তিশালী। রোগ তৈরির ক্ষমতা, রোগ ছড়ানোর প্রচণ্ডতা এবং মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধোঁকা দেয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলোর সবগুলো ভেরিয়েন্টের মাঝেই দেখা যায়। এই ভেরিয়েন্টগুলো ছিল আলাদা আলাদা জায়গায় ও একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। ধারণা করা হয় করোনা ভাইরাসের পরিবর্তন হওয়ার ক্ষমতা বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ করছে। নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে করোনার এই তিনটি ধরণই তাদের ভয়াবহতা বিস্তার করতে শুরু করে। বিশেষ করে আলফা তার ভয়াবহতা ইউরোপ, নর্থ আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে প্রকাশ করে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন আলফা ভেরিয়েন্ট থেকে মিউটেশন হয়ে পরবর্তীতে প্রচলিত ধারার ভাইরাস তৈরি হবে, যা হয়ত রোগ প্রতিরোধে ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ফাঁকি দিতে পারবে না, কিন্তু সেই ধারণা পরবর্তীতে যথাযথ প্রমাণ হয় নাই।
২০২১ সালে ভারতে পাওয়া যায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। পূর্ববর্তী অন্যান্য সবগুলো ভেরিয়েন্ট থেকে প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। ডেল্টা ভেরিয়েন্ট তা-বে পুরো ভারত মৃত্যুর নগরীতে পরিণত হয়। ডেল্টা ভেরিয়েন্টের ভয়াবহতা সমগ্র বিশ্বে ছাড়িয়ে যেতে থাকে। অত্যন্ত অল্প সময়ে এতগুলো মিউট্যান্ট ভেরিয়েন্ট পৃথিবীতে বিরল। ভাইরাসের জীবনচক্রের ধাপগুলোকে পাশ কাটিয়ে কোভিড মিউটেশন তার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে থাকে। করোনা ভাইরাসের ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েন্টের রোগ তৈরি করার প্রচণ্ডতা, রোগ ছড়ানোর তীব্রতা, মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধোঁকা দেওয়ার ক্ষমতা, খুব দ্রুত রোগির অবস্থা খারাপ করে ফেলা, চিন্তিত করে তুলে পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের। অনেকেই ধারণা করে থাকেন হয়ত ডেল্টা ভেরিয়েন্ট পরবর্তী মিউট্যান্টের রোগ তৈরি করার প্রচণ্ডতা কিছুটা হলেও কমে যাবে।
এই যখন অবস্থা ঠিক তখনই দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে কোভিডের সম্পূর্ণ নতুন আরেকটি ভেরিয়েন্ট প্রকাশ পায়। এই ধরণটি ওমিক্রন নামে চিহ্নিত করা হয়। মূল ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের প্রায় ৩০ রকমের পরিবর্তন দেখা যায় ওমিক্রন ভেরিয়েন্টে। ধারণা করা হয় ভাইরাসের ডেল্টা ভেরিয়েন্টকে মানবদেহে চিহ্নিত করে ফেলেছে। এই চিহ্নিতকরণের মূল দায়িত্ব পালন করেছে ভ্যাকসিন। ওমিক্রন যদি ডেল্টাকে চিহ্নিতকরণে নতুন মিউট্যান্ট হয়ে থাকে, তাহলে তা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কিন্তু একই সঙ্গে বিবেচ্য বিষয় হলো, রোগ ছড়ানোর হার বেশি হলে হয়ত রোগের তীব্রতা কিছুটা হলেও কমে আসবে। এই ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে যদি তাই হয় তাহলে ভাইরাস ছড়াবে খুব দ্রুত কিন্তু রোগের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। ফলে হয়ত রোগির অবস্থা খুব খারাপ হবে না। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাস মানবদেহে অনেক বেশি সময় অবস্থান করতে পারবে ফলে ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটতে থাকবে অনেকটা সময় নিয়ে। সাধারণ সর্দি যেমন ইনফুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল।
ওমিক্রনের খুব খুব দ্রুত সংক্রমিত করার ক্ষমতা দেখে বিজ্ঞানীরা আশা করছে হয়ত রোগের প্রচণ্ডতা কিছুটা কম থাকবে। ল্যাবরটরি গবেষণায় দেখা যায় ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে অথবা আক্রান্ত হওয়ার কারণে মূল ভাইরাস রোগে বিস্তারের সক্ষমতা কমতে থাকে। আমাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা করোনা ভাইরাসকে চিনতে পারে তার স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে। স্পাইক প্রোটিনের সহয়তায় ভাইরাস তার সংখ্যা বৃদ্ধি করে, এই স্পাইক প্রোটিনই মূলত রোগ তৈরি করে। যদি সেই প্রোটিন মিউটেশনের কারণে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়ে যায় তাহলে সম্পূর্ণ দুটি বিপরীতমুখী ঘটনা ঘটতে পারে এক রকম হতে পারে। হয়ত সেই ভেরিয়েন্ট দেহ চিনতেই পারল না, ফলে খুব সহজেই আক্রান্ত হয়ে গেল দেহ। অন্যরকম হতে পারে স্পাইক প্রোটিনটি যেহেতু পরিবর্তিত হয়ে গেছে তাই সেই স্পাইক প্রোটিনটি পরিপূর্ণভাবে আগের মতো আচরণ করতে পারবে না। ঠিক কতটুকু স্পাইক প্রোটিনের পরিবর্তন দ্বিতীয় সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে তা এখনো অজানা।
এই পর্যায়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, ভাইরাসের কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ (ভ্যাকসিন দিয়ে অথবা আক্রান্ত হয়ে) ব্যবস্থাও কি পরিবর্তিত হয়। সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। কিন্তু গত ৩০ আগস্ট বিখ্যাত ইমিউনিটি জার্নালে একটি গবেষণামূলক আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। আর্টিকেলে দেখানো হয়েছে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভিন্ন ভিন্ন ভেরিয়েন্টের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত হয়। এই জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুসারে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হয়। সেই পরিবর্তিত ব্যবস্থার স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মানবদেহে। এই গবেষণার ফলাফল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আশাব্যঞ্জক।
ওমিক্রন সম্পর্কে ধারণাগুলো এখনো খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। মানবদেহের করোনা ভাইরাস আক্রমণ, বিস্তার ও তার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে। ভাইরাসের মিউটেশন এই গবেষণা কার্যক্রমকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করে। ভাইরাস মিউটেন্ট হয়ে কি রকম বা কোনো প্রকারে আত্মপ্রকাশ করবে তা পূর্বেই নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। মিউটেশনের প্রচলিত নিয়মের সাহায্যে সেই মিউটেশন সম্পর্কে মাত্র কিছুটা ধারণা করা যায়। কিন্তু করোনা ভাইরাস অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথাগত কোনো নিয়ম মেনে জীবচক্র অতিবাহিত করছে। কোভিড কবে শেষ হবে, কতদিন পরে করোনা ভাইরাস তার ক্ষমতা হারিয়ে সাধারণ সর্দি জ্বরে পরিণত হবে, তা এই মুহূর্তে ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে মানবজাতির এই গ্রহণের কাল একদিন শেষ হবে, এবং নিশ্চয়ই সবাই মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবে।
লেখক: ফার্মাসিস্ট, মাস্টার্স ইন ফার্মাসিউটিক্যালস টেকনোলজি।