বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মতো করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আমেরিকার কৃষি ব্যবস্থাতেও চাহিদা এবং সরবরাহের অসামঞ্জস্য পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। এর ফলে আমেরিকার কৃষকদের কৃষিপণ্য বিপণনের যে সমস্যা, তার বিভিন্নতাকে আমাদের সামনে নতুন করে তুলে ধরেছে। এই সমস্যার শীর্ষে রয়েছে, কৃষকের কৃষিপণ্য সরাসরি গ্রাহকদের কাছে বাজারজাত করতে পারার সক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা।
মহামারির সংকটের শুরুর দিকের সময়টাতে মুদি দোকানগুলোর তাকগুলো খালি পড়েছিল। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় কৃষকেরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্য নষ্ট করে ফেলতে বাধ্য হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে খামারগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই ছিল ভীষণ কঠিন ব্যাপার।
এজি এলার্টের সহকারি সম্পাদক চিং লি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, অনেক কৃষককেই তাদের ব্যবসার পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে বিবেচনা করতে হয়েছে এবং টিকে থাকার জন্য ‘বিকল্প বাজারের পদ্ধতি খুঁজতে হয়েছে’। জেমস বার্চ নামে এক কৃষক লি’কে জানিয়েছেন, তার খামার টিকিয়ে রাখতে হলে বিপণনের জন্য নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা অপরিহার্য, ‘আমাদের আয় কয়েক হাজার ডলার থেকে নেমে একেবারে শূন্য হয়ে গেছে এবং এমন নয় যে আমাদের ব্যাংকে কোনো সঞ্চয় রয়েছে।’
বার্চের মতো পরিস্থিতিতে অনেক কৃষকই সরাসরি গ্রাহকের কাছে কৃষিপণ্য সরবরাহের বিপণন প্রচেষ্টা শুরু করেছেন যা তাদের ব্যবসার দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করবে।
কিন্তু সরাসরি বিপণন ব্যবস্থা অনেক কৃষকদের জন্য একেবারেই নতুন পন্থা। এসব কৃষকেরা তাদের পণ্য বাজারজাত করণের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। ওরাগন স্টেট ইউনিভার্সিটির ফলিত অর্থনীতির অধ্যাপক ল্যারি লেভ লিখেছেন, ‘এক অর্থে, পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ খামার বিপণন যুক্তকরণ বিষয়টা প্রায় একটা নতুন ব্যবসা শুরু করার মতো।’
অন্য কথায়, সরাসরি ভোক্তা কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় অনেক কিছুই জানার প্রয়োজন রয়েছে। গ্রাহকের কাছে সরাসরি পণ্য বাজারজাত করণের সবচেয়ে সাধারণ সমস্যাগুলির মধ্যে চারটি এখানে তুলে ধরা হলো:
১. বিপণন দক্ষতা এবং এ সংশ্লিষ্ট উপকরণের অভাব
পণ্যসামগ্রীকে সঠিকভাবে গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো যে কোনো ব্যবসা পরিচালনার অন্যতম কঠিন অংশ। এমনকি অভিজ্ঞ বিপণনকারীদেরও এই সমস্যা মোকাবেলা করতে বেগ পেতে হয়। মার্কেটিংও কোনো সস্তা বিষয় নয়। এটাতে সফলতা পেতে যথেষ্ট পরিমণে সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়।
নতুন বিপণন কৌশল গ্রহণ করতে হলে কৃষকেরা তাদের সময় এবং অর্থকে কীভাবে ব্যয় করবে তার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। কৃষকদের নিজেদের প্রতিদিনের খামারের কার্যক্রম বজায় রেখেই বিপণন দক্ষতা তৈরি এবং বিপণন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সময় বের করতে হবে। খামারের আর্থিক পরিস্থিতির দিকেও তাদেরকে সমানভাবে নজরদারি জারি রাখতে হবে।
২. কঠিন প্রতিযোগিতা
পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দুই মিলিয়নেরও বেশি খামার ছিল (খামার বলতে, যারা বছরে এক হাজার ডলার বা তার অধিক মূল্যমানের কৃষি পণ্য বিক্রয় করে তাদেরকে বোঝানো হয়েছে)। ছোট ছোট খামারগুলোকে সারা দেশে সরাসরি উন্মুক্ত করা হলে গ্রাহকরা তাদের প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য কেনার অনেক বিকল্প পন্থা পেয়ে যাবে। এতে করে কৃষকদের জন্য নতুন বাজার তৈরি করা বা স্বাধীনভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করাটা কঠিন হয়ে পড়বে। কৃষকদের অনলাইন বিক্রির দিকে জোরালো আগ্রহের এটি একটি বেশ বড় কারণ।
৩. অনলাইনে বিক্রির পদক্ষেপ গ্রহণ
মহামারীর কারণে সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত বিধিনিষেধের ফলে অনেক কৃষক পণ্য বিক্রির প্রয়োজনে অনলাইনে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই অনলাইন বিক্রয় পদ্ধতি, কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রসারে রূপান্তরিত হতে পারে। সিভিল ইটস-এর সিনিয়র পলিসি রিপোর্টার লিসা হেল্ড জানিয়েছেন, ‘কোনো স্বতন্ত্র প্রস্তুতকারক এবং স্থানীয় খাদ্য সমষ্টিকারকদের (অনলাইন প্ল্যাটফর্ম/ অ্যাগ্রিগেটর) জন্য পণ্যের মানোন্নয়ন এবং অনলাইন উপস্থাপনে এটি অনেক কার্যকরি ভূমিকা রেখেছে।’
লিসা হেল্ড মন্তব্য করেন, অনেক কৃষকের কাছে কৃষিপণ্য বাজারজাত করণের বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে, সরাসরি ভোক্তার কাছে বিপণন এবং পৌঁছানোর জন্য ব্যবসায়িক মডেল প্রস্তুত করণ। অন্য প্রধান চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া পেইজের মাধ্যমে গ্রাহকের সাথে সংযুক্ত হওয়া এবং বিক্রির জন্য একটি অনলাইন উপস্থাপন তৈরি করা ল্যারি লেভ মন্তব্য করেন, এই গুরুত্বপূর্ণ বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে, অনেক গ্রাহককের কাছে পৌঁছাতে পারা যাবে এবং বিক্রির জন্য প্রচুর সময় হাতে পাওয়ার মতো ব্যাপক সুবিধা ইত্যাদি পাওয়া যাবে।
৪. গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোর রসদ
(সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং পরিবহন সংক্রান্ত)
সমস্যা যখনই কৃষকেরা সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে অনেক গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে, তখনই কৃষি বিপণনের অন্যান্য সমস্যা আবির্ভূত হচ্ছে। যেমন, সতেজতা বজায় রাখার জন্য পণ্য সংরক্ষণ এবং গ্রাহকের কাছে তাজা পণ্য সরবরাহ। কৃষি পণ্যের ব্যবহারযোগ্য সময়সীমা খুব সীমিত। ফলে, গ্রাহকের প্রত্যাশা অনুযায়ী সতেজ পণ্য সরবরাহ করার জন্য কৃষকদের কাছে একটি সংক্ষিপ্ত সময়সীমা ধার্য হয়ে যায়।
এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে গুদামজাত করণের প্রয়োজন। গুদামঘরের জন্য নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন। এবং পণ্যের সতেজতা নিশ্চিত করার জন্য পুনরায় প্রক্রিয়াজাত করণের প্রয়োজন।
কৃষি বিপণনের এই সমস্যাগুলো কঠিন বলে মনে হতেই পারে কিন্তু এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে কৃষকেরা বৃহত্তর স্বাধীনতার পথে উত্তরণ করতে পারবে। এই অনিশ্চিত সময়ে, যখন সারা বিশ্ব একটি নতুন সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে ব্যস্ত তখন কৃষকদের ব্যবসায় টিকে থাকার উপায় হিসাবে স্বনির্ভরতা অর্জনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিভিত্তিক ওয়েব সাইট
লেখক: সাংবাদিক ও অনুবাদক