মুবিন খান
জিনা পিকিরিলো বাড়ির ছাদে বসে রয়েছেন। নিউ ইয়র্কে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তাতে জিনার পক্ষে চুপটি করে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। টেলিভিশনে টুইন টাওয়ার হামলার খবর দেখতে দেখতে অস্থির লাগে জিনার। আবার ভয়ও লাগে। ভয়ে তার বুকের ভেতরে ঢিবঢিব করতে থাকে। তবুও চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারে না জিনা। ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটিও সম্ভব নয়। ভনকে নিয়ে ছাদে চলে যায় জিনা। ম্যানহাটনের এম্পায়ার বিল্ডিং আর টুইন টাওয়ার বেশ অনেকটা দূর হলেও ব্রুকলিনের এই বাড়িটির ছাদ থেকে সেটি বোঝা যায় না। মনে হয় দুটাই যেন পাশাপাশি। জিনা তাকিয়ে থাকে ম্যানহাটনের আকাশের দিকে। আকাশ দেখা যায় না। কালো একটা মেঘ ঢেকে রেখেছে পুরো ম্যানহাটনকে। আসলে মেঘ নয়। ধোঁয়া আর ধূলা। ধোঁয়া হলো বিস্ফোরণের। আর ধূলা টুইন টাওয়ার ধসে পড়বার। একটা ভয় এসে জিনার গায়ে কাঁটা ফোটায়। কেঁপে ওঠে জিনা। তারপর বেবি ক্যারিজে শুয়ে থাকা তিন মাসের ভনের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে, ‘এই উন্মাদ পৃথিবীতে তোকে নিয়ে এসেছি বলে ক্ষমা করে দিস্।’
আমি তখন একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। ১১ সেপ্টেম্বর দিনটিতে দুপুর তিনটার দিকে খুব ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। ঘুম ভেঙেছিল সন্ধ্যার আগে আগে। বিকেলের চা চেয়ে টেলিভিশন খুলে সিএনএনে ঢুকতে চমকে উঠতে হয়েছিল। সিএনএন তখন লাইভ টেলিকাস্টে টুইন টাওয়ারে বিমান ঝাঁপিয়ে পড়া দেখাচ্ছে। স্ক্রিনে লেখা ‘প্লেন ক্র্যাশ ইনটু ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টাওয়ার’। মানে তখনও এটাকে বিমান দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। আরেকটু পর আরেকটা প্লেন এসে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় ভবনটিতে যখন আছড়ে পড়ে বিস্ফোরিত হলো। তখন সকলে বুঝে ফেলল এইটি আসলে আক্রমণ। টেলিভিশন স্ক্রিনের লেখা পালটে দিয়ে লেখা হলো, ‘আমেরিকা আন্ডার অ্যাটাক’। বিবিসিতে গিয়ে দেখা গেল তাদের স্ক্রিনে লিখেছে, ‘টেরোরিজম অ্যাটাকস্ ইন ইউএস’।
কিছুক্ষণ পরই টুইন টাওয়ারের ভবন দুটা ধসে পড়তে শুরু করল। রাস্তায় প্রাণ বাঁচাতে মানুষ ছুটতে লাগল। কিন্তু যারা ওই ভবনে ছিলেন তারা কোথায় যাবেন? তাদের তো বাঁচবার পথ নেই। আমি জমে গিয়ে টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওই মুহূর্তে জিনা পিকিরিলো হয়ত ব্রুকলিনের বাড়ির ছাদে বসে তিন মাস বয়সী ভনকে এই উন্মাদীয় পৃথিবীতে আনবার জন্যে অনুশোচনায় ভনের কাছে ক্ষমা চাইছে। আমারও অনেকটা জিনার মতো ভয় লাগতে লাগল। তবে জিনা পিকিরিলোর সঙ্গে আমার ভয়টার ফারাক আছে। নিউ ইয়র্কে বসে জিনা তার নিজের আর তিন মাস বয়সী শিশুটির নিরাপত্তা নয়, জীবন বাঁচানো নিয়েই চিন্তিত ছিল। বুকের ভেতরে নিষ্ফল আক্রোশ থাকলেও কিছুই করতে না পারার হতাশা ছিল। আমাদের অবস্থান জিনার মতো ছিল না। তবুও হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও ওর কাছাকাছি একটা ভয় তখন তাড়িত করেছিল। ভয়টা ক্ষমতা আর শক্তিকে, এবারে নিশ্চয়ই একটা যুদ্ধ বেধে যাবে! সেটা বিশ্বযুদ্ধ হবে? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ? যুদ্ধটা তাৎক্ষণিক না বাধলেও পরের বছর বেধেছিল বটে। যুদ্ধের নাম ‘ওয়ার অন টেরর’। ৭ অক্টোবর ২০০১ থেকে ১৫ আগস্ট ২০২১ অবধি চলেছিল সে যুদ্ধ। ৯/১১ হামলা পৃথিবী জুড়ে একটা নতুন সমীকরণ তৈরি করে দিল।
সেদিন টক অব দ্য ওয়ার্ল্ড ছিল টুইন টাওয়ার হামলা। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বেরুতে দেখা গেল, আমাদের শহরের মানুষ দু ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদল হামলার খবরে উল্লাস করছে, ‘আমেরিকা তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়! ওদেরকেও ধরা যায়, ছোঁয়া যায়, মারাও যায়!’ অন্য দল এ হামলাকে সমর্থন করছে না। এমন ভয়াবহ নৃশংস এবং কাপুরুষোচিত একটা কাজকে কি করে কেউ সমর্থন করতে পারে! কিন্তু করছিল আসলে। এই টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পর আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করল, তখন আমাদের ঢাকার রাস্তায় কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা ‘আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দিয়ে সভা সমাবেশ করেছিল- তবে এও আমাদের জন্যে নতুন নয়।
আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকার রাস্তায় মিছিল করে ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল বা সংগঠন ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান’ শ্লোগান দিয়েছে। পরেও বিভিন্ন সময় ঢাকায় এমন স্লোগান দেওয়া হয়েছে। আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে অনেকে আফগানিস্তানে মুজাহিদিন বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি আফগানিস্তান ফেরত এমন একজনের সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের দুটা জঙ্গি সংগঠন জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদের দুই নেতা আব্দুর রহমান এবং মুফতি আব্দুল হান্নানও আফগানিস্তান ফেরত। এ দুই জঙ্গি সংগঠনে আরও ১৪ জন আফগান ফেরত ছিলেন। জঙ্গি তৎপরতার দায়ে শীর্ষ এই দুজন এবং অন্য ১৪ জনের ফাঁসি হয়েছে।
২০২১ সালে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে কথা চলছিল তখন এ সফরের প্রতিবাদে বায়তুল মোকাররম এলাকায় ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন বাংলাদেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করার হুমকি দিয়ে নিজেদেরকে তালেবানের মতো জঙ্গিতে রূপান্তরের কথা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছিল। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ওই ভয়াবহ স্লোগান দেওয়ার লোকজন তৈরি হয়েই চলেছে।
খবরের কাগজ জানিয়েছিল, টুইন টাওয়ার হামলা করেছে আল কায়েদা। যদিও আল কায়েদা নতুন কোনও সংগঠন নয়। আল কায়েদা আসলে একটা নেটওয়ার্ক। সৌদি আরবের কোটিপতি ওসামা বিন লাদেনের হাত ধরে ’৮০র দশকে গড়ে ওঠে।
তালেবান সংগঠনটির জন্ম ’৯০ দশকের শুরুর দিকে। পশতু ভাষায় তালেবান মানে হলো ছাত্র। এদের প্রায় সবাই সুন্নি মতাদর্শী মাদ্রাসার ছাত্র। কিন্তু এরা বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে ’৯৬ সালে। ’৯৬-এ কাবুল দখলের পর দেশটির প্রেসিডেন্ট আর তার ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেহ রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখে। সরকার প্রতিষ্ঠার পর তালেবানরা ইসলামি শরিয়া আইনের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে শুরু করল। অপরাধী কিংবা ব্যাভিচারে অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে হত্যা করতে শুরু করল। চুরির দায়ে অভিযুক্তদের হাত কেটে ফেলতে লাগল। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করে দিল। টেলিভিশন, সঙ্গীত, সিনেমা নিষিদ্ধ করে দিল। দশ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই বলে নিয়ম জারি করল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তিটি ছিল আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলে। ২০০১ সালে তালেবানরা সে মূর্তিটি ধ্বংস করে ফেলল।
বলা হয়ে থাকে রোম নগরী যখন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল সেসময় বাঁশি বাজাচ্ছিলেন নিরো। রোমান সম্রাট নিরো ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর আর পাগলাটে শাসকদের একজন। নিরো নিজের মাকে হত্যা করেছেন। হত্যা করেছেন তার সৎ ভাই ও স্ত্রীদেরকেও। খ্রিস্টানদের ওপর ভীষণ নিপীড়ন চালিয়েছেন। কেউ যখন অন্যের দুর্ভোগ উপেক্ষা করে প্রচণ্ড স্বার্থবাজ হয়ে উঠে নিজেতেই মগ্ন থাকেন তখন তাকে নিরোর সঙ্গে তুলনা করা হয়।
কথা শুরু হয়েছিল জিনা পিকিরিলোকে নিয়ে। জিনা তার তিন মাসের শিশুটিকে এই উন্মাদের পৃথিবীতে এনেছেন বলে তার কাছে ফিসফিসিয়ে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এছাড়া জিনার আসলে কিছু করবারও ছিল না। জিনাকে আমি চিনি না। কখনও পরিচয় হবে তেমন কোনও সম্ভাবনাও নেই। কিন্তু জিনার অক্ষম বাসনার সঙ্গে নিষ্ফল আক্রোশকে আমি ঠিক ঠিক চিনেছিলাম। সেকারণেই জিনা পিকিরিলোর ভয় আমার কাছে পরিচিত। ক্ষমতাহীন মানুষেরা সবসময়ই বড় অসহায় হন।
জিনার ছেলে ভন এখন বড় হয়েছে। ছেলেটা যখন জন্মায় তখন বিশ্বব্যবস্থা একরকম ছিল। ওর তিন মাস বয়সে সে ব্যবস্থা আমূল পালটে গেল। পালটে যাওয়া বিশ্বব্যবস্থা আর আমেরিকায় ভন কেমন মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠেছে? এইটি কখনও জানা যাবে না। তবে জানা যাবে, ২০২০ সালে তালেবানের সঙ্গে আমেরিকা একটি শান্তি চুক্তি করেছে। জানা যাবে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের পক্ষে এই চুক্তিতে সই করেছেন।
আচ্ছা, ‘বাংলা হবে আফগান, আমরা হবো তালেবান’ শ্লোগান দেওয়া লোকেরা এখন কি ‘তালেবান’ হয়ে উঠতে আরও উৎসাহিত হবেন? কিংবা ‘উন্মাদীয় পৃথিবীতে আনবার জন্যে তিন মাস বয়সী ছেলের কাছে ক্ষমা চাওয়া’ জিনা পিকিরিলো লজ্জিত হবেন? আমি জানি না। আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে।
মুবিন খান তিন দশক আগে ছাত্রজীবনে সংবাদপত্রে কাজ করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিককে তিনি কাজ করেছেন। মাঝে বছর দশক দেশের বাইরে ছিলেন। বিদেশে বসেই নিউ ইয়র্কের বাংলা পত্রিকা রূপসী বাংলায় নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। এখনো সে দায়িত্বটি পালন করছেন।