২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়েদা নামক ইসলামিক চরমপন্থী গোষ্ঠীর ১৯ জন জঙ্গি সদস্য চারটি বিমান হাইজ্যাক করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আত্মঘাতী হামলা চালায়। এর মধ্যে দুটি বিমান নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয়, তৃতীয় বিমানটি ভার্জিনিয়ার আর্লিংটনের পেন্টাগনে আঘাত করে। চতুর্থ বিমানটি পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কসভিলের একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। ৯/১১-এর এই সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ নিহত হন। এই সহিংস ঘটনার পরেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে জর্জ ডব্লিউ. বুশকে সন্ত্রাসবাদবিরোধী হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। দিনটি ছিল মঙ্গলবার। ঝকঝকে পরিষ্কার একটা সকাল। ৮টা বেজে ৪৫ মিনিট। হঠাৎ করেই ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল বোঝাই আমেরিকান এয়ারলাইন্স বোয়িং ৭৬৭ বিমানটি নিউ ইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের নর্থ টাওয়ারে বিধ্বস্ত হয়। তখুনি ১শ’ ১০ তলা ভবনের ৮০ তলায় একটি জ্বলন্ত গহ্বরের সৃষ্টি হয়। সঙ্গে সঙ্গেই শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। আরও বেশি সংখ্যক মানুষ ভবনের ওপরের তলাগুলোতে বন্দি হয়ে পড়ে।
নর্থ টাওয়ার এবং এর সঙ্গের ভবন থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হতেই, টেলিভিশন ক্যামেরাগুলো ঘটনাস্থলের সরাসরি সম্প্রচার দেখানো শুরু করে। তখনও পর্যন্ত ঘটনাটিকে হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনা বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু প্রথম বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার আঠারো মিনিট পরেই আরেকটি ৭৬৭ বোয়িং বিমান (ইউনাইটেড এয়ারলাইনস ফ্লাইট ১৭৫) উড়ে আসে। বিমানটি তীক্ষ্ম বাঁক নিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সাউথ টাওয়ারের ৬০তম তলায় আঘাত হানে। সংঘর্ষের ফলে একটি বিশাল বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয় এবং আশপাশের ভবন এবং নীচের রাস্তায় জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এর ফলে পরিষ্কার বোঝা গেল আমেরিকা আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে।
ওসামা বিন লাদেন
ছিনতাইকারীরা ছিলেন সৌদি আরব এবং অন্যান্য আরব দেশগুলোর ইসলামি সন্ত্রাসবাদী। প্রতিবেদন অনুযায়ী সৌদি আরব থেকে পলাতক ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার অর্থায়নে এই হামলা করা হয়েছে। আমেরিকার ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন, পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধে জড়িত থাকা এবং এই উপলক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অব্যাহত সামরিক বাহিনীর উপস্থিতির প্রতিশোধ হিসেবে তারা এই সন্ত্রাসী হামলা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সন্ত্রাসীদের মধ্যে কয়েকজন এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিল। তারা আমেরিকার বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্কুলগুলো থেকেই বিমান চালনা শিখেছে। বাকি সদস্যরা ১১ সেপ্টেম্বরের মাসখানেক আগেই যে কোনও ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং অপারেশনের ‘পেশীশক্তি’ হিসাবে কাজ করেছিল।
১৯ জন সন্ত্রাসী সহজেই তিনটি ইস্ট-কোস্ট বিমানবন্দরের নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে ছুরি এবং বক্সকাটার পাচার করতে সক্ষম হয়। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া ফুয়েল বোঝাই চারটি ভোরের ফ্লাইট বেছে নেয়। বিমান উড্ডয়নের পরপরই সন্ত্রাসীরা বিমান চারটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানগুলোকে নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রে রূপান্তরিত করে।
পেন্টাগনে হামলা
টেলিভিশনের পর্দায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যখন নিউ ইয়র্কের এই ঘটনা দেখছিল, আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ৭৭তম ফ্লাইটটি তখন পেন্টাগনে আঘাত হানার ঠিক আগে ওয়াশিংটন ডিসির কেন্দ্রস্থল প্রদক্ষিণ করছিল। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে পেন্টাগন মিলিটারি হেডকোয়ার্টারের পশ্চিম দিকে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
বোয়িং ৭৫৭ এর জেট ফুয়েল থেকে একটি ধ্বংসাত্মক অগ্নিকা- ঘটে। এই অগ্নিকা- দৈত্যাকার কংক্রিট ভবনের একটি অংশের কাঠামোকে অকেজো করে দেয়। অংশটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর। পেন্টাগনের ১২৫ জন সামরিক কর্মী এবং বেসামরিক লোক সকলেরই মৃত্যু হয়, সেই সঙ্গে বিমানে থাকা ৬৪ জন যাত্রীরও মৃত্যু ঘটে।
টুইন টাওয়ারের পতন
সন্ত্রাসীরা মার্কিন সামরিক বাহিনীর নার্ভ সেন্টারে আঘাত হানার ১৫ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে নিউ ইয়র্কের এই সদ্যজাত আতঙ্ক এক ব্যাপক বিপর্যয়ের দিকে মোড় নেয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সাউথ টাওয়ারটি ধুলো এবং ধোঁয়ার বিশাল মেঘ তৈরি করে ধসে পড়ে। গগনচুম্বী ভবনটির অত্যাধুনিক কাঠামো ঘন্টায় ২০০ মাইলের বেশি বেগের বাতাস এবং বড় ধরনের অগ্নিকা- তাপমাত্রা সহনশীল করে তৈরি করা হলেও জ্বলন্ত জেট ফুয়েলের প্রচ- তাপকে সহ্য করতে পারে নি।
সকাল সাড়ে ১০টায় টুইন টাওয়ারের নর্থ টাওয়ারটি ধসে পড়ে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টাওয়ার ধসে পড়ার সময় মাত্র ছয়জন জীবিত ছিলেন। প্রায় দশ হাজার আহত মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছিল। এরমধ্যে অনেকের অবস্থাই ছিল গুরুতর।
ফ্লাইট ৯৩
এদিকে আরেকটি ক্যালিফোর্নিয়াগামী বিমান- ফ্লাইট ৯৩ নিউ জার্সির নেওয়ার্ক লিবার্টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়ার প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে হাইজ্যাক করা হয়েছিল। কারণ বিমানটি উড্ডয়ন করতে দেরি হওয়ায় বোর্ডে থাকা যাত্রীরা সেলফোন এবং ফোনকলের মাধ্যমে নিউ ইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনের ঘটনা জেনে গিয়েছিলেন।
কয়েকজন যাত্রী এবং ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, ছিনতাইকারীদের দেওয়া আশ্বাস অনুযায়ী বিমানটি কোনও বিমানবন্দরে অবতরণ করবে না বুঝতে পেরে একটি বিদ্রোহের পরিকল্পনা করে।
টমাস বার্নেট জুনিয়র নামে একজন যাত্রী তার স্ত্রীকে ফোনে বলেছিলেন, ‘আমি জানি আমরা সকলেই মারা পড়ব। আমরা তিনজনে মিলে কিছু একটা করতে যাচ্ছি। তোমাকে ভালোবাসি, প্রিয়।’ টড বিমার নামে আরেক যাত্রীকে একটি ওপেন লাইনে বলতে শোনা গিয়েছিল ‘তোমরা কি তৈরি? চল, শুরু করা যাক।’
স্যান্ডি ব্র্যাডশো নামের একজন ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট তার স্বামীকে ফোনে (সাংকেতিক বাক্য ব্যবহার করে) ব্যাখ্যা করে বলছিলেন যে, তিনি একটা গ্যালিতে পড়ে গেছেন এবং সেখানে তাকে ফুটন্ত পানি দিয়ে পাত্র ভরতে হচ্ছিল (অর্থাৎ দুর্ঘটনা ঘটার আগেই সংশোধন করার একটি চেষ্টা চলছে এবং তখন তারা সেই প্রচেষ্টার চরম মুহূর্তে উপনীত প্রায়)। স্বামীর কাছে তার শেষ কথা ছিল ‘প্রত্যেকেই প্রথম শ্রেণিতে দৌড়াচ্ছে। আমাকে যেতে হবে, বিদায়।’
যাত্রীরা বিমানের চারজন ছিনতাইকারীর সঙ্গে লড়াই করে। ধারণা করা হয়, তারা একটি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের সাহায্যে ককপিটে আক্রমণ করে। বিমানটি তখন উল্টে যায় এবং প্রতি ঘণ্টায় পাঁচশ’ মাইল বেগে ভূমির দিকে নামতে শুরু করে, সকাল ১০টা ১০ মিনিটের সময় পশ্চিম পেনসিলভেনিয়ার শ্যাঙ্কসভিলের কাছে একটি গ্রাম্য মাঠে প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়।
৪৪ জন আরোহীর সকলেই নিহত হন। বিমানটির সংকল্পিত লক্ষ্য বিষয়ে কিছুই জানা যায় নি। তবে কাজের পদ্ধতি অনুসারে, হোয়াইট হাউস, ইউএস ক্যাপিটল, মেরিল্যান্ডে অবস্থিত রাষ্ট্রপতির আশ্রয়কেন্দ্র ‘ক্যাম্প ডেভিড’ অথবা পূর্ব সমুদ্র তীরবর্তী একাধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনও একটি এই বিমানের অভীষ্ট লক্ষ্য ছিল বলে ধারণা করা হয়।
৯/১১ হামলায় মোট নিহতর সংখ্যা কত?
৯/১১ হামলায় মোট ২ হাজার ৯শ’ ৯৬ জন নিহত হন। নিহতদের গণনার মধ্যে চারটি বিমানের ১৯ জন সন্ত্রাসী হাইজ্যাকারকেও এই হিসেবের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি এবং পেনসিলভেনিয়ায় মোট ৭৮টি দেশের নাগরিকদের মৃত্যু ঘটে।
দুটি বিমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ২ হাজার ৭ শ’ ৬৩ জন মানুষ মারা যায়। এই পরিসংখ্যানে ৩ শ’ ৪৩ জন দমকল কর্মী এবং প্যারামেডিক, ২৩ জন নিউ ইয়র্ক সিটি পুলিশ অফিসার এবং ৩৭ জন পোর্ট অথরিটি পুলিশ অফিসার রয়েছেন। এরা সকলে ভবনগুলো খালি করাতে এবং উঁচু তলায় আটকে পড়া অফিস কর্মীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন।
পেন্টাগনে নিহতের সংখ্যা ১৮৯। এদের মধ্যে ৬৪ জন ভবনে আঘাতকারী বিমান আমেরিকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট ৭৭-এর যাত্রী। পেনসিলভেনিয়ার মাঠে ফ্লাইট ৯৩ বিমানটি বিধ্বস্ত হলে ৪৪ জন নিহত হন।
আক্রমণের প্রত্যুত্তরে আমেরিকার জবাব
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ ৯/১১ হামলার সময় ফ্লোরিডায় অবস্থান করছিলেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে সেসময় সারাদিন ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে জায়গা পরিবর্তন করছিলেন। সন্ধ্যা ৭টায় তিনি হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন।
রাত ৯টায় প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ. বুশ তার ওভাল অফিস থেকে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘সন্ত্রাসী হামলা আমাদের সর্বোচ্চ ভবনগুলোর ভিত নাড়িয়ে দিতে পারলেও, আমেরিকার ভিতকে ¯পর্শ পর্যন্ত করতে পারবে না। এই আক্রমণ, ইস্পাতকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারলেও, তারা আমেরিকার সুনিশ্চিত সিদ্ধান্তের ই¯পাতকে টোল খাওয়াতে পারবে না।’
এক প্রসঙ্গে তিনি মার্কিন সামরিক প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বুশ ঘোষণা করেন, ‘সন্ত্রাসীদের মধ্যে যারা এই অপরাধ সংঘটিত করেছে এবং যারা এই সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়েছে আমরা তাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য করব না।’
আফগানিস্তান থেকে তালেবান শাসন উৎখাত এবং সেখানে অবস্থিত ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় ‘অপারেশন এন্ডিওরিং ফ্রিডম’ ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করা হয়। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই মার্কিন বাহিনী কার্যকরভাবে তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু যুদ্ধ চলমান থাকে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জোট বাহিনী প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানে অবস্থান গ্রহণ করা তালেবান বিদ্রোহীদের পরিচালিত একটি অভিযানকে পরাজিত করার চেষ্টা করছিল।
১১ সেপ্টেম্বরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের ২ মে পর্যন্ত পলাতক ছিলেন। অবশেষে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের একটি গোপন আস্তানায় মার্কিন বাহিনীর হাতে লাদেন ধরা পড়ে এবং তাকে হত্যা করা হয়। জুন ২০১১ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আফগানিস্তান থেকে বড় আকারের সৈন্য প্রত্যাহার শুরুর ঘোষণা দেন। আফগানিস্তান থেকে সমস্ত মার্কিন বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ তৈরি
৯/১১ থেকে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীনতার ভয়, অ্যানথ্রাক্স জীবাণু সম্বলিত চিঠি, যা পাঁচ জনের মৃত্যু এবং ২২ জনের সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে একটা আতঙ্কজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ২০০২ সালে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ তৈরি করা হয়। এই অ্যাক্ট ২৫ নভেম্বর, ২০০২ তারিখে রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ কর্তৃক আইনের অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধ, সীমান্ত নিরাপত্তা, অভিবাসন এবং কাস্টমস, এবং দুর্যোগ ত্রাণ ও প্রতিরোধে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ একটি দায়িত্বশীল মন্ত্রিসভা।
আইন তৈরির দুদিন পরেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা সংক্রান্ত জাতীয় কমিশন গঠন করা হয়। জানা গেছে, দ্বিদলীয় ৯/১১ কমিশনকে ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর তদন্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ৯/১১ কমিশনের তৈরি রিপোর্ট ২২ জুলাই, ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ৯/১১-এর পেছনে থাকা মাস্টারমাইন্ড বা ‘৯/১১ হামলার প্রধান স্থপতি’ নামকরণে অভিযুক্ত করা হয়।
খালিদ শেখ মোহাম্মদ ১৯৯৯-২০০১ সাল পর্যন্ত আল কায়েদার প্রচার অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন। ১ মার্চ, ২০০৩ কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স তাকে ধরতে সমর্থ হয়। ৯/১১ বিষয়ক যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আরও চারজন অভিযুক্ত সন্ত্রাসীর সাথে তাকে গুয়ানতানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্পে জেলবন্দি করে রাখা হয়। জেলবন্দি করার আগে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।
খালিদ শেখ মোহাম্মদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় ব্যবহৃত ওয়াটার বোর্ডিংসহ অন্যান্য টর্চারের ব্যবহার আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৯ সালের আগস্টে, কিউবার গুয়ানতানামো বে-এর একটি মার্কিন সামরিক আদালতের বিচারক ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অপরাধে, খালিদ শেখ মোহাম্মদ এবং অভিযুক্ত অন্য চারজনের জন্য ২০২১ সালে বিচারের একটি তারিখ নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই বিচার কাজ স্থগিত করা হয়।
৯/১১-এর অর্থনৈতিক প্রভাব
৯/১১ হামলা তাৎক্ষণিকভাবে মার্কিন অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। হামলা চলাকালীন ভবন খালি করার জন্য নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জসহ অন্যান্য ওয়াল স্ট্রিট প্রতিষ্ঠানকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। হামলার পর লেনদেনের প্রথম দিনেই বাজারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ বা ৬ শ’ ৮৪ পয়েন্ট দরপতন ঘটে।
শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরের অর্থনীতিতেই মাসে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়া প্রথম তিন মাসে ২.৮ বিলিয়ন ডলারের মজুরি হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল অর্থ ও বিমান পরিবহন খাতেÑ যেটি ৬০ শতাংশ চাকরি হারানোর জন্য দায়ী। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬০ বিলিয়ন ডলার। গ্রাউন্ড জিরোর ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করার খরচ ছিল সাড়ে ৭শ’ মিলিয়ন ডলার।
৯/১১ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ তহবিল
গ্রাউন্ড জিরোর কাছে অবস্থিত লোয়ার ম্যানহাটনে কর্মরত এবং বসবাসকারী এবং হাজার হাজার মানুষ যারা ঘটনার পরপরই সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে, সকলেই টাওয়ার থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া এবং আগুনে পুড়ে ছড়িয়ে পড়া কণার সং¯পর্শে এসেছিলেন। ২০১৮ সাল নাগাদ ১০ হাজার মানুষ যারা ৯/১১-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের ক্যান্সার ধরা পড়ে।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৯/১১-এর নিহতদের পরিবার এবং হামলায় আহত ২ হাজার ৬ শ’ ৮০ জনকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যখন জেমস জাডরোগা ৯/১১ স্বাস্থ্য ও ক্ষতিপূরণ আইনে স্বাক্ষর করেন তখন তহবিলের পুনর্নবীকরণ করানো হয়। জেমস জাডরোগা নামে নিউ ইয়র্ক সিটির একজন পুলিশ অফিসার, যিনি গ্রাউন্ড জিরোর ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষদের উদ্ধার করার পরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন, তার নামে আইনটির নামকরণ করা হয়। আইনটি ৯/১১-এর প্রথম প্রতিক্রিয়াকারী এবং বেঁচে থাকাদের জন্য স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং ক্ষতিপূরণ কর্মকা- অব্যাহত রেখেছে।
২০১৫ সালে ৯/১১ সম্পর্কিত অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য আরও পাঁচ বছরের জন্য মোট ৭.৪ বিলিয়ন ডলার তহবিল পুনর্নবীকরণ করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ তহবিলটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে অনুরোধ গ্রহণ বন্ধ করেছে। ২৯ জুলাই ২০১৯ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১১ সেপ্টেম্বর ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষতিপূরণ তহবিলের সহায়তা অনুমোদনকারী একটি আইনে স্বাক্ষর করেন যার মেয়াদ ২০৯২ সাল পর্যন্ত করা হয়। এর আগে প্রশাসকরা ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের তহবিল শেষ হয়ে যাওয়ায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সুবিধা কমিয়ে দিয়েছিলেন। ভোকাল লবিস্টদের মধ্যে জন স্টুয়ার্ট, ৯/১১-এর প্রথম প্রতিক্রিয়াকারী জন ফিল, নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ও ৯/১১ এর প্রতিক্রিয়াকারী লুইস আলভারেজ তহবিলের জন্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যিনি কংগ্রেসের সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার ১৮ দিন পর ক্যান্সারে মারা যান।
৯/১১ বার্ষিকী এবং স্মৃতিসৌধ
১৮ ডিসেম্বর ২০০১ সালে ৯/১১ হামলার বার্ষিকী স্মরণে কংগ্রেস ১১ সেপ্টেম্বরকে ‘দেশপ্রেমিক দিবস’ নামকরণের অনুমোদন দেয়। কংগ্রেস পরবর্তীতে ২০০৯ সালে ১১ সেপ্টেম্বরকে ‘জাতীয় সেবা ও স্মরণ দিবস’ হিসেবে নামকরণ করে।
১১ সেপ্টেম্বরের প্রথম স্মৃতিসৌধগুলো আক্রমণের তাৎক্ষণিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে মার্কিন দূতাবাসে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন এবং ফুলেল শ্রদ্ধা নিয়ে তৈরি হয়েছিল। গ্রেট ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ বাকিংহাম প্যালেসের গার্ড পরিবর্তনের সময় আমেরিকান জাতীয় সঙ্গীত গেয়েছিলেন। রিও ডি জেনিরো শহর, ক্রাইস্ট দ্য রিডমেয়ার ভাস্কর্যটিকে নিউ ইয়র্ক শহরের আকাশ প্রান্তকে আলিঙ্গন করে দেখানো বিলবোর্ড স্থাপন করে।
২০০২ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে হামলার প্রথম বার্ষিকীতে যেখানটাতে একসময় টুইন টাওয়ার দাঁড়িয়ে থাকত, সেখান থেকে আকাশের দিকে দুটি উজ্জ্বল আলোর কলাম তাক করে রাখা হয়। সেই ‘আলোর শ্রদ্ধাঞ্জলি’ তখন নিউ ইয়র্কের মিউনিসিপ্যাল আর্ট সোসাইটি পরিচালিত একটি বার্ষিক স্থাপনা হয়ে ওঠে। পরিষ্কার রাতে, আলোকরশ্মি দুটিকে ৬০ মাইলেরও বেশি দূর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
৯/১১-এর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি উপযুক্ত স্থায়ী স্মারক নির্বাচন করতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সাইট মেমোরিয়াল এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিজয়ী নকশা, মাইকেল এরাডের ‘রিফ্লেক্টিং অ্যাবসেন্স’ (প্রতিফলিত অনুপস্থিতি) এখন জাদুঘরের বাইরে আট একর পার্কে অবস্থান নিয়েছে। নকশায় টুইন টাওয়ারের অবস্থানের জায়গায় ফোয়ারাসহ দুটি প্রতিফলিত পুল রয়েছে।
সকল ২ হাজার ৯ শ’ ৮৩ জন নিহতের নাম পুলের চারপাশে থাকা ১৫২টি ব্রোঞ্জের প্যানেলে খোদাই করা হয়েছে, আক্রমণের দিন নিহতরা কে কোথায় ছিলেন সে অনুসারে নাম সাজানো হয়েছে। এতে করে সহকর্মী এবং একই বিমানে থাকা ব্যক্তিদের একইসঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে। ৯/১১-এর ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সাইটটি ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের মে মাসে মূল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সাইটে ‘ন্যাশনাল সেপ্টেম্বর ১১ মেমোরিয়াল অ্যান্ড মিউজিয়াম’ চালু করা হয়। মূল ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার সাইটে ‘ফ্রিডম টাওয়ার’ ২০১৪ সালের নভেম্বরে উন্মুক্ত করা হয়।
তথ্য সূত্র:
স্টাডি কনফার্মস নাইন ইলেভেন ইমপ্যাক্ট অন নিউইয়র্ক সিটি ইকোনমি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
সেপ্টেম্বর ইলেভেন: নিয়ারলি টেন থাউজেন্ড পিপল এফেক্টেড বাই সিজপুল অব ক্যান্সার, দ্য গার্ডিয়ান।
কংগ্রেস পাসেস নাইন ইলেভেন ভিক্টিম কমপেন্সেশন ফান্ড এক্সটেনশন চ্যা¤িপয়নড বাই জন স্টুয়ার্ট, সিএনএন ডট কম।
দি এনসাইক্লোপিডিয়া অব নাইন ইলেভেন, নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন।
এফএকিউ এবাউট নাইন ইলেভেন, নাইন ইলেভেন মেমোরিয়াল।
সেপ্টেম্বর ইলেভেন্থ টেরর অ্যাটাকস ফাস্ট ফ্যাক্টস, সিএনএন।
নাইন ইলেভেন ডেথ স্টাটিস্টিকস, স্টাটিস্টিকসব্রেইন ডট কম।
লেখক : লেখক ও সাংবাদিক।