জানা ছিল না হুলহুলিয়া নামে বাংলাদেশে একটি গ্রাম আছে। গ্রামটি উত্তরাঞ্চলের নাটোরে সিংড়া উপজেলায়। নাটোর সদর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রামের ১২টি পাড়ার প্রায় ২ কিলোমিটারে ছয় হাজার মানুষের বসবাস। বাংলাদেশে এমন অনেক গ্রামই আছে, কিন্তু হুলহুলিয়ার সাথে তাদের মিল নেই। তাই আলোচনায় এসেছে হুলহুলিয়া।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকেই জানলাম হুলহুলিয়ার পরিচয়। গত ৭ মে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ভেতরের পাতায় প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল ‘নাটোরে যে গ্রামে যায় না পুলিশ’। চমকে ওঠার মতো, নয় কি! সেখানে পত্রিকাটির নাটোর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ২০০ বছরেও কোনো মামলা-মোকদ্দমার জন্য পুলিশকে এ গ্রামে যেতে হয় নি। এ গ্রামে তাদের নিজস্ব নিয়ম নীতি ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামের মানুষ শতভাগ শিক্ষিত। সবার এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। যার জন্য শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। এছাড়া গ্রামটি বাল্যবিবাহ, মাদক ও যৌতুকমুক্ত। এ গ্রাম উন্নয়নে বেশ এগিয়ে রয়েছে। এ জন্য এই গ্রামটিকে সরকার আদর্শ গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই আদর্শ গ্রামে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই চোখে পড়ে বিপুল একটি গেট। যেখানে লেখা রয়েছে ‘আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া’। লেখার এখানে একটু থামি! চিন্তা করি, এমন আদর্শ গ্রাম দেশে আর আছে কি-না! দেশে কেন, এই উপজেলায় বা জেলাতেই কি আছে? আমাদের মতো অনেকেরই জানা ছিল না। তবে সরকারের জানা। কারণ সরকার জেনেশুনেই গ্রামটিকে আদর্শ গ্রাম ঘোষণা করেছে। হুলহুলিয়া আদর্শ গ্রামের প্রবেশ পথের বিশাল গেটটির গায়ে লেখা রয়েছে ‘বাস্তবায়নে জেলা পরিষদ।’ অর্থাৎ নাটোর জেলা পরিষদ সরকারি টাকায় এই গেট নির্মাণ করেছে। আর কিছু করে নি। না জেলা পরিষদ, না সরকার। করলে তো এমন গ্রামের সংখ্যা বেড়ে যেত!
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা নির্বাচিত এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি। সচিব অবশ্য সরকারি আমলা। তারা সবাই সরকারি (অর্থাৎ জনগণের) টাকায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। বেতন-ভাতা বা সম্মানি পান। বিশাল গাড়িও রয়েছে। সরকারি টাকায় গেট নির্মাণের বেশি কিছু করার চিন্তা তাদের মাথায় এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। গেটটি ২০১০ সালে করা অর্থাৎ বর্তমান সরকারের উন্নয়নের জোয়ারেই ভেসে এসেছে। কিন্তু এই আদর্শ গ্রামের দৃষ্টান্ত অনুসরণে কিছুই করা হয় নি। যাক আমরা ফিরে যাই পত্রিকার প্রতিবেদনে।
১৯৪০ সালে গঠিত হয়েছিল ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’। একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং পাঁচজন উপদেষ্টাসহ মোট ২১ সদস্য নিয়ে এর কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে। প্রতি দ্ইু বছরের জন্য একজন চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। তবে এই নির্বাচিত ও নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয় নি। ফলে অনেক কিছু জানা হলো না। নির্বাচন কমিশন আছে কি-না, সেটা কি নির্বাচিত, না মনোনিত। কেমন করেই বা তারা কাজ করেন। আর নির্বাচনই বা হয় কীভাবে। ব্যালট পেপারে সিল মেরে, না ডিজিটাল মেশিনে টিপ দিয়ে। সেটা হয় দিনের আলোয়, না-কি রাতের আঁধারে, এসবই থেকে গেল অজানাই।
২০১৬ সালে দ্ইু কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে হুলহুলিয়া গ্রামে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। হাব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। (স্থানীয় এমপি এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হওয়াতেই যে তা সম্ভব হয়েছে সেটা না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। এজন্য এই সুযোগে মন্ত্রী মহোদয়কে একটা ধন্যবাদ দেয়াই যায়!) এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এছাড়াও হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইটও রয়েছে। এ গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাই স্কুল, একটি মাদ্রাসা ও একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটি থেকে দুই শতাধিক বিএসসি প্রকৌশলী, এমবিবিএস ডাক্তার, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ছড়িয়ে রয়েছেন দেশজুড়ে। মাত্র ছয় হাজার মানুষের গ্রামে এমন শিক্ষিত জনসম্পদ! ভাবুন তো, দেশের অন্যান্য গ্রামেও যদি এমন হতো তবে দেশটা কি স্বপ্নের দেশ হয়ে যেত না! ফিরে আসি আলোচ্য প্রতিবেদনে।
এই গ্রামের বাসিন্দা রহিমউদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামে এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। এসএসসি পাসের আগে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে পারবে না। কেউ কোনো কারণে তার মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিতে চাইলে, কেন বিয়ে দিতে চাচ্ছে তা জেনে সমাধান করা হয়। বিয়ের সময় যৌতুক নেয়া ও দেয়া এখানে সম্পূর্ণ নিষেধ। আরেক বাসিন্দা আফজাল শেখ বলেন, ২০০ বছরের মধ্যে কোনো মামলা আদালতে যায় নি। কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের উন্নয়ন পরিষদের মাধ্যমে সমাধান করা হয়। ২০০ না হোক গত ৫০ বছরে কোনো মামলা হয় নি এটা তো অবিশ^াস্য ঘটনা! এমন শান্তির গ্রাম হতে পারে সেটা কয়জন বিশ্বাস করবেন? হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশ বলেন, কোনো সমস্যা হলে আমাদের নিজস্ব নিয়ম-নীতি ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়। এজন্য কোনো বিষয় নিয়ে থানা বা আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কী সংঘাতিক কথা! এ যেন রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র! জনগণের রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন রাষ্ট্রের কথা আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু সেসব মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করি নি।
বাংলাদেশের অন্য সব গ্রাম যদি এমন হতো তাহলে আমাদের আইনজীবী বন্ধুরা ঠিক কি অবস্থার মুখোমুখি হতেন সেটা ভাবা যায়! বিচারব্যবস্থা, থানা-পুলিশেরই বা কি হতো! তবে আজকের ভয়াবহ মামলা জট থেকে যে মুক্তি পাওয়া যেত, থানা-পুলিশের দৌরাত্ম থাকত না সেটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। আর দেশটা হয়ে উঠত অনন্য একটা দেশ।
প্রতিবেদনের শেষ দিকে নাটোর সিংড়া থানার ওসি নূরে আলম সিদ্দিকের বক্তব্য রয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, এ থানার দায়িত্বে আসার পর এ সময়ে কোনো মামলা-মোকদ্দমা করতে কেউ আসেন নি। হুলহুলিয়া গ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভালো। নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, ‘হুলহুলিয়া গ্রামের মতো এমন দৃষ্টান্ত যদি সারা দেশের মানুষ অনুসরণ করে, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা- মোকদ্দামা কমে আসবে। এছাড়া বাল্য বিয়ে, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে উঠবে’। এসব নিয়ে সরকারিভাবে কত কি-ই না করা হয়ে থাকে। কিন্তু হুলহুলিয়ায় যা সফল হয়েছে দেশ জুড়ে তার জন্য আদৌ কিছু করা হয়েছে কি? জেলা প্রশাসক এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেও জানা গেল না। প্রতিবেদন এখানেই শেষ হয়েছে।
ছোটগল্প শেষ হয়েও যেমন শেষ হয় না, তেমনি এই প্রতিবেদন শেষ হলেও অনেক ভাবনা জাগিয়ে তোলে মনে। আমরা যারা একটি স্বপ্নের দেশ গড়তে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, এখনও যারা একটা আদর্শ সমাজের চিন্তা করেন তারা তো এমনটাই দেখতে চাই সর্বত্র। অথচ ঘরের পাশেই যে দৃষ্টান্ত রয়েছে সেটা জানতে বা জানাতে কেউই আগ্রহী হন নি। ডিসি সাহেব অনুসরণের কথা বলেই দায়িত্ব সেরেছেন। হুলহুলিয়া থেকেও কোনো সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে নি, নেয়া হয় নি রাজনৈতিক উদ্যোগ। প্রচলিত ধারায় আমরা এতটাই আচ্ছন্ন যে, ব্যতিক্রমকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারি না।
এক সময় এদেশে হুলহুলিয়ার মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজই প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেটা প্রায় আড়াইশ বছরেরও আগের কথা। বিদেশি শক্তি এসে সেই সমাজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ শাসনে তারা এমন এক রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়ে গেছে যেখানে আমরা সব বিষয়ে উপরমুখী হয়েছি, পরনির্ভর হয়ে গেছি। বিদেশি মত-পথের পেছনে ছুটে আমরা বিভক্ত-বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। এক অন্তহীন জটিলতায় হাবুডুবু খাচ্ছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায়, আতঙ্কিত হচ্ছি। অথচ এ দেশ ছিল শান্তির দেশ। সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজ পরিচালনা করত। অনেকটা আজকের হুলহুলিয়ার মতোই। স্বশাসনেই শান্তিতে বসবাস করতেন গ্রামের মানুষ। স্বশাসনেই সুশাসন পেয়েছেন হুলহুলিয়ার মানুষও। পেয়েছেন উন্নয়নও। সামাজিক উন্নয়ন। ফলে শতভাগ শিক্ষিত গ্রাম হয়ে উঠেছে হুলহুলিয়া। শান্তির গ্রামও। নইলে কেন ২০০ বছরেও থানায়, আদালতে কোনো মামলা হলো না? ৫০ বছরই বা কম কিসে? থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারি ছাড়াই যে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হুলহুলিয়া। সেখানে নেই অশিক্ষার অন্ধকার, নেই বাল্য বিয়ের অভিশাপ। নেই যৌতুকের দুশ্চিন্তা, মাদকের ছড়াছড়ি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অভিযান ছাড়াই সেটা সম্ভব হয়েছে। কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে সেটা জানার ইচ্ছা কি কারও মনে জাগে না?
আমাদের কর্তাব্যক্তিরা ঘনঘন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সদলবলে বিদেশ সফরে যান। যান উন্নয়ন দর্শনে, প্রকল্প প্রণয়নের জ্ঞান নিতে। তারা ঘরের পাশে হুলহুলিয়া দেখেন না। নেতা-নেত্রীরাই কি দেখেন? সেখানকার মানুষ কীভাবে দলাদলি, বিভক্তি-বিশৃঙ্খলার রাজত্বের মধ্যেই শান্তিতে বসবাসের নিশ্চয়তা অর্জন করেছে সেটা জানার আগ্রহ জাগে না কারও। হুলহুলিয়ার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকার কথা জানতে পারি নি আমরা। তারা নিশ্চয়ই দলাদলির প্রাচীর তুলে জনগণকে বিভক্ত-বিভ্রান্ত করতে পারেন নি। হয়ত চান নি। যদি তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকত সেখানে তবে নিশ্চয়ই প্রতিবেদনে জানা যেত সে কথাও। অর্থাৎ প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরেই হুলহুলিয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হয়ে উঠেছে স্বপ্নের বাতিঘর।
মানুষ এমন স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসে। বাংলাদেশের মানুষও স্বপ্ন দেখেছে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়েই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। অকাতরে জীবন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে স্বাধীনতার জন্য, মুুক্তির জন্য। শান্তিতে বসবাসের জন্য । কিন্তু হায়! সে স্বপ্ন পূরণ হয় নি আজও। হুলহুলিয়া যা পেরেছে বাংলাদেশ তা পারে নি। দীর্ঘ ৫০ বছর পথ খুঁজে মরেছে। একের পর এক সরকার পাল্টেছে কিন্তু সমাজে স্বস্তি, শান্তি যে আসে নি সেটা দেশের প্রতিদিনের চিত্রই তুলে ধরে। এজন্য একে অন্যকে দায়ী করেই আমরা তৃপ্তি পাই। সমাধানের পথ জানতেও চাই না।
অথচ শান্তির জন্য মানুষ কি-না করেছে। এক নদী রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ব্যক্তি, দল, সরকার পরিবর্তন করেছে। মানুষ বারবার আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু সে আশা ভেঙে গেছে। হতাশায় ডুবেছে। দলাদলি, হানাহানিতে সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধ-বিভক্তি-বৈষম্য বেড়েছে। নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। সর্বগ্রাসী অশান্তিতে ঘুম হারাম হয়েছে। এখন আবারও একটা পরির্বতনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে দেশ। এবারে কি সেই কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে? দেশে শান্তি, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার আসবে? পারবে কি বাংলাদেশ হুলহুলিয়ার মতো আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে!
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক