‘একটা সেতু উড়াল দিলো খুললো হাজার দ্বার
একটা সেতু ভীষণ রকম অহংকার আর আত্মমর্যাদার’
অনিবার্য আশা অসীম সাহস ও বিশেষ কর্মযজ্ঞের এক অবাক বিস্ময়ের সাক্ষী হলো পুরো বিশ্ব। নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন স্বপ্ন নয় এক চিরন্তন অধ্যায়। সকাল সন্ধ্যার মতোই বাস্তব। যা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য এবং বাঙালীকে যেন একই আবেগের বন্ধনে বেঁধেছে। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নান্দনিক আশ্চর্যের নাম পদ্মা সেতু।
২৫ জুন ভোরের সূর্য অন্যদিনের চেয়ে যেন অন্যরকম সজ্জায় সজ্জিত হয়েছিল। চারদিকে সোনা ঝরা রোদ আর পদ্মার বুকে পাতাল করা ঢেউ ছড়িয়ে শুয়ে আছে একটি সেতু নাম তার পদ্মা। এ যেন ভিন্ন কোনও আবেশ অন্যরকম প্রতিবেশ। কংক্রিটের প্রাণহীন এই সেতুর মধ্যে লুকিয়ে আছে চিরায়িত বাঙালীর অকৃত্রিম আবেগ আর অপরিসীম অহংকার।
১৮ কোটি বাঙালীর ছত্রিশ কোটি চোখে আঁকা যেই ভোর অবশেষে সব পেল, দেখল, হাসল আর কানে কানে বলল, পেরেছি কী বাঙালীর মুখে হাসি ফোটাতে?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত দেশটি দেখে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি আখ্যা দিয়েছিলেন। তলাবিহীন এই ঝুড়িটি এখন ধনেমানে পরিপূর্ণ। আত্মতৃপ্তির সুযোগ থাকলে সৃজনশীলতা নষ্ট হয়। সেকারণে উন্নয়ন একটি আপেক্ষিক বিষয়। তাই সেখানে তৃপ্তির ঢেঁকুর গিলে বসে থাকার সুযোগ কম। বাংলাদেশের অর্জন এখন অনেক। ইতোমধ্যে অর্জন করেছে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা যা ২০২৬ সালে কার্যকর হবে। বাঙালীর অসীম প্রচেষ্টার ফল। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উন্নত রাষ্ট্র আর পদ্মা বহুমুখী সেতু উন্নত রাষ্ট্র গঠনে অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে তাতে সন্দেহে নেই।
শেখ হাসিনার পরিণত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞে আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ্ব দরবারে। মুক্তির লড়াইয়ে পরাজিত পাকিস্তানিকে অনেক সূচকে পিছনে ফেলে আজ বাংলাদেশে ৪১ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
কংক্রিটের তৈরি ৬.১৫ কিলোমিটার সেতু বাংলাদেশকে তুলে ধরেছে অনন্য উচ্চতায়। ইতোমধ্যেই পদ্মা সেতু কয়েকটা সূচকে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে। পদ্মার ৪২টি পিলার যেন স্পর্ধিত বাঙালীর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবার প্রতীক চিহ্ন। বাঙালীর ঐকান্তিক চাওয়াকে পুঁজি করে ৩০ হাজার ১৭৩ কোটি টাকায় গড়ে উঠেছে আমাদের এই আত্মমর্যাদার অহংকার। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে শুয়ে আছে দীর্ঘ সেতু। এটি রিক্টার স্কেলের ৯ মাত্রার ভূ-কম্পন সহনীয়। এরই মধ্যে বদলাতে শুরু করেছে গোটা দক্ষিণ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেহারা। পায়রা বন্দর ও মোংলা বন্দরে কর্মচাঞ্চল্যতার হাওয়া বইছে। দক্ষিণ অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এতদিন মানুষের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পৌঁছাতে পারে নি, এখন পদ্মা সেতুর নির্মাণের ফলে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, ষাট গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সহজে পৌঁছাতে পারবে। এছাড়া ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদী শাসনের নানারকম দৃষ্টিনন্দন সাজগোজ বাঙালীকে দেবে এক অন্যরকম মাদকতা। পদ্মা অত্যন্ত খরস্রোতা হওয়ায় দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের ঢাকায় প্রবেশে নিত্যদিনই যুদ্ধ করতে হতো। এখন ১০ মিনিটে পদ্মা পার হতে পারবে। তাতে সময় বাঁচবে সাথে সাথে পরিবর্তন হবে অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক রূপ।
দক্ষিণ অঞ্চলের মাটি উর্বর। দো-আঁশ মাটিতে বৃহৎ ফরিদপুরে প্রচুর পেঁয়াজ হয়। খুলনা, ও বাগেরহাটে চাষ হয় ভূবন বিখ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ি মাছ। ফলে মৎস ও কৃষির ন্যায্য মূল্য পাওয়া এখন সময়ের অপেক্ষা। এ সেতু যেমন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ অঞ্চলের ২১টি জেলাকে বেঁধে দিয়েছে, তেমনি এর ব্যবহার করে ভারত, নেপাল, ভুটানের সাথে সরাসরি আন্তর্জাতিক যোগাযোগ রক্ষা করা যাবে। সেকারণে এ অঞ্চলে নতুন শিল্প-কলকারখানার সৃষ্টি হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টাকা লগ্নি করবে। নতুন প্রজেক্ট স্থাপিত হলে ৪ অঞ্চলে শিক্ষিত বেকারত্বের সংখ্যা কমে আসবে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ নানা পেশায় নিয়োজিত হবে।
সুতরাং একটা পদ্মা সেতু হাজারটা দ্বার খুলতে যাচ্ছে। যে দ্বারে যার ইচ্ছে প্রবেশ করতে পারবে নিজ যোগ্যতায়। সহকারি হিসেব মতে, পদ্মা সেতুর ফলে প্রতিমাসেই পরিবর্তন হবে দারিদ্রের সূচক। দেশি-বিদেশি পর্যটক এ অঞ্চলে প্রবেশ করায় চাহিদা বাড়বে ভোগ্য পণ্যের। চাহিদা বৃদ্ধি পাবে পরিবহনের। যার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। নদীপাড়ের বিশদ অঞ্চলে শিল্প-কারখানার পাশাপাশি হাইটেক পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর এর মৎস্য কৃষি পর্যটন অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থাৎ সব খানেই উন্নয়নের অকল্পনীয় প্রসার ঘটবে।
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, কুমুদিনী সরকারি কলেজ, টাঙ্গাইল