সন্ত্রাস’ কথাটি ‘ত্রাস’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ ভয়, শংকা, ভীতি। কথাটির অর্থ দাঁড়ায় গণবিধ্বংসী কার্যকলাপ যা জনজীবনে ভীতির সঞ্চার করে এবং সাধারণ জীবন যাপন ব্যাহত করে।
জঙ্গি শব্দটি ব্যুৎপত্তিগত ভাবে ফারসি শব্দ ‘মার জঙ্গ’ থেকে এসেছে যার অর্থ যুদ্ধ। আর জঙ্গিবাদ বলতে বোঝায় একটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠী যারা যুদ্ধ বা সব কিছু জোরপূর্বক আদায়ে বিশ্বাসী। বর্তমান বিশ্বে জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদের অন্যতম রূপ। জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। ইসলামি উগ্রবাদীদের জঙ্গি বলে চিহ্নিত করলেও অন্যান্য ধর্মের লোকজনও জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। যে দেশের জন্য যারা হুমকি স্বরূপ সে দেশ বা রাষ্ট্রের কাছে তারা সন্ত্রাসী।
পশ্চিমাদের চোখে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর সুদানের দারফুরের স্বাধীনতাকামীরা মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে যারা আছেন, যেমন ইরাক, আফগানস্তান চেচনিয়া কাশ্মির- এমন কি ফিলিস্তিনের যোদ্ধারাও সন্ত্রাসী। পশ্চিমারা জঙ্গিবাদ শব্দটি দ্বারা ইসলামি সন্ত্রাসবাদকে বুঝিয়ে থাকে। এর একটি কারণও আছে। ইসলামি আদর্শ ছাড়াও যে গোষ্ঠিগুলো আছে তারা হলেন শ্রীলংকার তামিল টাইগার, ভারতের মাওবাদী, জাপানের রেড আর্মি। কিন্তু তাদের গণবিধ্বংসী কার্যকলাপ নিজ নিজ গৃহে বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ইসলামের বিকৃত আদর্শে বিশ্বাসী জঙ্গিরা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। এরা ইসলামের নামে ভুল খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এরাই উগ্রবাদী ও মৌলবাদী চিন্তাচেতনা প্রচার করে জনমনে ভীতির সঞ্চার করছে। এরা সামরিক শক্তির দিক থেকে এখন অনেক শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত।
প্রশ্ন হলো এরা কারা?
এরা ইসলামের নাম ধারণকারী এক অন্ধবিশ্বাসী গোষ্ঠী। এরা না ভালোবাসে নিজেকে, না ভালোবাসে মানুষকে, না শ্রদ্ধ করে ইসলামকে। অথচ তারা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামের যে শান্তির মর্মবানী, হয় তারা সেটা ঠিকঠাক বোঝে না, অথবা কখনও ইসলামে বিশ্বাসই স্থাপন করে নি। কেননা ইসলামে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের কোনও স্থান নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। নৈরাজ্য, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে ইসলাম সমর্থন করে না। এমন কি অন্য ধর্মের লোকেদের মর্যাদা সম্পর্কেও ইসলামের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরানে সহনশীল হতে বলা হয়েছে। হযরত মুহম্মদ (স.) ‘ধর্ম’ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
এখন মুসলমানরাও বিভ্রান্তিতে, জঙ্গিরা আসলে ইসলামের নামে কী চায়? তাদের ভয়ংকর কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে একটা হলো আত্মঘাতী হামলা। বড় বড় স্থাপনা অফিস, সরকারি দপ্তর, জনবহুল মার্কেট, এমনকি স্কুল থেকে শুরু করে মসজিদ পর্যন্ত তাদের আক্রমণের লক্ষবস্তু। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলা চালিয়েছিল আল কায়েদা জঙ্গি সংগঠন। ভয়ংকর সেই হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এখনও অনেকে সে হামলার দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আল কায়েদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।
বর্তমানে আফগানিস্তানের তালেবান গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে পর সম্প্রতি আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের কর্মকাণ্ডে জন্য আলোচনায় এসেছে। আইএস সিরিয়া-ইরাকে তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোই জঙ্গি গোষ্ঠী তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিল। অভিযোগ আছে, তারা নিজেদের অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর বিপথগামী সংগঠনগুলোকে বাছাই করে অস্ত্র বিক্রি করে। পুঁজিবাদের গর্ভেই জন্ম হয়েছে জঙ্গিবাদের। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটানোর জন্য আফগানিস্তান ও পাকিস্তানি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর জন্ম হয়। মূলত জঙ্গিবাদ হলো পরাশক্তিগুলোরই আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ।
২০০১ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক হৃদপিণ্ড টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলার পর পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক পট পাল্টে যায়। জঙ্গিবাদ বর্তমান বিশ্বের একটি গভীর সংক্রামক অসুখ। বর্তমানে বাংলাদেশেও একাধিক জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এরা বিশ্ব জঙ্গিবাদেরই নানা শাখা-প্রশাখা। জেএমবি জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং ভয়ংকর। ১৯৯৮ সালে শায়খ আব্দুর রহমান জামা’আতুল মুজাহিদীন (জেএমবি) প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ভাই ছিলেন এর শীর্ষ স্থানীয় নেতা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একই সময়ে বাংলাদেশের ৬৩ জেলার আদালত, জেলা প্রশাসন কার্যালয় ও বিভিন্ন দপ্তরসহ ৪৩৪টি স্থানে পরিকল্পিতভাবে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আতংক ছড়িয়েছিল।। এই হামলার নেতৃত্বে ছিল জেএমবি। ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিল হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা। এছাড়াও বর্তমানে সবচেয়ে সক্রিয় সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই গুলশানের হলিআর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। সেই হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছিল আইএস। যেখানে ১৭ জন বিদেশীসহ মোট ২৮ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। সারা বিশ্ব তাদের দৌরাত্ম্য দেখেছে। এই জঙ্গি সংগঠন (আইএস) সুন্নি ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল কায়েদার একটি উপদল। যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত। ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর আইএসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই জঙ্গিগোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রুপ । বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস। সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে দুশ’র বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। আইএসের নেতারা জঙ্গিগোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে। জঙ্গিগোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল ও গ্যাস। এটি এখনও সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে। আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ।
জঙ্গি সংগঠনগুলো ইসলামের নামে ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, নিজেদের সংগঠনের জন্যে সদস্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। ইতোমধ্যে সফলতা ও অর্জন করলেও ভয় রয়েই গেছে। এখনই সময় জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। যৌক্তিক বিষয়গুলো যেমন ব্যক্তিগত মূল্যবোধে ধারণ করতে হবে তেমনি র্ধমীয় নীতি ও আদর্শ সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
মূলত বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় নাইন ইলেভেনের পর। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ. বুশ ‘ওয়ার অন টেরর’ ঘোষণা করেন। জঙ্গিবাদ মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য প্রদান যাদের মূল লক্ষ্যই হলো গণবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে মাধ্যমে জনগণের আর্থিক এবং মানসিক ক্ষতি সাধন করা। ভারত, ইসরাইল, ব্রিটেন, ফ্রাস, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর নিরাপদ আস্তানা বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজনৈতিক সুবিধার জন্যই কিছু রাজনৈতিক দল আদর্শিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ার পেছনের কারণ হলো আমাদের দেশের একটা শ্রেণির মানুষের অন্ধ ধর্মীয় চেতনা। বাংলাদেশে আইএস আত্মপ্রকাশের পর নতুন করে দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এখানে নানা ধর্মীয় মূল্যবোধের বিশ্বাসী মানুষের বসবাস। ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বর্তমানে সংখ্যালঘু ধর্মীয় শ্রেণির ওপর যে আঘাত তা বিশ্ব জঙ্গিবাদের উত্থানেরই ফলাফল। হিন্দু-মুসলিম যে দ্ব›দ্ব বাংলাদেশ ও প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতের মধ্যে এখনও বিদ্যমান তা জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বকে নতুন করে মনে করিয়ে দেয় যা নতুন করে সংকটে ফেলে দিয়েছে। এখান থেকে উত্তরণ জরুরি।
লেখক: প্রভাষক, কুমুদিনী কলেজ, টাঙ্গাইল।