এমন ভয়ংকর দুর্যোগের রাত আর কখনও আসে নি ফাহমিদার জীবনে কোনোদিন। আকাশ অন্ধকার করে ছেয়েছে কালো মেঘের থোকা। বাতাসের তাণ্ডবে প্রকাণ্ড গাছের পাতারা প্রাণ ভয়ে আপ্রাণ আঁকড়ে আছে বৃন্তের আশ্রয়। হঠাৎ হঠাৎ পশলা বৃষ্টির ছাঁট এসে চড় মেরে যাচ্ছে জানালার ডাবলগেøজড কাচের মুখে। এখন সময় মাত্র বিকাল পাঁচটা, অথচ মনে হচ্ছে এলাকা জুড়ে রাত দুপুরের শুনশান নীরবতা।
ফাহমিদা বাসার ল্যান্ডফোন হাতে নিল। ফোনটা ডেড হয়ে আছে। মনে হয় বাতাসের কারণে রাস্তায় ফোনের লাইন ছিঁড়ে গিয়েছে কোথাও। মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে কয়েকটা কল করবে ভেবেছিল। কিন্তু মোবাইল ফোনে কোথাও কল করা যাচ্ছে না। কী হচ্ছে আজ চারপাশে? চেনা পৃথিবীটা কি এক বিকেলেই বদলে যাবে পুরোপুরি? অস্থির লাগতে শুরু করে ফাহমিদার। আগে কখনও সে এমন অবস্থায় পড়ে নি।
এখন একটা ট্যাক্সি দরকার। ইমার্জেন্সি। হাসপাতালে যেতে হবে। বাচ্চাটি জন্মানোর কথা ছিল আরও তিন সপ্তাহ পর। কিন্তু এমন একটা দিন দেখেই বুঝি পেটের বাচ্চা পৃথিবীতে আগমনের জন্য তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে!
ফাহমিদা আগে থেকে গুছিয়ে রাখা ডেলিভারির ব্যাগটি ঘাড়ে নিয়ে ঘরের দরজা ভালো করে লক করে অস্বস্তিকর শরীরটাকে সাবধানে নাড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। দমকা বাতাসে রাস্তার ওপর ভেঙে পড়ে আছে বিভিন্ন গাছের মাঝারি ও বিশাল আকৃতির ডালপালা। রাস্তার পাশের সিকামোর ছোট্ট পাতাগুলো বৃষ্টির ফোঁটার মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছে এখানে সেখানে। কয়েকটি পাতা এসে ফাহমিদার মুখে ও শরীরে লাগে। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে থেকে আবার বৃষ্টির ঝাপটার সাথে দমকা বাতাসের ঢেউ এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে চারপাশ।
ফাহমিদার বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে করে গেলে হাসপাতাল যেতে সময় লাগে ১৫ মিনিট। এখন অবস্থা যেমন দেখা যাচ্ছে, মনে হয় না ট্যাক্সি পাওয়া যাবে রাস্তায়। আর যদি হেঁটে পৌঁছতে হয় তাহলে কম করেও এক ঘন্টা লেগে যাবে। কিন্তু আর কোনো পথ দেখছে না সে। হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছুতেই হবে তাকে, যেমন করেই হোক না কেন। ডেলিভারির নির্ধারিত ডেইটের তিন সপ্তাহ আগে লেবার পেইন উঠে যাওয়া মানে নিশ্চয়ই কিছু ভালো লক্ষণ নয়। আবহাওয়ার এই বিদ্রুপপূর্ণ অসহযোগিতার মাঝেও ফাহমিদা মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করে, পেটের ভেতর বাচ্চার ব্যাগের পানি ভেঙে গেলে কঠিন বিপদ হবে।
ঝড়ের রাত, বাতাস, অন্ধকার, গাছেদের দীর্ঘ ছায়া পুরো সড়কের উপর ভূতুরে এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফাহমিদা লক্ষ্য করে রাস্তায় একটিও মানুষ নেই। এমনকি একটি গাড়ি পর্যন্ত নেই। মনের ভেতর আশার আলো জ্বালিয়ে রেখে সে নিজের বিশাল পেটের ভার টেনে টেনে কয়েকশ’ পা সামনে এগিয়ে যাবার পর মনে হলো, সে এসেছে। আকাশের মেজাজি বজ্রপাতের আলোর সাথে মনে হলো একটা মোটর গাড়ির হেড লাইটের ঝাপসা আলো এগিয়ে আসছে দূর থেকে। খুব ধীরে।
ফাহমিদা ফুটপাথ থেকে নেমে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়। প্রাণ বাঁচানো গাড়িটি কাছে আসতেই সে দুই হাত উঁচু করে বারবার নাড়তে থাকে। তার সাহায্য প্রয়োজন। গাড়িটি ফাহমিদার ঠিক গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কালো ফিয়াটের ভেতর একজন বৃদ্ধ চালককে দেখা যাচ্ছে। মোটা জ্যাকেট গায়ে আর মুখের বেশিরভাগটুকু ঢেকে আছে মাথার টুপিটির ভেতর।
ভদ্রলোক ফাহমিদাকে হাত ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলে। নিজের ভারী শরীরটিকে পেঁচিয়ে বাঁকিয়ে অনেক কষ্টে সে ছোট্ট ফিয়াটের সামনের সিটে ঢুকিয়ে দিল। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে বাচ্চাটি পেট থেকে বেরিয়ে আসবে। মনে মনে দোয়া পড়তে থাকে ফাহমিদা, গাড়ির ভেতরেই যেন ডেলিভারি হয়ে না যায় আবার। কয়েক মিনিট পরপর কন্ট্রাসেপশন পেইন উঠছে। আর একটু পরপর ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে গুঙিয়ে উঠছে। সিটের উপর বাঁকা হয়ে পড়ে থেকে কোনো রকমে শুধু বলে, হাসপাতাল প্লিজ।
সিট বেল্ট বাঁধার কোনো চেষ্টা করল না সে। শোঁ শোঁ বাতাসের ভেতর দিয়ে গাড়িটি যতটা সম্ভব ¯িপড তুলে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। সামনের উইন্ডস্ক্রিনে ভোঁসভোঁস করে ওয়াইপার ওঠানামা করছে। চারপাশের বাড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে হ্যালোইনের গমগমে আওয়াজ। ফাহমিদার মনে পড়ল, আজ অক্টোবরের শেষ দিন- আজ হ্যালোইন নাইট। আজকে যাদের বাড়ির বাইরে যাবার প্রয়োজন পড়বে না তারা খুব খুশি হবে এমন একটি রাতে এই রকম আপনাআপনি ভূতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলে। হ্যালোইন রাতের যথার্থ অনুভূতি।
ফাহমিদা গাড়ির চালকের সাথে দুই একটা কথা বলার চেষ্টা করে, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে সাহায্য করার জন্য। আপনাকে না পেলে আমার যে কী ভীষণ বিপদ হতো আজ, ভাবতেই পারছি না।’
কথা শেষ করেই আবার সে ব্যথায় ককিয়ে ওঠে। বৃদ্ধের উত্তর শোনার সময় পেল না। রাস্তায় একটি গর্তের উপর চাকা পড়ায় গাড়িটি কেমন লাফ দিয়ে উঠল বার দুই। বৃদ্ধ গাড়িতে রেডিও অন করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রেডিওতে কথা শোনা যাচ্ছে না। শুধু ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে শব্দ ভেসে আসছে যন্ত্রটির ভেতর থেকে। বাইরে প্রাকৃতিক বৈরিতার শব্দের সাথে রেডিওর যান্ত্রিক শব্দ তান্ত্রিকের মন্ত্র পড়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ফাহমিদা মাথা পেছন দিকে বাঁকিয়ে সিটের সাথে পিঠ ঘষে নিল কয়েকবার। মেরুদণ্ডের একেবারে নীচে খুব ধারালো কিছু দিয়ে ঘাই মারার মতো তীক্ষ্ণ ব্যথা হচ্ছে থেকে থেকে। হা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বুক ভরে ফেলার চেষ্টা করল। তারপর আবার বলল, ‘আপনি কি এই এলাকাতেই থাকেন? আমি নাইথে থাকি গত পাঁচ বছর ধরে।’
বৃদ্ধের কাছ থেকে কোনো উত্তর শোনা গেল না এবারেও। খুব মন দিয়ে গাড়ির ব্যালেন্স ঠিক রাখার চেষ্টা করছে সে। ফাহমিদার দিকে তাকালোই না। গাড়িটিকে সাবধানে চালিয়ে সামনে নিয়ে যাওয়াতেই তার পূর্ণ মনোযোগ বোঝা যাচ্ছে। ফাহমিদা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে অন্ধকারে বৃদ্ধের মুখটি দেখতে। কিন্তু লাভ হলো না।
‘সাব্বির, আমার হাসব্যান্ড। ওর একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় সে আজ অক্সফোর্ডে গিয়েছে। মনে হয় সেও ফিরতে পারছে না এমন অবস্থা দেখে। আপনাকে আজ সময়মতো রাস্তায় না পেলে ভীষণ বিপদে পড়ে যেতাম আমি, সত্যি। বাড়িতে আর কেউ নেই। আমার মোবাইল ফোনও কাজ করছে না কেন বুঝতে পারছি না।’ অনেকগুলো কথা বলে হাঁপাতে শুরু করে ফাহমিদা।
রাস্তা যেন শেষই হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে উড়ে চলে যায় হাসপাতালের দরজায়। কোনো রকমে একবার ওখানে পৌঁছতে পারলেই সব দুশ্চিন্তার সমাধান হয়ে যাবে।
বৃদ্ধ চালক নিজের সিটে বার কয়েক শরীর নড়াচড়া করে শুধু, কিন্তু পুরো রাস্তা সে নীরব হয়েই থাকে। একটা জীবন্ত নিঃশব্দ পাথর যেন। হঠাৎ করে ফাহমিদা লক্ষ্য করে গাড়িটি হাসপাতালের রাস্তায় যাচ্ছে না। পাশ কেটে আরেকটি সাব রোড ধরে এগোতে শুরু করেছে। ভয়ে আঁতকে ওঠে ফাহমিদা। কোনো খারাপ লোকের গাড়িতে উঠে পড়ে নি তো আবার! শরীরে ঘাম হচ্ছে খুব। গলা দিয়ে আর একটিও শব্দ বের হতে চাইছে না। কন্ট্রাসেপশনের ব্যথায় হোক অথবা ভয়েই হোক, ফাহমিদার গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি।
হাত দিয়ে লোকটিকে ঝাঁকা দিতে যাবে এমন সময় আরেকটি কন্ট্রাসেপশনের ঢেউ এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ফাহমিদাকে। ব্যথায় পিঠ বাঁকা করে পড়ে থাকল কয়েক মিনিট। হয়ত তখন সেন্সলেসই হয়ে পড়েছিল গাড়িতে।
তারপর সম্বিৎ ফিরে পেল যখন, তখন আবিষ্কার করে গাড়িটি তার পরিচিত গ্রেট ওয়েস্টার্ন হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তখনও বাইরে ঝড় বাতাস চলছে আগের মতোই। হালকা নীল ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন নার্স স্ট্রেচার নিয়ে এগিয়ে এসেছে গাড়ির কাছে। দক্ষ নার্স সহজেই গাড়ির ছোট দরজাটি দিয়ে বের করে আনল ফাহমিদার ভারি শরীরটিকে। পায়ের জুতো জোড়ার একটা কোথায় খুলে পড়ে গিয়েছে বলতে পারবে না।
গাড়ি থেকে নামার সময় বৃদ্ধ চালক কাঁপা হাতে ফাহমিদার কোটের পকেটে কিছু একটা গুঁজে দিয়েছে, খসখসে আর মায়াভরা গলায় বলেছে ‘তোমার বাচ্চার জন্য একটা উপহার।’
এই প্রথম ফাহমিদা চালকের মুখ দেখতে পেল। অস্পষ্ট আলোতেও মুখটা কেমন পরিচিত মনে হয়। কিন্তু ঠিক নির্দিষ্ট করে চিনতে পারল না। এরপর হাসপাতালের ভেতরে শুরু হয়েছে অনেকগুলো পায়ের ত্রস্ত ছোটাছুটি। ডেলিভারি স্যুইটের করিৎকর্মা ডাক্তার, মিড ওয়াইফ, নবজাতকের নাড়ি কাটা, শিশু কণ্ঠের কান্না, পেইনকিলারের আচ্ছন্নতা এইসব কিছুতে ভয়ংকর দুর্যোগপূর্ণ রাতটি পার হলো ভীষণ ব্যস্ততায়।
সন্ধ্যা থেকে পেয়ে বসা ভয়টি গায়েব হয়ে গিয়েছে ফাহমিদার মন থেকে। ডেলিভারির সময় দেয়া পেথিড্রিনের কারণে খুব ঘুমিয়েছে সারারাত। পরদিন সকালে চোখ মেলে দেখে হাসপাতালে ওর বিছানার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে সাব্বির। পশমি স্লিপ স্যুট পরা একটা ছোট্ট বাচ্চা তার কোলে। ফাহমিদাকে চোখ খুলতে দেখে সাব্বির বলে, ‘এখন কেমন লাগছে তোমার?’
মিষ্টি করে হাসে ফাহমিদা। বাচ্চাটিকে জন্ম দিতে গিয়ে খুব পরিশ্রম গিয়েছে তার শরীরের ওপর দিয়ে। তাছাড়া গতকালকের অমন নজিরবিহীন আবহাওয়ায় হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছুতে পারা! মুখের রঙ অনেকটাই ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ফাহমিদার। বলল, ‘অনেকটাই ভালো বোধ করছি এখন।’
বাচ্চাটিকে সাব্বির ফাহমিদার কোলে তুলে দেয় সাবধানে। মানুষের বাচ্চা, অথচ যেন একটা পাখির সমান ওজন। হাতের আঙ্গুলগুলো ভীষণ চিকণ, নারকেল গাছের পাতার মতো মনে হয় ফাহমিদার কাছে। পুঁটুলি পাকানো ক্ষুদ্র মানুষটি চোখ খুলে গোলগোল করে তাকিয়ে দেখছে ফাহমিদাকে। বেশ পাকা লাগে চোখের দৃষ্টি।
সাব্বির হেসে বলে, ‘তোমাকে দেখছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের ছেলেটি দেখতে তোমার বাবার মতো হয়েছে। দেখ, কপালের দিকটা আর চোখগুলো, একদম বাবার মতো।’
কথাটি শুনে ফাহমিদা খুশি হয়ে যায়। ওর আব্বা মারা গিয়েছে অনেক বছর আগে। ফাহমিদা তখন মাত্র কলেজে পড়ে। চারপাশের সব বন্ধুবান্ধবদের বাবা ও মা দুজনই বেঁচে আছে, অথচ ফাহমিদার বাবা বলা কওয়া ছাড়াই ঘুমের ভেতর স্ট্রোক করে মরে গেল।
বাবা চলে যাবার পর পৃথিবীর ভয়ানক বাস্তবতা নখে আঁচড়ে দিয়েছে ফাহমিদার জীবনটাকে। চারপাশে কাছের মানুষজনদের বদলে যাওয়া চেহারাগুলো এখনও রাক্ষসের মতো এসে হানা দেয় ওকে স্মৃতির পাতা থেকে। দুঃখের দিনগুলো যদিও অনেক দুঃখের স্মৃতি দিয়ে যায়, কিন্তু প্রকৃত প্রিয়জন আসলে কে বা কারা সে কথাও জানিয়ে দিয়ে যায় নির্মম বিচারকের মতো।
ভয়াবহ সেই দিনগুলোর সাথে কিছুটা তুলনা চলে গতকাল রাতের অভিষঙ্গ মুহূর্তের। ভাগ্য ভালো ছিল বলে সাব্বিরের মতো একজন মানুষকে সে নিজের জীবনে পেয়েছিল, যে তাকে সব দুঃস্বপ্ন থেকে বের করে এনে সুখি আলোর জগৎ দেখিয়েছে।
বাচ্চাটিকে নিজের কোলে তুলে নিল আবার সাব্বির। ওয়ার্ডের টেলিভিশনে বিবিসির নিউজ চলছে। পুরো এলাকায় গতকালের ক্ষয়ক্ষতির ভিডিওর সঙ্গে উত্তেজিত সংবাদ পাঠিকার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। দেশের দক্ষিণ দিকে একটি টর্নেডোর আঘাত হওয়ায় গতকাল রাতে আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় চরম দুর্যোগ দেখা গিয়েছে। বিবিসির সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ফাহমিদাদের বাড়ি থেকে হাসপাতালে আসার রাস্তায় পরপর তিনটি বৈদ্যুতিক পিলার ভেঙে পড়ায় রাস্তাটি বিকেল থেকে আজ ভোর পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তাছাড়াও রাস্তার ওপর উপড়ে পড়েছিল কয়েকটি গাছ। বাস স্টপের যাত্রী ছাউনি উড়ে গিয়েছে কয়েকটা। সকাল থেকে কাউন্সিলের লোকজন রাস্তা পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত রয়েছে।
‘আচ্ছা, অমন দুর্যোগের ভেতরে তুমি হাসপাতালে আসলে কেমন করে? এখানকার নার্সরা বলল তোমাকে একজন বুড়ো মতন লোক হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে?’
গতরাতের কথা মনে করে শিউরে ওঠে ফাহমিদা, ‘আর বলো না। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন আমাকে। ফেরেশতাকে পাঠিয়েছিল আমার জন্য। নইলে কী যে হতো, ভাবতেই পারছি না।’ চোখ বন্ধ করে ফেলে ফাহমিদা।
‘আমি খুব স্যরি। তোমাকে রেখে অক্সফোর্ডে যাওয়া ঠিক হয় নি আমার। কিন্তু দিনের ঝকঝকে সূর্যটা ওপাশে গিয়েই যে এমন রূপ বদলে ফেলবে কে জানত!’ সাব্বির বলে।
‘আমি তোমাকে মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করেছি। লাইন যাচ্ছিল না কিছুতেই। বাসার ল্যান্ডফোনও ডেড হয়ে ছিল। একটা ট্যাক্সি কল করতে পারছিলাম না। পাশের বাড়ির কয়েকটি দরজায় অনেকক্ষণ ধরে ধাক্কালাম। গলা ফাটিয়ে ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু কেউ বাড়ির দরজা খোলে নি। মনে হয় ঝড়ের শব্দে কেউ আমাকে শুনতেই পায় নি।’ সাব্বির এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল ফাহমিদার দিকে, ‘নাও একটু পানি খাও। আস্তে আস্তে কথা বলো। তোমার শরীরটা এখন ভালো নেই।’
দুই ঢোক পানি খেয়ে ফাহমিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বাচ্চাটি সাব্বিরের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। টুকটুকে সুন্দর একটা মুখ। গাল দুটো খুব মিষ্টি, গোলাপি। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও চোখ ফেরানো যাচ্ছে না বাচ্চার মুখ থেকে।
ক্লান্ত লাগছে ফাহমিদার। পানির গ্লাসটি সাব্বিরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে আবার চোখ বুজল সে। ঘুমে ভেঙে যাচ্ছে চোখের পাতা।
আধো ঘুমে ছোট্ট একটা স্বপ্ন দেখে ফেলল ফাহমিদা। সে তখন হাইস্কুলে পড়ে। ক্লাস নাইনে। মাত্র সাজসজ্জা করা শিখেছে। স্কুলের বান্ধবীদের জামাকাপড় দেখে নিজের কাপড় চোপড়ের স্টাইলও বদলে ফেলতে শুরু করেছে। বাবা ওকে বাজারে পাড়াতো মামার টেইলারিং শপে নিয়ে গিয়েছে। মেয়ের পছন্দ মতো কয়েকটি জামা বানিয়ে দেবেন।
ফাহমিদা অনেকদিন পর বাবাকে স্বপ্নে দেখছে আজ। নিজে এখন মা হয়েছে বলেই হয়ত বাবার কথা মনে পড়ছে বেশি করে। মামার দোকানে ক্যাটালগের ডিজাইন দেখে জামা বানাতে দিয়ে ফাহমিদা বাবার সাথে রিকশা করে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কী খুশির একটা নিশ্চিন্ত ভাব ফাহমিদার মনে। আব্বা আছে পাশে। ওর আর চিন্তা কী!
সাব্বিরের হাতের আলতো ধাক্কায় চোখ খুলে তাকায় ফাহমিদা। সাব্বির বলে, ‘স্বপ্ন দেখছিলে নাকি?’
ফাহমিদার বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। দুই চোখ থেকে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়তে থাকে টলটলে অশ্রুধারা। গোঙানির মতো বলল, ‘হুম, আব্বার সাথে রিকশায় করে ঘুরছিলাম। কেন আমাকে ডাকলে তুমি? আরেকটু থাকতাম আব্বার সাথে।’
সাব্বির বলে, ‘স্যরি। আসলে তুমি কেমন ফুঁপিয়ে কাঁদছিলে। আমার মনে হলো তোমাকে আবার বোবায় ধরল নাকি!’
কান্নার ভেতরেও হেসে ফেলে ফাহমিদা। ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ঘুম ভাঙিয়েছ যখন, দেখ এক কাপ চা খাওয়াতে পারো নাকি আমাকে?’ অনেক ধকলের পর এখন এক মগ ফুটন্ত পানির জন্য মনটা ছটফট করে উঠেছে ফাহমিদার। বিছানায় খুব একটা নড়াচড়াও করে পারছে না। তলপেটে ব্যথা হচ্ছে।
‘আচ্ছা দেখছি। পাশেই একটা রেস্টরুম আছে ভিসিটরস আর পেশেন্টসদের জন্য। ওখানে চা কফির ব্যবস্থা আছে দেখেছি।’ সাব্বির চায়ের খোঁজে বেরিয়ে গেল ওয়ার্ড থেকে।
ফাহমিদা খাটের পাশে বেবিকটে ঘুমিয়ে থাকা বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। ঘুমের ভেতর বাচ্চাটি একটু পরপর কত রকম মুখ করছে। ঠোঁট গোল করছে। হাসছে। চোখ পিটপিট করছে। চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলছে। হাসপাতালের নার্স পাতলা ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে বাচ্চাকে কেমন করে পেঁচিয়ে রেখেছে একটা জাপানিজ পুতুলের মতো। বø্যাঙ্কেটের ভেতরে বাচ্চার হাত পা সব আটকানো। এতে নাকি বাচ্চারা মনে করে এখনও তারা মায়ের পেটের ভেতরেই আছে। আর তারা ভালো ঘুমায়।
বারো তলার ওপর হাসপাতালের জানালা দিয়ে উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশের বুকে ধবধবে সাদা মেঘ। মন ভালো করে দেওয়া একটা দিনের শুরু যেন। এই রকম আকাশে পাখিরা উড়ে বেড়ায় মনের আনন্দে। নিজেকে পাখির মতো নির্ভার লাগছে ফাহমিদার।
দুইটি চায়ের মগ হাতে নিয়ে সাব্বির ওয়ার্ডের পর্দা ঠেলে ঢোকে। স্ত্রীর দিকে একটি মগ এগিয়ে দিয়ে অন্যটিতে নিজে চুমুক দিল। সাব্বিরকে ভীষণ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। প্রথম সন্তানের বাবা হয়ে ব্যাপক গর্বিত লাগছে তার নিজের কাছে, ‘আচ্ছা, তোমাকে গাড়িতে করে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে যে লোকটি, তার মোবাইল নাম্বার রেখেছ তো। উনাকে একদিন আমাদের বাসায় খেতে ডাকব।’
‘উনি কোনো নাম্বার দেন নি,’ বলেই ফাহমিদার মনে পড়ল বৃদ্ধের দেয়া উপহারটির কথা। চেয়ারের পেছনে ঝোলান কোটের দিকে ইশারা করে ফাহমিদা বলল, ‘কোটটা দাও তো আমার কাছে।’
সাব্বির মোটা কোটটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে চায়ের মগটি টেবিলের ওপর রাখে। ফাহমিদা কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনে গতরাতে বৃদ্ধের দেয়া উপহারটি। পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে এক টুকরো কাপড়ে মোড়ানো একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। তার ভেতরে খুব পুরনো একটা সোনার চেইন। চেইনটিকে বের করে লম্বা করে ঝুলিয়ে ধরে ফাহমিদা। বেশি লম্বা হবে না। বাচ্চাদের গলায় পরানোর মতোই। তবে বেশ ভারি। চেইনের ভেতর একটি ছবি সাঁটা লকেটও আছে। সাব্বির লকেটটি নিজের হাতে নিয়ে সাবধানে দুইপাশ খুলে ফেলল। ভেতরের ছবিটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে। কিছুটা চমকে উঠেছে যেন। হাত বাড়িয়ে লকেটটি ফাহমিদার দিকে এগিয়ে দিল।
সাইড টেবিলে চায়ের মগটি রেখে হাসিমুখে নিজের হাতে নেয় চেইনটাকে ফাহমিদা। কিন্তু লকেটের দিকে কয়েক পলক দেখতেই গা বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত নেমে যায় শিরশির করে। ছবিতে এই বড় বড় গোল চোখের মেয়েটি তার চেনা। খুব পরিচিত। ছোটবেলায় ফাহমিদার একটা জন্মদিনে ওর বাবা উপহার দিয়েছিল এই লকেটসহ চেইনটি। লকেটের ঢাকনার ভেতরে লাগানো আছে ওর সাত বছর বয়সের একটা রঙিন ছবি। এবার বিদ্যুৎ চমকের মতো ফাহমিদার চোখে ভেসে ওঠে বৃদ্ধ ড্রাইভারের মুখটি। এখন যেন সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মুখটিকে। এতটুকু কষ্ট হলো না চিনতে। কুড়ি বছর পড়ে হলেও কিছুতেই ভুল হবার কথা নয় এই মুখ। লকেটটিকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ফাহমিদার চোখ ভরে ওঠে অশ্রুতে। অস্ফুটে বলল শুধু, ‘আব্বা!’