অনুবাদ: ম্যাগডিলিনা মৃ
[মুণ্ডা দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম বড় আদিবাসী জনগোষ্ঠী। ভারতের ঝাড়খণ্ড ছত্রিশগড় রাজ্যেও ছোটনাগপুর অঞ্চল, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে রয়েছে তাঁদের বসতি। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে অল্প সংখ্যক মুণ্ডা জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে । তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। মুণ্ডা জনগোষ্ঠী যে ভাষায় কথা বলে, সেটিকে মুণ্ডারি ভাষা বলা হয়।]
তিন ফোঁটা হাঁড়িয়া
তিন ফোঁটা রক্ত বহু আগে ঘন বন জঙ্গলেই মানুষের বসতি ছিল। ধীরে ধীরে সে বসতি হয়ে উঠে গ্রাম। বনের মধ্যেই ছিল তাঁদের শস্যাগার, কৃষি জমি। সেই সময়ে লোকেরা আগুনের পূজা করত। তো একদিন এক লোক বনের মধ্যে চাষ করা ধান কাটতে গেল। মুহূর্তেই সাদা পোশাকে এক ব্যক্তি সেখানে হাজির। সে দাঁড়িয়ে ধান কাটতে থাকা সেই কৃষককে বললেন, যে বছর তুমি আমার নামে তিন ফোঁটা হাঁড়িয়া ও তিন ফোঁটা রক্ত দান করবে, সে বছর তোমার প্রচুর ধান হবে। তারপর সাদা পোশাক পড়া লোকটি নিজের নাম তপা বলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সেই কৃষক সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পর ঘটনাটি তাঁর স্ত্রীকে জানাল। পরের দিন তার স্ত্রী নিজের হাতে হাঁড়িয়া তৈরি করে সকাল সকাল স্নান শেষ করে একটা মোরগ আর হাঁড়িয়া নিয়ে বনের ভেতর কৃষি জমির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারা দূরে সেই সাদা পোশাক পড়া তপাকে দেখতে পেল। কৃষক আর তার স্ত্রী দ্রুত পায়ে তপার দিকে এগুতে লাগল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তারা দেখল সাদা পোশাক পড়া তপা উধাও হয়ে গেছে।
সামনে এগিয়ে গিয়ে কৃষক দ¤পতি দেখলেন কিছু লোক শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালিয়েছে। তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন তপাকে দেখেছে কিনা? সেই লোকগুলো বলল, তপাই এই আগুন জ্বালিয়েছে। কৃষক দম্পতির হাতে এক মটকা হাঁড়িয়া আর আস্ত একটি মোরগ দেখে তপা অবাক হয়ে তাদেরকে বলল, আমি চেয়েছিলাম তিন ফোঁটা আর তোমরা কিনা আস্ত একটা মোরগ আর পুরো এক মটকা হাঁড়িয়া নিয়ে এসেছ! তপা খুব খুশি হলো। কৃষক তৎক্ষণাৎ সেখানে মোরগটা জবাই করে তিন ফোঁটা রক্ত এবং মটকা থেকে তিন ফোঁটা হাঁড়িয়া ফেললেন। তপা তারপর কৃষককে বললেন, আর এক ফোঁটাও লাগবে না। এখন আস্ত মুরগী আর মটকার হাঁড়িয়া সব তোমাদের। এরপর তপা একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে আর কখনো বনে দেখা গেল না।
কৃষক বাড়ি ফিরে রীতিমতো আগুনের পূজা করলেন। সে বছর থেকে তার জমিতে এত ধান আর ফসল হয়েছে যে সে অনেক ধনী হয়ে গেল। আজও ঝাড়খণ্ডের মুণ্ডা জনগোষ্ঠীরা ধান কাটার সময় তপাকে উৎসর্গ করে তিন ফোঁটা হাঁড়িয়া ও তিন ফোঁটা মোরগের রক্ত মাটিতে ফেলে পূজা করে।
ত্যাগের ফল
অনেক অনেক আগের কথা। এক গ্রামে হতদরিদ্র এক বৃদ্ধ দম্পতি ছিলেন। তাদের একটি ছেলে সন্তান ছিল নাম চতুর। খুব অল্প বয়সেই চতুরের বাবা-মার মৃত্যু হলো। চতুর খুব অসহায় হয়ে পড়ে। উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই তাকে জীবিকার সন্ধানে বের হতে হয়। গ্রামের কিছু বয়স্ক লোক চতুরকে সাহায্য করার চেষ্টা করলেও আত্মমর্যাদাশীল চতুর রাজি হয় নি। সে কারো দয়া কিংবা করুণা নিতে রাজি ছিল না। সে গ্রামরে বাইরে তার বাবা মার পরিচিত একটা লোকের কাছে গিয়ে চাকরি চাইল। লোকটি চতুরের আগ্রহ দেখে আর একাগ্রতা দেখে চাকরি দিল।
চতুর সবসময় পরিশ্রমের মাধ্যমে তার মনিবকে খুশি রাখার চেষ্টা করত। সময় বয়ে যাচ্ছিল। প্রায় তিন বছর কেটে গেল। অনেকদিন নিজের গ্রামের বাইরে চাকরি করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে চতুর। প্রায় তার সুন্দর গ্রাম আর গ্রামের বন্ধুদের কথা হলে মনে মন খারাপ হয়ে যেত। শেষমেষ চতুর বেশ কিছুদিনের ছুটি নিয়ে নিজের গ্রামে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল। সে তার মনিবের কাছ থেকে তিন পয়সা মজুরি এবং কয়েক মাসের ছুটি নিয়ে গ্রামের পথে রওনা হলো। পথে এক বৃদ্ধের সাথে তার দেখা। চতুরকে দেখে বৃদ্ধ লোকটি অনুরোধ করে তাকে কিছু খাবার কিনে দিতে বলল। তিনি তিন চারদিন ধরে অনাহারী। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে চতুরের বাবা মায়ের কথা মনে হলো। এদিকে চতুর নিজেও যাত্রাপথে কিছু শুকনো খাবার খেয়েছিল। তবুও সে পকেট থেকে তার আয়ে তিন পয়সা সেই বৃদ্ধ লোকটিকে দিয়ে দিল।
এরপর সেই বৃদ্ধটির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর আসার পর চতুর খেয়াল করল লোকটির খালি মুখে ধীরে গোঁফ গজিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখে সে খুব ভয় পেয়ে গেল । ভয়ে কাঁপতে লাগল। চতুরকে ভয় পেতে দেখে লোকটি চতুরকে অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় পাচ্ছ কেন? তোমাকে সাহসের সঙ্গে, বিশ্বাস নিয়ে যে কোনো ঘটনা মোকাবেলা করতে হবে। তুমি খুব দয়ালু ছেলে। তোমার দয়া দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কোনো লাভ ছাড়াই তুমি তোমার সমস্ত উপার্জনের টাকা আমাকে দিয়ে দিয়েছ। তোমার দানের তিন পয়সার বদলে আমিও তোমাকে তিনটা জিনিস দিতে চাই। এসো, আমার সাথে এসো।’
চতুর ভয়ে ভয়ে লোকটির পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল। বাড়িতে নিয়ে এসে গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ লোকটি চতুরকে একটা সারঙ্গী দিল আর বলল এটা বাজালেই দেখবে মানুষ নাচতে শুরু করবে। তীর-ধনুক দিয়ে বলল, এটা দিয়ে যা কিছু লক্ষ্য কর মারবে সে লক্ষচ্যুত হবে না এবং সেটি পুনরায় তোমার কাছে ফিরে আসবে। আর তৃতীয় যে জিনিসটি তোমাকে দিব সেটি হলো সত্য। কখনো মিথ্যে বলবে না, জীবনে যত বিপদেই পড় না কেন। তুমি যা বলবে, মানুষ তা সত্য বলে মেনে নেবে।
এরপর বৃদ্ধ লোকটি উধাও হয়ে গেল। চতুর প্রথমে খুব ঘাবড়ে গেলেও পরে সেখানে কিছুক্ষণ সাহসের সাথে অবস্থান করে ধীরে ধীরে আবার গ্রামের পথে রওনা হলো।
কিছুদূর যাবার পর চতুর দেখল এক বণিক গাছের ছায়ায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। সেই গাছে একটা সুন্দর পাখি বসেছিল। সেটা দেখে বণিকের মনে খুব লোভ হলো। চতুরের কাছে তীর-ধনুক দেখে বণিকটি চতুরকে পাখিটা শিকার করে দেওয়ার কথা বলল এবং বিনিময়ে অনেকগুলো মুদ্রা দেওয়ার প্রস্তাব দিল। চতুর বণিকটিকে আশ্বাস দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সেই পাখিটিকে তীর মেরে আহত করল। পাখিটি ঝোপের মধ্যে পড়ে গেল। চতুর আনন্দে মেতে উঠল। সে আনন্দের সঙ্গে তাকে দেওয়া সারেঙ্গীটি বাজাতে শুরু করল। বণিক তড়িঘড়ি করে ঝোপে ঢুকে গেল পাখিটিকে ধরতে। চতুর খুশিতে তার সারেঙ্গী বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছে। এদিকে সারঙ্গীর আওয়াজ এমন মোহনীয় ছিল যে বণিকও কাটাঘেরা ঝোপের ভেতর নাচতে শুরু করে দিল।
ঝোপের গাছপালা আর কাঁটার সাথে জড়িয়ে তার জামাকাপড় ছিঁড়ে গেল। প্রায় অর্ধ নগ্ন অবস্থায় বণিক ঝোপের ভেতর থেকে আহত পাখিটি ধরে আনে। বণিকের শরীরে আঁচড়ের দাগ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। বণিকের অবস্থা দেখে চতুরের করুণা হলো। সে সারেঙ্গী বাজানো বন্ধ করে দিয়ে বণিকের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইল। বণিক খুশি হয়ে চতুরকে টাকা ভর্তি একটি ব্যাগ হাতে ধরিয়ে বিদায় দিয়ে দিল। বেতনের সব টাকা বৃদ্ধকে দিয়ে চতুর প্রায় খালি হাতেই গ্রামে ফিরছিল। পুরস্কার হিসেবে টাকা ভর্তি ব্যাগ পেয়ে আনন্দে প্রায় আত্মহারা হয়ে গেল। মনে মনে সেই বৃদ্ধকে ধন্যবাদ দিতে লাগল।
এদিকে আবেগের বশে টাকা হাত থেকে ফসকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বণিক ভাবলো কাজটা তার ঠিক হয় নি। টাকা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য সে চতুরের পিছনে দৌড়াতে লাগল। চতুরের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সে চেঁচিয়ে হাঁক দিতে লাগলো- কে আছ তাকে ধর। এই ছেলেটা আমার টাকার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে গ্রামবাসীরা চতুরকে চারপাশ থেকে ছুটে এসে ধরে ফেলল। তারা মারধর করে চতুরকে পাশেই থানায় সোপর্দ করল। থানায় পুলিশের এক অফিসার চতুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে চতুর সেই অফিসারকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করল সে চুরি করে নি। এই বণিক খুশি হয়ে তাকে টাকাগুলো উপহার দিয়েছিল। কিন্তু পাশেই বণিক এই কথা শুনে আরো রেগে গিয়ে চতুরকে মিথ্যেবাদী প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগল।
পুলিশের অফিসারও সেটি বিশ্বাস করতে নারাজ। কারণ পাখি মারার বিনিময়ে কেউ এতগুলো টাকা দিবে এটা একমাত্র পাগল ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করবে না। অফিসার বলল, পাখি মারার বিনিময়ে এক থলে টাকা কে দেবে? আর পুরস্কারদাতার শরীরে আঁচড়ের দাগ কীভাবে পড়বে অথবা তার জামাকাপড় কীভাবে ছিঁড়বে? তুমি নিশ্চই কোনো ডাকাত দলের সদস্য। এই বলে অফিসার চতুরকে থানায় পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিল।
এক কনস্টেবল চতুরকে হাজতে ঢুকিয়ে রাখে। চতুর মনে মনে ভাবতে লাগল, সারেঙ্গী বাজিয়ে আবার চেষ্টা করবে কিনা। কারণ বিপদের সময়ে হার মানা ঠিক হবে না। যেই কথা সেই কাজ, চতুর থানায় সারেঙ্গী বাজাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে উপস্থিত সবাই নাচতে লাগল। সবাই নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে গেল। এদিকে পুলিশের সেই অফিসারও নাচতে থাকল। শেষে অফিসার ধমক দিয়ে চতুরকে সারেঙ্গি বাজানো বন্ধ করার নির্দেশ দিল। সারেঙ্গি বাজানো বন্ধ হতেই সবার নাচ থেমে গেল। এবার চতুর পুলিশ অফিসারকে বুঝাতে লাগল কিভাবে বণিকের গায়ে আঁচর লেগেছিল। এই ঘটনার পর পুলিশ অফিসার বুঝতে পারলো চতুর আসলে কোনো দোষ করে নি সব দোষ সেই বণিকের। পুলিশ অফিসার খুশি হয়ে চতুরকে ছেড়ে দিল এবং পুরস্কার হিসেবে টাকার ব্যাগের সঙ্গে তার পক্ষ থেকেও একটি সুন্দর পাটের ব্যাগ উপহার দিল।
গল্প সংগ্রহ: সত্যনারায়ণ নাটে।
সূত্র: ভারতী লোক গল্পে একটি ইংরেজী ওয়েবসাইট থেকে।