আহসান কবির
‘ভাবমূর্তি’ শব্দের অর্থ অনেক! এই অর্থে যাবার আগে দুই দুইটা ‘প্রাকটিক্যাল ঘটনা’ বয়ান করি যাতে ভাবমূর্তির আংশিক সংজ্ঞা ফুটে উঠতে পারে!
এক. অনেক আগের ঘটনা। একদিন স্কুলে যাচ্ছি। ঝন্টু ভাই তখন উঠতি প্রেমিক আর পাড়ার নবীন মাস্তান! আগের দিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাংলা সিনেমা দেখে গান মুখস্থ করে এসেছেন। স্কুলে যাবার পথে দেখলাম ঝন্টু ভাই নাচার ভঙ্গিতে গাইছেন-‘কচি ডাবের পানি..দু আনা তিন আনা..’!
আমার সাথে স্কুলে যাচ্ছিলেন পাড়ার বড় বোন ‘কচি আপা’। স্কুলে ঢুকে তিনি সরাসরি গেলেন হেডস্যারের রুমে। তারপরের ঘটনা দুঃখজনক। স্কুলের করিডোর ধরে হাঁটাতে হাঁটাতে ঝন্টু ভাইকে বেত মারতে লাগলেন হেডস্যার আর বলতে থাকলেন-‘কী রে গান গা এখন। গান গা!’
ঝন্টু ভাই জানতেন মাইরের উপরে ওষুধ নাই আর এই ওষুধ খেলে গান আর আসে না। তবে মার খাওয়ার পরেও বুঝতে পারেন নি গান গাওয়াতে কচি আপার ‘ভাবমূর্তি’ কী ভাবে ক্ষুণ্ণ হলো! ঝন্টু ভাই নাকি কচি আপার ভালো নাম জানতেন- শাবানা বেগম! কচি নামটা তার জানা ছিল না! ছোটকাল থেকেই আমার মনে হতো ‘ভাবমূর্তি’র সাথে জানা কিংবা না জানার একটা সম্পর্ক আছে! সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যেতে পারে।
দুই. দ্বিতীয় ঘটনা উপরের গল্পের ঠিক বিপরীত। এক স্বামী ওত পেতে ছিলেন। তিনি জানতেন তার স্ত্রীর অন্যের সাথে সম্পর্ক আছে। স্ত্রীকে চারদিন পর ফেরার কথা জানিয়ে একদিন সকালে তিনি খুব দূরে যাবার কথা বলে ঘর ছাড়লেন। তিনি অবশ্য ফিরলেন সেদিন মধ্যরাতে। কলিংবেল শুনে স্ত্রী দিশেহারা। কী আর করা? স্ত্রী তার প্রেমিককে মূর্তি সাজিয়ে ড্রয়িং রুমে দাড় করিয়ে রাখলেন। স্বামী সব বুঝেও সে সময় কিছু বললেন না। স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়ার পর স্ত্রীর প্রেমিকের কাছে যেয়ে বললেন- ‘চোর’ কিংবা ‘পরকীয়াকারী’ হিসেবে ধরা খাওয়ার চেয়ে মূর্তি সেজে দাঁড়ালে ‘ভাবমূর্তি’ কী বাড়ে নাকি একই থাকে?
আমরা ভাবমূর্তি নিয়ে কোনো বিতর্কে না যাই। ভাবমূর্তির অর্থ কী কী হতে পারে সেসব শুনি- ধারণা, স্বরূপ, প্রতিরূপ ভাব, কল্পনা করা, প্রস্তরমূর্তি, প্রতিমা, বিম্ব, প্রতিবিম্ব, রূপক, প্রতিমূর্তি, উপমা, ছায়া, প্রতিচ্ছায়া, মনোভাব, সাদৃশ্য, প্রতিমা গঠন করা, প্রতিমূর্তি নির্মাণ ইত্যাদি! বাংলা ছবির নাম ছিল- ‘একই অঙ্গে এত রূপ’! ভাবমূর্তি নিয়ে যে ছবি নির্মিত হবে তার নাম হতে পারে-‘একই শব্দের এত মানে!’
তবে বিদেশী ঘটনা প্রবাহেও ‘ভাবমূর্তি’ দারুণ ভাবে আছে। যেমন উত্তর কোরিয়ার এক জেনারেল আসলেন দেশে। তিনি দেশি সৈনিকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে যেয়ে একটা কৌতুক বললেন। সৈনিকরা সব সটান দাঁড়িয়ে তখনও। দেশি এক জেনারেল তখন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বললেন, উনি আমাদের নাকি একটা মজার কৌতুক বলেছেন। আসুন আমরা হাসতে হাসতে হাততালি দেই। এরপর হাসি ও হাততালির বন্যা বয়ে গেল। কোরিয়ার জেনারেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো না বরং বাড়ল!
রাশিয়া ও অ্যামেরিকা যখন প্রবল পরাক্রমশালী পরাশক্তি ছিল এবং যখন স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল তখনও ভাবমূর্তি ছিল আলোচনায়। সেকালে একবার রাশিয়া ও অ্যামেরিকার রাষ্ট্রদূতদের ভেতরে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। দৌড়ে প্রথম হয়েছিলেন অ্যামেরিকান রাষ্ট্রদূত। পরদিন রাশান পত্রিকায় যে খবর ছাপা হয়েছিল তা এমন- গতকাল এক দৌড় প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। অ্যামেরিকার রাষ্ট্রদূত শেষ প্রতিযোগির ঠিক আগে দৌড় শেষ করতে সমর্থ হন!
ছোটকালে আমরা বইতে পড়েছি- স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই কঠিন। হয়ত তেমনি ভাবমূর্তি অর্জনের চেয়ে ভাবমূর্তি রক্ষা করাই কঠিন! আমাদের এলাকায় আহমেদ নামে এক লোক চোরাকারবারের সাথে জড়িয়ে অনেক টাকা কামিয়েছিল। তবে তার নাম হয়ে গিয়েছিল-‘চোরা (আহ) মেদ’! ভাবমূর্তি রক্ষা করার জন্য তাকে প্রথম মসজিদ ও মাদ্রাসা স্থাপন করতে হয়েছিল। তারপর সে দাঁড়িয়েছিল নির্বাচনে। ভাবমূর্তি রক্ষা করা কিংবা বাড়ানোর অনেক কৌশল আছে। আসল কৌশল টাকা! টাকা বিধাতার কাছে বাকি সব ম্লান!
গানের কথায় আছে- ‘প্রেম করতে দুইদিন ভাঙতে একদিন এমন প্রেম আর কইরো না’! প্রেম করতে দুইদিন মানে প্রেম হতে সময় লাগে বা প্রেমের জন্য অনেক সময় দিতে হয়। আর ভাঙতে নাকি একদমই সময় লাগে না! ভাবমূর্তিও তাই। গড়তে লাগে বহুদিন আর ভেঙে পড়তে নাকি এক মুহুর্তও লাগে না। ভাবমূর্তি যখন ভেঙে পড়তে থাকে তখন যার ভাবমূর্তি ভাঙছে সে নাকি সহসা টের পায় না! যখন টের পায় তখন আর সময় থাকে না, ভাবমূর্তিও আর কোনো কাজে আসে না! অনেকটা ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবির সংলাপ- ‘দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খান খান’ এর মতো অবস্থা আর কি!
তবে কখনও সখনও আপনি হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। যেমন জীবনানন্দ লিখেছিলেন-‘যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা’। তেমনি ধর্ষণ মামলার আসামী যদি জনপ্রতিনিধি হয় এবং আপনাকে যদি তার কাছ থেকে ‘চারিত্রিক সনদ’ আনতে হয় তখন? ভাবমূর্তি নিয়ে তখন হয়ত আর ভাবা ঠিক হয় না!
ধরুন ভাবমূর্তি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। ধরুন একটা গরিব শিশুকে আদর করে চুমু দিয়েছেন। তাকে দশ টাকা দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়েছেন। এরপর যদি শিশু নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে, তখন? যদি ঘটনাটা নিয়ে তোলপাড় হয় তাহলে আপনি কোন্ পক্ষে যাবেন? চিন্তা হচ্ছে অনেক? তাহলে শুনুন। যেমন ধরুন কচ্ছপ আর শামুকের ভেতর সংঘর্ষে শামুক মারা গেলে কার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে? আপনি কোনো পক্ষে না যেতে চাইলে কচ্ছপের সাক্ষাৎকার নিতে পারেন। কচ্ছপ নির্ঘাৎ বলবে, এত দ্রুত ঘটনা ঘটেছে যে কিছু বুঝে উঠতে পারি নি। কেন এই কৌতুক বললাম? আপনিও বলুন শিশু নিগ্রহ হয়েছে কিনা?
না বলতে চাইলে কথা না বলার সেই পুরনো কৌতুকটা শুনুন এবং জায়গা মতো মুখ বন্ধ রাখুন। এক পীর সাহেবের কাছে এসেছে এক নারী। নারীর অভিযোগ অনেক। তার স্বামী মাতাল। লম্পট। গায়ে হাত তোলে। সংসারের দিকে নজর রাখে না। যৌতুক চায়। ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে সব কথা পীর সাহেবের কাছে বয়ান করল সেই নারী। পীর সাহেব তার হাতে একটা তাবিজ তুলে দিয়ে বললেন, এটা হাতে বা গলায় পরা যাবে না। দাঁত দিয়ে চেপে রাখতে হবে। এক সপ্তাহ পর সেই নারী আবারও পীর সাহেবের সাথে দেখা করতে এল। সাথে ফুল আর মিষ্টি। তার স্বামী এই সাতদিনে নাকি ভালো হয়ে গেছে। তাকে কোনো অত্যাচার করে নি। সবই পীর সাহেবের তাবিজের বরকত।
পীর সাহেব বললেন, এটা তাবিজের বরকত না। তাবিজ দাঁত দিয়ে ধরে রাখা মানে কথা বলতে না পারা। এটা যখন তখন গড়গড় করে কথা না বলার বরকত। আশা করি এরপর থেকে আপনার মুখ বন্ধ থাকবে! স্বামীর কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করবেন না!
সুখে শান্তিতে বাস করতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখুন। মুখ বন্ধ রাখলে আপনার ভাবমূর্তি নিয়ে কেউ টানাটানি করবে না। তাই বলে আবার ভাববেন না বোবার ভাবমূর্তি সবচেয়ে ভালো! নীরবতা মানে সব কিছু মেনে নেওয়া নয়। কিছু নীরবতা আপনাকে সজীব করে তুলতে পারে। নীরবে তাই কবিতা পড়ুন-
‘সব হারিয়ে প্রথম প্রথম নিজের ভেতর জ্বালতে হয়
সবাই যখন চুপ হয়ে যায় তখন কথা বলতে হয়
প্রেমের নদী গণতান্ত্রিক দ্বৈত পারাপার’