আমি যাই যতদূর, আমার দেশ যায় ততদূর। মানচিত্র আর সীমারেখায় আবদ্ধ থাকে না কারও স্বদেশ। শুধু পণ্য নয়, মানুষও দেশের বাহক হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখাটি পোশাকের গায়ে প্রায়ই দেখে থাকেন নিউ ইয়র্কের অধিবাসীরা। আস্থাও রাখেন বাংলাদেশি পোশাকের ওপর। বাংলাদেশিরা যখন নানাভাবে ছড়িয়ে থাকেন নিউ ইয়র্কে তখন ভিনদেশি সব মানুষ আপনাকেই বাংলাদেশ হিসেবে জানে।
নিউ ইয়র্ক শহরের পাঁচটি বরোতে প্রায় ২ লাখের মতো নিবন্ধিত এবং ৫০ হাজারের মতো অনিবন্ধিত বাংলাদেশি তো কম সেবা দিচ্ছে না এই শহরের বাসিন্দাদের। তারপরেও কে খবর রাখে বাংলাদেশি সংগ্রামী ও পরিশ্রমী মানুষদের? নিউ ইয়র্কের কুইন্স, দ্য ব্রঙ্কস এবং ব্র“কলিনের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে বাংলাদেশিরা এমনভাবে বসবাস ও চলাফেরা করেন দেখে মনে হয় এ যেন নিউ ইয়র্কের বুকে ক্ষুদ্র এক বাংলাদেশ।
আমেরিকার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির এই মানুষজন। এই রাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তানরা বেড়ে উঠছে। তাদের বেশিরভাগই এখন কায়িক শ্রমের বদলে মেধা দিয়ে আমেরিকার উন্নয়নে অংশ নিচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ পায় তখন সে বোঝে প্রকৃত মুক্তির মর্মার্থ। এজন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমেরিকার আপামর জনতা একাত্মতা ঘোষণা করেছিল।
প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে যে নিউ ইয়র্কার ফাস্ট ফুড শপ থেকে চা-কফি অথবা নাশতা করেন তাতে কোনো না কোনো বাংলাদেশি মানুষের মমতা মিশে থাকে। কারও কারও যত্ন ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞাসাও করেন আপনি কোন্ দেশের? অনেকে নাম শুনে চিনতেও পারেন না বাংলাদেশকে। তবু বাংলাদেশ নামটি জমা হয়ে থাকে তাঁর বুকের বাম অলিন্দে। বাদামি গায়ের রঙের মাঝারি উচ্চতা ও গড়নের সেই নারী অথবা পুরুষ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ঝড়-বাদল-তুষারে খাবার পৌঁছে দেন মানুষের ঘরে। অতিথিপরায়ণতা বাংলাদেশি মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে রাতদিন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ নিউ ইয়র্কারদের খাবার সম্পর্কিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।
হলুদ রঙের ট্যাক্সি ক্যাব নিউ ইয়র্কের অন্যতম পরিচায়ক। সুলভ মূল্যের ট্যাক্সি-লিমুজিন এবং উবার জাতীয় যানবাহন ছাড়া এই শহরে যাতায়াত অসম্ভব। কেউ যখন মাতাল হয়ে অথবা অন্য যে কোনো সমস্যায় নিজের গাড়ি অথবা সাবওয়ের সরকারি গাড়িতে চড়ার সুযোগ থাকে না তখন তারাই আপনার একমাত্র অবলম্বন। আপনার একটি কল অথবা হাতের ইশারায় এই টিএলসি চালকরা আপনাকে সযতনে গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। এই শহরের ট্যাক্সি চালকের প্রায় ৪৫ শতাংশই বাংলাদেশি। তাদের বিনয়ী আর সহযোগিতামূলক আচরণের প্রভাব কি বাংলাদেশি পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর পড়ে না?
নির্মাণ এবং আবাসন এই শহরের কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। শহরের নানান রাস্তায় প্রতিনিয়ত ঘর-অফিস নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে এবং এ সব স্থাপনা ভাড়া দেওয়া এবং নেওয়াতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অন্তত বিশ হাজার বাংলাদেশি। নিউ ইয়র্ক শহরে যানজট নিয়ন্ত্রণে নিরলস পরিশ্রম করছেন অন্তত ৩ হাজার বাংলাদেশি ট্রাফিক এজেন্ট। এর মধ্যে কেউ কেউ সুপারভাইজার, ম্যানেজার ও ডিটেকটিভও হয়েছেন প্রমোশন পেয়ে। শহরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এনওয়াইপিডিতে সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখছেন প্রায় চারশ’ বাংলাদেশি। তাদের মধ্যে রয়েছেন ৩ জন ক্যাপ্টেন, ১৫ জন লেফটেন্যান্ট ও ২৮ জন সার্জেন্ট। বোর্ড অব এডুকেশনে কাজ করছেন প্রায় হাজারখানেক নারীপুরুষ। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকও আছেন গুটিকয়েক। সিভিল সার্ভিস ও এমটিএতে আছেন আরও হাজারখানেক বাংলাদেশি। নগরীর চিকিৎসা খাতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন প্রায় হাজারও বাংলাদেশি স্বাস্থ্যকর্মী। তার মধ্যে নিয়মিত রোগী দেখেন অথবা কোনো হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন অন্তত ৩শ’ চিকিৎসক।
ওপরের পরিসংখ্যান নেয়া হয়েছে পিউ রিসার্চ এবং সংশ্নিষ্ট পেশাজীবী বাংলাদেশি সংগঠন থেকে। ক্ষুদ্র এই জনগোষ্ঠীর অন্তত হাজারখানেক সংগঠন আছে। তাদের কেউ আঞ্চলিক সমিতি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক। এসব সংগঠনের মাধ্যমে মূলত তারা পার¯পরিক স¤পর্ক বজায় রাখেন এবং আড্ডায় মেতে ওঠেন।
মূলত অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে এ দেশে এলেও অন্তরে ও আচরণে তারা ধারণ করেন পুরো বাংলাদেশকে। পৃথিবীর ইতিহাসে মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশিরা। ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে ১৯৯৭ সাল থেকে ২১ ফেব্র“য়ারিকে করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশিরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করেন দিবসটি। বাংলা একাডেমির আদলে ৩০ বছর ধরে বইমেলার আয়োজন করে আসছে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন। পরম মততায় তারা উদযাপন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ সকল জাতীয় দিবসকে।
বাংলা পঞ্জিকার প্রথম দিনে অথাৎ পহেলা বৈশাখে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় বর্ণিল পোশাক পরে হাতে পেঁচা, ঘুড়ি, হাতি, ঘোড়া, লাঙল জোয়ালসহ নানান ধরনের মুখোশ এবং দেশীয় ঐতিহ্যবাহী উপাদান নিয়ে র্যালি করে বাংলাদেশিরা। পরিবেশন করা হয় সাদা ভাত ও মাছ-সবজি তরকারি। সঙ্গে নানা ধরনের ভর্তা ও ডাল।❐
লেখক: নিউ ইয়র্ক প্রবাসী, নাট্যকার ও সাংবাদিক